সেমিকন্ডাক্টর কি পৃথিবীকে নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে?
অস্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ সার্বিয়ান গুপ্ত সেনাদের হাতে নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরও অনেক কারণ পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা বিশ্লেষণ করলেও, তাৎক্ষণিক কারণ হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডকেই চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। চার বছর ধরে চলা যুদ্ধে এক কোটি সৈনিক এবং প্রায় দেড় কোটি বেসামরিক নিরীহ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল।
এই যুদ্ধের মধ্যদিয়ে তুর্কি অটোমানদের ক্ষমতার পরিসমাপ্তি ঘটে। যে সার্বিয়ান জাতীয়তাবাদের কারণে অস্ট্রিয়ার যুবরাজ নিহত হয়েছিলেন, সেই সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়াসহ এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম নিয়েছিল। নতুন এক রাজতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল, যা জীবিত ছিল ১৯২৯ সালের জুন পর্যন্ত। আরো তিনটি দেশ একত্র হয়ে ১৯৪৯ সালে সোশালিস্ট রিপাবলিক অফ যুগোস্লাভিয়ার নাম ধারণ করে ১৯৯২ পর্যন্ত বহাল ছিল। এ অঞ্চলের ভূরাজনীতি দুটি বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে নানাভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যুগোস্লাভিয়ার জন্ম হয়। ক্রোয়েশিয়া, হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যবস্থার গর্ভ থেকে জন্ম হয় যুগোস্লাভিয়ার। যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে। ১৯১৮ সালে শেষ হওয়া সেই যুদ্ধ ইউরোপে আবার ফিরে আসে ১৯৩৯ সালে। শুরুতেই জার্মানি তার ব্যাপক সামরিক শক্তি দিয়ে ইউরোপের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এবং জার্মান হিটলারের উগ্র জাতীয়তাবাদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ।
যুদ্ধ পৃথিবীর নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করে। এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে পৃথিবীর বুকে নতুন সামরিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজয়ের ভেতর দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে। নতুন অস্ত্রের পরীক্ষাগার করা হয় জাপানকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভেতর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর বুকে নতুন সামরিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর পাশাপাশি নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ভেতর থেকে বিশ্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রকও বনে যায় তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে এমন কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম সরাসরি অথবা পর্দার অন্তরালের নায়ক হিসেবে লেখা হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরিসমাপ্তির অল্প পর প্রথম কোরিয়া যুদ্ধ, তারপরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ, তার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের তেল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা এবং এই একই ধারাবাহিকতায় প্রক্সি যুদ্ধে আফগানিস্থানে লিপ্ত আশির দশকের সেই যুদ্ধে সরাসরি মার্কিনিরা অংশগ্রহণ না করলেও, পর্দার আড়ালের চালিকাশক্তি ছিল তারাই।
পৃথিবী গত শতাব্দী পার করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রায় ৭৭/৭৮ বছর হতে চলল। পৃথিবীতে আবার কোন বিশ্বযুদ্ধ ঘটবে কি ঘটবে না, তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। অনেক দেশ যুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধ, শীতল যুদ্ধ নানা ঘটনা ঘটেছে। আগের শতাব্দীতেও যুদ্ধ অর্থনৈতিক অর্জনের মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ভূখণ্ডে নানাভাবে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাপী এত ব্যাপকভাবে যুদ্ধ পরিচালিত হওয়ার ইতিহাস অতীতে খুব কমই আছে। পৃথিবীর নানা প্রান্তের যুদ্ধ মার্কিন অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে সামনে এসেছে। দেশে দেশে যুদ্ধ হয়, বিবদমান দেশগুলোতে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদহানি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে চাঙ্গাভাব তৈরি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হচ্ছে তার এই যুদ্ধ নীতি।
গত শতাব্দীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ১০০ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। কী হবে আগামীতে? তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন? নানাভাবে, নানা কৌশলে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও এখন একটি নতুন মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে। পারমাণবিক শক্তি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার ফলে হয়তো তাৎক্ষণিক বিশ্ব যুদ্ধের আশঙ্কা আগের তুলনায় অনেক কম। কারণ অনেক দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। মার্কিনিরা চীনের সঙ্গে যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছে তা এখন আন্তর্জাতিক রূপ পরিগ্রহ করছে।
২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী অ্যাবের প্রস্তাবিত কোয়াড চুক্তি নতুন মাত্রা লাভ করছে। কখনো এই কোয়াডকে মনে হয়, একটি আন্তর্জাতিক ন্যাটোর মতন একটি বিকল্প সামরিক শক্তি। গঠনকালে থেকে ন্যাটো মূলত সামরিক জোট হলেও পরবর্তীকালে জোটভুক্ত দেশগুলো অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক সৃষ্টি করেছিল। এর বাইরে চীনের বাণিজ্যিক শক্তি এবং এর ফলে বিশ্বব্যাপী তার যে কর্তৃত্ব সৃষ্টি হচ্ছে তার বিপক্ষে মার্কিনিরা অনেকদিন ধরেই সোচ্চার। এর সঙ্গে যুক্ত জাপানসহ অন্যরা।
গত ২০ বছরের ব্যাপক অর্থনৈতিক বিকাশের ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই চীনা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক হুমকি সৃষ্টি হয়েছে। বৈশ্বিকভাবে চীন বেশকিছু ভূখণ্ডকে তার নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হয়েছে, যার মধ্যে কর্তৃত্ববাদী পরিবারতান্ত্রিক শ্রীলংকা বড় উদাহরণ। আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও সাম্প্রতিক আফগানিস্তান এই দলভুক্ত।
জলবায়ুর পরিবর্তন, পৃথিবীর উষ্ণায়ন এবং দূষণের মাত্রা থেকে চীন ব্যাপকভাবে পিছিয়ে পড়ে। তাই অর্থনীতির আভ্যন্তরীণ নীতির আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে বেশ কিছুকাল যাবত ডিজেল চালিত গাড়ির পরিবর্তন করে বৈদ্যুতিক গাড়ি নিয়ে আসে তারা। এবং এরই অংশ হিসেবে ইলেকট্রনিকস তৈরি কিংবা অন্যান্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী সেমিকন্ডাকটরের আকাশচুম্বী চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, যা চীনের নিয়ন্ত্রণে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সে কারণে সেমিকন্ডাক্টরের বাজার নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত মিলিতভাবে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের নানান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করতে পারবে ভারত। সেই লক্ষ্যে তারা এবারের বাজেটে বড় বরাদ্দ রেখেছে। সেমিকন্ডাক্টর তৈরির পরিকল্পনায় ভারত ৭৬ হাজার কোটি রুপি সংস্থান করেছে জাতীয় বাজেট প্রণয়নে।
বিশ্বের আগাম উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণের জন্য সেমিকন্ডাকটরের আকাশচুম্বী চাহিদা বিশ্বকে এক নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেমিকন্ডাক্টর চিপস প্রকৃতপক্ষে কম্পিউটারের ব্রেইন বলে পরিচিত। এই চিপস এর উপর যাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে তারাই বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে। অনেকেরই আশঙ্কা, সেমিকন্ডাক্টরের উৎপাদন, বিতরণ এবং নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে আগামী দিনের বিশ্বে যে নতুন মেরুকরণ হচ্ছে তা যুদ্ধে রূপ নেবে না তো? কে জানে, আমরা হয়ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক