ভারত থেকে হাসিনাকে ফেরানোর বিষয়টি রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপরই নির্ভর করছে
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর– দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু, এই ঘটনার আগপর্যন্ত কয়েক সপ্তাহের বিক্ষোভে অন্তত ৬৫০ জন (প্রকৃতপক্ষে এক হাজারের বেশি হবে) প্রাণ হারিয়েছেন, নির্বিচার গুলিতে আহত হয়েছেন আরো অজস্র।
তারপর থেকে হাসিনা ও তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে অন্তত ৯৪টি ফৌজদারী মামলা হয়েছে। এসব মামলায় হত্যা, নির্যাতন, গুম, অপহরণ, মানবতাবিরোদী অপরাধ ও গণহত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে।
হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তার বিচার করার অধিকার রয়েছে আদালতের। তবে তা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ এতে বিচার প্রক্রিয়া, ন্যায্যতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাছাড়া, মূল অভিযুক্ত হাসিনার অবর্তমানে আদালতের রায় কার্যকর করাও কঠিন হবে।
আর তাই হাসিনার বাংলাদেশ ছেড়ে পালানোর মুহূর্ত থেকেই তার নেতৃত্বে সংগঠিত অপরাধগুলোর জন্য তাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠছে। কিন্তু, ভারত হাসিনাকে ফেরত দেবে কিনা– তা অনেকটাই অনিশ্চিত।
বাংলাদেশ হাসিনাকে ভারতের কাছে ফেরত চাইতেই পারে। ২০১৩ সালে উভয় দেশের মধ্যে একটি বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিও স্বাক্ষর করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া আরো সহজ করতে ২০১৬ সালে তাতে সংশোধনীও আনা হয়।
তখন দুই দেশই এ চুক্তির জন্য উন্মুখ ছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহের প্রধান কারণ ছিল, হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত দুজন তখন ভারতে আত্মগোপন করেছিলেন। দেশে এনে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চেয়েছিল হাসিনার সরকার।
ফেরত দিলে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে এমন সম্ভাবনা থাকায় কানাডার মতো কিছু দেশ তাদের ওখানে থাকা অভিযুক্ত বা দোষী সাব্যস্তদের প্রত্যর্পণে রাজী হয়নি। তবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ভারতেও থাকায় – অভিযুক্তদের ফেরত দেওয়ার পরে বাংলাদেশে তাদের সর্বোচ্চ সাজাটি কার্যকরের বিষয়ে দিল্লি কোনো বাছবিচার করেনি, এবং ২০২০ সালে ওই দুইজনকে ঢাকার কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এর আগে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন– ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অভ আসামের মহাসচিব অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পায় ভারত। বাংলাদেশে বন্দি হওয়ার পরে ১৮ বছর কারাগারে ছিলেন তিনি, ২০১৫ সালে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করে আওয়ামী লীগ সরকার।
চুক্তি অনুযায়ী, ন্যূনতম এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধই প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ হতে পারে। অবশ্য উভয় দেশেই সে অপরাধ অবশ্যই শাস্তিযোগ্য হতে হবে। হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তাতে তাঁকে ভারতের আইনেও অভিযুক্ত করা যেতে পারে, এবং এসব ভারতীয় দণ্ডবিধিতেও এসব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার শাস্তিও যথেষ্ট। ফলে এই ভিত্তিতে তিনি অবশ্যই প্রত্যর্পণযোগ্য।
চুক্তির ১০ নং অনুচ্ছেদ, অনুরোধকারী দেশের জন্য এই ফেরত পাবার প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করেছে। কারণ, এতে বলা হয়েছে যে, অপরাধীর বিরুদ্ধেসুনির্দিষ্ট প্রমাণ না দিয়ে প্রত্যর্পণের জন্য আদালত থেকে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা যথেষ্ট হবে। তবে এখনও পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের কোনো পরোয়ানা জারি করেনি বাংলাদেশ।
ফিরিয়ে আনা যেকারণে কঠিন
তবে, এই চুক্তিতেই বেশ কয়েকটি এমন বিধানও আছে, যার সুযোগ নিয়ে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারে ভারত। যেমন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনীত অপরাধের অভিযোগগুলো রাজনৈতিক প্রকৃতির দাবি করে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ অস্বীকার করতে পারে।
সাধারণত এটা মেনে নেওয়া হয় যে, রাজনৈতিক বা সামরিক অপরাধের জন্য প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করা হবে। রাজনৈতিক শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি রাষ্ট্রের অধিকার রক্ষা করার পাশাপাশি অন্য দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার যে প্রয়োজনীয়তা– সেটি একে যৌক্তিকতা দেয়।
তবে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিতে উল্লেখ আছে যে, হত্যাচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, মিথ্যা অভিযোগে কারাদণ্ড বা হত্যার উস্কানি দেওয়াকে রাজনৈতিক অপরাধ বলে গণ্য করা হবে না। আর এপর্যন্ত হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেখানে আনীত অভিযোগ এসব শ্রেণির অন্তর্গত।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও চুক্তিতে বলা আছে, ভারতের আদালত যদি নির্ধারণ করে যে, অভিযোগ সৎ বিশ্বাসে বা ন্যায়বিচারের স্বার্থে করা হয়নি — তাহলে প্রত্যর্পণের যেকোনো অনুরোধ অস্বীকার করতে পারবে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে আসার পর রাজনৈতিক নিপীড়ন, অন্যায্য বিচার বা অমানবিক আচরণের মুখোমুখি হবেন – এমনটা বিশ্বাস করলে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে ভারতীয় আদালত।
আদালতের এমন নির্ণয়কে খণ্ডন করা বাংলাদেশের পক্ষে সহজ হবে না। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে গেপ্তার হওয়া হাসিনা সরকারের কিছু মন্ত্রি ও কর্মকর্তা আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হয়েছেন। এমনকী কোনো আইনজীবীও তাদের পক্ষ নিতে চাননি বলে জানা গেছে। (যদিও তাদের আইনজীবী প্রদানের বিষয়ে এখন উদ্যোগী আইন মন্ত্রণালয়)।
বেশকিছু হত্যামামলা ক্ষোভ ও বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে দায়ের করারও কথাও শোনা গেছে। ক্রিকেটার এবং সাবেক আইনপ্রণেতা সাকিব আল হাসানসহ কিছু লোককে (হত্যার) উস্কানিদাতা বা প্ররোচক হিসাবে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যার ফলে কিছু মামলায় প্রকৃত অপরাধীদের অভিযুক্ত করা হয়েছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। (যদিও, নিঃসন্দেহে বিতর্কিত ব্যক্তিরা অন্যান্য অপরাধ করেছেন, বরং সেগুলোর জন্য মামলা দায়ের করা যেত)
ফলে হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলে– এখানে তার নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার না হওয়ার দাবি করতে পারে ভারত। (যেখানে দিল্লির পররাষ্ট্রনীতির মূল অভিসন্ধিই আসলে কাজ করবে)
হাসিনার জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তা নেই, এমন দোহাই দিয়ে ভারতে বা অন্য কোথাও রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হতে পারে। আর একবার রাজনৈতিক শরণার্থী হিসেবে জায়গা পাওয়া ব্যক্তিদের ফেরত আনার আলোচনাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। এর আগেও শেখ মুজিব নিহত হওয়ার পরে – ভারতে সফলভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছিলেন হাসিনা।
যদিও এবার তার জন্য ভারতে আশ্রয় লাভ করাটা বেশ জটিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাসহ তার মন্ত্রি-এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে।
হাসিনা এরমধ্যে যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ফিনল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। কিন্তু, আশানুরূপ সাড়া পাননি কোনো দেশের। যদিও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, তার মা কোথাও রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেননি, এবং নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হলে 'নিশ্চিতভাবে ফিরে যাবেন' বাংলাদেশে।
এসমস্ত প্রেক্ষাপটে বলা যায়, বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিটি সবক্ষেত্রে অপরাধীকে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। ব্যবহারিক দিক থেকে এটি কেবল এবিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তার একটি আইনি কাঠামো প্রদান করে মাত্র। ফলে পুরো বিষয়টি আইনি বিধানের চেয়েও বেশি নির্ভর করে মূলত কূটনতিক আলোচনা ও উভয় দেশের সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।
লেখক: রাইসুল ইসলাম সৌরভ আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব গ্যালওয়ে'তে লিগ্যাল এনালিটিক্সে পিএইচডি করছেন ।