গৃহ বা পরিবার কেন শিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে?
চলতি পথে যখন দেখি কোন শিশু ফুল, তোয়ালে, চিরুণী বা খেলনা বিক্রি করছে, তখন শুধু ভাবি আহা কার সন্তান এই মেয়েটি বা ছেলেটি? জীবিকার প্রয়োজনে এই অনিরাপদ শহরে বাইরে বাইরে ঘুরছে। রাতে কোথাও কি মাথা গুঁজে থাকতে পারবে? কোথায় পাবে নিরাপদ আশ্রয়? পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা এই শিশুগুলো ঘরের বাইরে কতটা নিরাপদ?
অথচ এই আমরাই যখন শৈশব কৈশোরে খেলতে বের হতাম বা বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতাম, তখন বাসা থেকে আব্বা-আম্মা বলে দিতো যেখানেই যাও সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে আসবে। বাইরের জগৎ সবসময় শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। বলা হতো, বাসাই হলো শিশুর জন্য সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা।
আমরাও আমাদের সন্তানদের আগলে রাখার চেষ্টা করি সবসময়। মনে করি, সন্তান পরিবারেই সবচাইতে ভালো আছে বা থাকবে। কিন্তু আমাদের সামনে থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো একটি জরিপ। জরিপটি বলছে সমাজের সবচেয়ে বড় ও নিরাপদ যে প্রতিষ্ঠান পরিবার, তা এখন আর শিশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। বরং পরিবারগুলো এখন শিশু নির্যাতনের কেন্দ্র।
শিশুকে অসহায় পেয়ে, হাতের কাছে পেয়ে এবং শিশুর উপর কর্তৃত্ব করা সহজ বলে আমরা বড়রা সবসময়ই শাসন করার চেষ্টা করি। ভুলে যাই শাসনের নামে শোষণ করে ফেলছি। আমরা চাই শিশুকে নিজেদের ইচ্ছাধীন করে রাখতে।
জরিপ বলছে, ঘরেই শতকরা ৯৫.৮ জন শিশু নির্যাতিত হচ্ছে নানাভাবে। শিশুরা পরিবারে সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় বাবা-মা ও অভিভাবকদের দ্বারা। শাস্তি ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর উপর এই নিপীড়ন চালানো হয়। কী ভয়ংকর একটি তথ্য! ভাবলেও গা শিউরে উঠছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ঘরের বাইরে, কাজের জায়গা বা অন্য যেকোন প্রতিষ্ঠানে শিশু যতটা নির্যাতিত হচ্ছে, এরচাইতে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে নিজ গৃহে। প্রতিবন্ধী শিশুরাও শুধুমাত্র প্রতিবন্ধিতার কারণে পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছে।
এর চেয়েও দুঃখজনক ও ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, জরিপে অংশগ্রহণকারী শতকরা ৯৫.৩ জন শিশু জানিয়েছে যে তারা জীবনের কোন না কোন সময় ঘরে, বাইরে, স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে সহিংসতার শিকার হয়েছে। এরমধ্যে শতকরা ৯৬.২ জন মেয়েশিশু এবং শতকরা ৯৪.৫ জন ছেলেশিশু।
শতকরা ৮৬.৯ জন শিশু গৃহে শারীরিকভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে, বাসায় থাকা শিশুরা জানিয়েছে 'শাস্তিমূলক ব্যবস্থার' নামে তাদের উপর অত্যাচার করা হয়। অন্যদিকে প্রায় শতকরা ৮১ জন প্রাপ্তবয়স্ক বলেছেন, সন্তান যদি বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়, তাহলে তারা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিশুকে শারীরিক শাস্তি দেয়ার পক্ষে। এক্ষেত্রে ছেলেশিশুরা মেয়ে শিশুদের চাইতে শারীরিক শাস্তি বেশি ভোগ করে। ছেলেশিশু শতকরা ৮৮.৪ আর মেয়েশিশু ৮৪.১।
শতকরা ৫৫ জন শিশু জানিয়েছে যে, তারা পরিবারের ভেতরেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। গৃহে মেয়েশিশুর (৫০%) চাইতে ছেলেশিশুই (৬০%) বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি দেয়া, ঝাঁকি দেয়া, ছুঁড়ে ফেলা, চিমটি কাটা, টানা হেঁচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেয়া, অতিরিক্ত শ্রম করানো এবং ভয় দেখানো। পরিবারে, সমাজে, স্কুলে সর্বত্রই শিশুকে এইভাবেই শাস্তি দেয়া হয় মানুষের মতো মানুষ করার জন্য !
