মমতাপূর্ণ স্পর্শ শিশুর আবেগীয় চাহিদা পূরণে কতটা দরকার?
শিশুর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য মমতাপূর্ণ স্পর্শ খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মায়ের স্পর্শ। শারীরিক বিকাশের জন্য বুকের দুধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, মানসিক বিকাশের জন্য স্পর্শ করে আদর করাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি শারীরিক খাদ্য, দ্বিতীয়টি মানসিক। কোন একটির ঘাটতি হলে, সমস্যা অনিবার্য। জন্মের পর শিশু যদি আদর মমতা ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়, কারো কাছে সাদরে গৃহীত না হয় অর্থাৎ সবার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তারা সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে। তাদের মধ্যে নানা ধরণের আচরণগত ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। উদ্বিগ্ন, বিরক্ত এবং কখন কী করবে ঠিক নেই, এমন শিশুদের কাছ থেকে সবাই দূরত্ব বজায় রাখে। বেশি বিরক্ত করলে অনেক সময় মায়েরও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। যার ফলে সমস্যা আরো প্রকট হয়।
ক্রমাগত স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হলে, পরিণতি কতটা ভয়ংকর হতে পারে- তার বাস্তব উদাহরণ হচ্ছে ষাটের দশকের সমাজতান্ত্রিক রোমানিয়া। প্রেসিডেন্ট নিকোলা সিউসেস্কু (Nicolae Ceausescu) দেশকে মহাশক্তিধর করার জন্য জনসংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। জন্মহার বাড়ানোর জন্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিষিদ্ধ করলেন, গর্ভপাত অবৈধ ঘোষণা করলেন, ২৫ বছর বা তদূর্ধ্ব নাগরিক যাদের সন্তান নেই তাদের উপর কর আরোপ করলেন। কিছুদিনের মধ্যে জন্মহার বেড়ে গেল। পরিত্যক্ত ও গৃহহীন শিশুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেল আশংকাজনকহারে। অসহায় এসব শিশুর লালনের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এতিমখানার ব্যবস্থা করা হলো। অতিরিক্ত শিশুর খরচের চাপ সামলাতে না পেরে অনেক মা-বাবা বাধ্য হয়ে তাদের শিশুকে এতিমখানায় দিয়ে দিলেন।
সরকারি এই এতিমখানাগুলোতে সেবিকারা বিভিন্ন শিফটে দায়িত্ব পালন করতেন। যার ফলে নির্দিষ্ট কারো সাথে শিশুদের বন্ধন তৈরি হয় নি। ক্রমাগত মমতা বঞ্চিত হতে হতে এই শিশুদের মধ্যে আবেগীয় শূন্যতা তৈরি হলো। দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে, পরিস্থিতি আরো শোচনীয় হতে লাগল। আর্থিক বরাদ্দ ও সেবিকার সংখ্যা কমানো হলো। স্বল্প বাজেট ও কম জনবলের কারণে সেবিকাদের পক্ষেও সুষ্ঠুভাবে সব শিশুর যত্ন নেয়া সম্ভব ছিল না। দিনের পর দিন প্রয়োজনীয় পুষ্টি, আদর, মমতা, ভালোবাসা ও আবেগীয় উদ্দীপনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে এসব শিশুর মধ্যে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিল। অধিকাংশ শিশুই নিষ্পলক শূন্যের দিকে তাকিয়ে থাকত। কথা বললেও সাড়া দিত না। এমন কি এতিমখানার ভেতর দিয়ে হেটে গেলেও কোন ধরনের সাড়া শব্দ পাওয়া যেতো না। হাজার হাজার শিশু নির্মম পরিণতির শিকার হলো।
আশার কথা হচ্ছে- সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে যারা পরবর্তীতে আদর যত্ন পেয়েছে, তারা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছিল। সমস্যাগ্রস্ত শিশুদের একাংশকে ব্রিটিশ কিছু পরিবার দত্তক নিয়েছিল। মমতা ও যত্ন পেয়ে এই শিশুরা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। হয়ত তাদের বয়স কম ছিল বলে আবেগীয় শূন্যতা অনেকাংশেই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, শিশুর জীবনে আদর-মমতার গুরুত্ব কতখানি।
তাই আপনি যে শিশুকে ভালোবাসেন সেটা তাকে বুঝতে দিন। কথা ও স্পর্শের মাধ্যমে শিশুর প্রতি আপনার মমতাকে প্রকাশ করুন। খাওয়ানো, গোসল করানো, কাপড় পরানো, ঘুম পাড়ানো সহ সমস্ত পরিচর্যা মমতাযুক্ত হাতের স্পর্শে করুন, যেন সে উপভোগ করে। কিছুটা বড় হলে- উৎসাহ বা অভয় দেয়ার জন্য মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিন। এই ব্যাপারটি দারুণ কাজ করে। সন্তান তৎক্ষণাৎ ইতিবাচকভাবে উজ্জীবিত হয়। কোন কিছু বুঝানোর ক্ষেত্রেও এই কৌশল প্রয়োগ করতে পারেন।
যত ব্যস্তই থাকুন না কেন, প্রতিদিন শিশুর সাথে কমপক্ষে আধা ঘণ্টা সময় একান্তে কাটান। এই সময়ে কোনো কাজ রাখবেন না, শুধু তাকেই মনোযোগ দিন। শিশু সাত বছরের ছোট হলে, দিনের তিনটি সময়ে তার প্রতি একটু বেশি মনোযোগ দিবেন- ঘুম থেকে ওঠার পর তিন মিনিট, স্কুল থেকে আসার পর তিন মিনিট এবং ঘুমানোর আগে তিন মিনিট। ছোট শিশুর সংখ্যা একাধিক হলে, এই বিষয়টি আপনার মতো করে ম্যানেজ করবেন। এই ব্যাপারটিও খুব ফল্প্রসু। খেয়াল করলে দেখবেন, কিছু শিশু আছে যারা সারাক্ষণ বিরক্ত করে। তাদের ক্ষেত্রে যদি এভাবে মনোযোগ দিতে পারেন, এ ধরনের সমস্যা অনেক কমে যাবে।