শিশুকে শাস্তি দেয়ার মাধ্যমে কখনো তাকে মানুষ করে তোলা সম্ভব নয়। বরং এই ব্যবস্থা শিশুর মনোজগতে এতটাই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে যে, শিশুটি বড় হতে পারে একজন অপরাধী হিসেবে, নয়তো অমানবিক বা অসামাজিক মানুষ হিসেবে বা সমাজের নিকৃষ্ট কীট হিসেবে। এই নিপীড়ন, নির্যাতন তাকে পথভ্রষ্ট ও উচ্ছৃংখল করে তুলতে পারে। অবশ্য তুলতে পারে বলছি কেন, তুলছেই। কারণ বাংলাদেশে শিশুরা এখন যেভাবে বেড়ে উঠছে, এর অধিকাংশই আমাদের কাছে অচেনা। বাড়ছে শিশু অপরাধীর সংখ্যা। বাড়ছে শিশুর মাদক গ্রহণের হার। কারণ পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে নির্দয় আচরণ শিশুকে শিক্ষা দেবে, শিশু সেই আচরণই তার জীবনে গ্রহণ করবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় বেসরকারি সংস্থা ইনসিডিন বাংলাদেশ "বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি" শীর্ষক এই জরিপ রিপোর্টটি উপস্থাপন করেছে। জুন ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত মোট ১১টি জেলায় একটি জরিপ চালিয়েছে। সেই জরিপের তথ্য নানাভাবে আলোচনার দাবি রাখে।
এছাড়া শতকরা ৮২ জন শিশু নির্যাতিত হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরমধ্যে সবচাইতে বেশি সংখ্যক শিশু অর্থাৎ শতকরা ৮৬.১ জন শিশু ইমোশনালি বা মানসিকভাবে নিপীড়িত হচ্ছে। শতকরা ৮২ জন শারীরিক সহিংসতার শিকার হয় আর ২৪.১ শতাংশ শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে নয়, শিশু তার গৃহে ও কর্মক্ষেত্রেও শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
মানসিক হয়রানির মধ্যে পড়ে শিশুকে ছোট করা, আজেবাজে নামে ডাকা, ভয় দেখানো, গালাগালি করা, হুংকার দেয়া, ইয়ার্কি করা, বুলিং করা, শারীরিক ত্রুটি নিয়ে ঠাট্টা করা, সামাজিকভবে হেয় করা, সমালোচনা করা, অভিশাপ দেয়া, লজ্জা দেয়া, অবহেলা করা। এই হয়রানিগুলো শিশুকে মানসিক ও শারীরিকভাবে বড় হতে দেয় না। অথচ সমাজে বুলিং করার মাত্রা দিনেদিনে বাড়ছে। যার যা দুর্বলতা, তাই নিয়ে হাসাহাসি করা হচ্ছে অবিরত। ভাবা যায় একজন শিশু আরেকটি শিশুকে কানা, মোটা, শুটকা, খোঁড়া, মাইটু, ফকির, গরীব বলছে বা ধর্ম নিয়ে ইয়ার্কি করছে! আগেও ব্যাপারটি ছিল, তবে তা এত বেশি না। এখন সবক্ষেত্রে বুলিং বিষয়টা কমন হয়ে গেছে।
শিশুকে যদি মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়, সেই শিশুও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে বড় হতে বাধ্য। ইদানিং বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে যে শিশু তার সহপাঠী, বন্ধু, শিক্ষক বা বড়দের কাছ থেকে বুলিং এর শিকার হচ্ছে, যা শিশুকে অস্থির, বিমর্ষ ও নিঃসঙ্গ করে তুলছে। শিশু হয়ে উঠছে সুইসাইডাল বা অপরাধী মানসিকতার ও দুর্বল চিত্তের।
এই যে পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পাড়া বা মহল্লায় এবং কর্মক্ষেত্রে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, এটা তাদের জন্য কতটা ভয়াবহ পরিণাম বয়ে আনবে, তা কল্পনাও করা যায় না। শিশুর মনে তৈরি হয় অবিশ্বাস, ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা। সে কারো কাছে কিছু বলতে পারেনা বলে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করতে থাকে।
শিশুকে রূঢ় কথা বলা, অবহেলা করা, বাজে বা অশ্লীল আচরণ করা বা কথা বলা হলো শিশুর প্রতি করা সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ। সেটা শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়রানি হতে পারে। শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি করা হলে এটা তার শরীর, মন এবং আত্মসম্মানকে নষ্ট করে দেয়। যে শিশু একবার যৌন হয়রানির শিকার হয়, তাকে ঠিকমতো সহায়তা বা সাহায্য দেয়া না হলে, সে বারবার আক্রান্ত হতে পারে। তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে স্বজনদের হাতেই বেশি যৌন হয়রানির শিকার হয় শিশুরা। ৭ থেকে ১৩ বছরের শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। সাধারণত যৌন নিপীড়নকারী ব্যক্তি এমন একটা ভাব নেয় যা দিয়ে শিশু ভিকটিমকে এবং তার পরিবারকে অরক্ষিত করে তোলে। তারা এমন মানুষের বেশ বা কাজ নিয়ে শিশুর কাছে আসে, যাকে শিশু বা শিশুর পরিবার বিশ্বাস করে, যেমন শিক্ষক, কেয়ারগিভার বা অভিভাবকের ভূমিকায়।
এমনও হতে পারে যৌন হয়রানি করার আগে তারা শিশুটিকে স্পর্শ করে করে অভ্যস্ত করে তুলতে পারে অথবা শিশুকে এমনভাবে স্পর্শ করে, যেন শিশু কিছু বুঝতেই না পারে। এভাবেই তারা ক্রমশ পেছনে থেকে সীমা লংঘন করে বা অপরাধ চালিয়ে যায়।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের চাইল্ড এডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রির সহযোগী অধ্যাপক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যৌন হয়রানির শিকার শিশুদের নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেছেন, শতকরা ৭৫ ভাগ যৌন হয়রানির ঘটনাই ঘটে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু বা আত্মীয়দের মাধ্যমে।
তাহলে কেন শিশুরা তাদের প্রতি করা যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুলে নি, এ প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক এই জরিপে জানতে চাওয়া হলে শতকরা ৬১.৭ জন বলেছে যে লজ্জা এবং বাবা-মা ও অভিভাবকের ভয়ের কারণে মুখ খুলেনি। শতকরা ৫২.৭ জন বলেছে যে তারা তখন বুঝতেই পারেনি যে, তাদের প্রতি যৌন হয়রানি করা হচ্ছে। অপরাধী হুমকি দেয়ার কারণে চুপ থেকেছে ৩০.১ ভাগ শিশু।
যৌন অপরাধ যারা করে, তারা স্নেহ ও ভালবাসার ছদ্মাবরণে এটা করে বলে জানিয়েছে ১৬.২ ভাগ শিশু। ১৫.৬ জন শিশু বলেছে তারা ঠিক জানে না পরিবারের বাইরে কোথায় গিয়ে এই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে হয়।
জরিপে আরো দেখা হয়েছে পর্ণগ্রাফিতে শিশুর প্রবেশাধিকার কেমন বা কতোটা? শতকরা ৩৪ জন শিশু বলেছে যে তারা পর্ণগ্রাফি দেখেছে। এর চাইতেও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে শতকরা ৭৫.১ জন শিশু, যাদের মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ আছে, তারাও পর্ণগ্রাফি দেখেছে। শতকরা ২৬ জন মেয়েশিশু বলেছে যে তারা আত্মীয়দের সাথে পর্ণগ্রাফি দেখেছে। শতকরা ১৪.৪ জন মেয়েশিশু দেখেছে অনাত্মীয়দের সাথে। শিশুদের এইভাবে পর্ণগ্রাফি দেখার মাধ্যমে তাদের যৌন হয়রানির আশংকা অনেক বেড়ে যায়।
সমাজে সবধরণের অপরাধ বাড়ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন লাগামছাড়া। অপরাধীদের চরিত্র ও সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এদের একটা বড় অংশ শিশু-কিশোর বা তরুণ। যে ব্যবহার পেয়ে তারা বড় হচ্ছে, ঠিক সেই ব্যবহারই তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিচ্ছে ও দিবে। কাজেই শিশুর সাথে সে ব্যবহারই করা উচিৎ, যা আমরা তাদের কাছে ভবিষ্যতে প্রত্যাশা করি।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন