ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার ১৩ বছরের গৃহকর্মী উদ্ধার, উপড়ে ফেলা হয়েছে চার দাঁত, শরীরে পোড়া ক্ষত
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৩ বছর বয়সি এক শিশু গৃহকর্মী।
উপড়ে ফেলা হয়েছে তার চারটি দাঁত। সারা শরীরে দেওয়া হয়েছে আগুনের ছ্যাঁকা। শরীরজুড়ে তার পোড়া ক্ষত।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাতে ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে কল্পনা নামের ওই শিশুকে উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে দিনাত জাহান আদর (২১) নামে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতের মাধ্যমে গতকাল তাকে একদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী কল্পনা হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলা সুজন গ্রামের শহিদ মিয়া ও আফিয়া বেগমের মেয়ে। পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে সে পঞ্চম। সে বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে গ্রেপ্তার দিনাত জাহান আদর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএতে পড়াশোনা করতেন, তবে বর্তমানে পড়াশোনা বন্ধ রয়েছে। তার বাবা-মা ধানমন্ডিতে আলাদা বাসায় থাকেন।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিকের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা বসুন্ধরার আই ব্লকের ৩ নম্বর সড়কের ৪৬৬ নম্বর বাসা থেকে ওই শিশুকে উদ্ধার করে।
ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, "কল্পনার সারা শরীরে পোড়া ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। রাত সোয়া ২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে তাকে ভর্তি করা হয়।'
শনিবার রাতেই গৃহকর্মীর মা আফিয়া বেগম বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন উল্লেখ করে ওসি বলেন, এ মামলায় আদরকে গ্রেপ্তার করে রোববার আদালতে পাঠানো হয়। পরে আদালত একদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।
হাসপাতালে আফিয়া বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, তার মেয়ে কল্পনা গত পাঁচ বছর ধরে মাসে ৫ হাজার টাকা বেতনে ওই বাসায় কাজ করছে। মাঝেমধ্যে মেয়ের সাথে তার কথা হতো গৃহকর্ত্রীর মোবাইলফোনে।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক মো. নাসির উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, 'গৃহকর্মী কল্পনার পুরো শরীরে যে পরিমাণ পোড়া ক্ষত হয়েছে, এটি একদিনের আঘাতে সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ধরে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। শরীরের অনেক স্থানে গভীর ক্ষত রয়েছে। তার সামনের দিকে চারটি দাঁত নেই। অনেক স্থানে ইনফেকশন হয়ে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'তার সেরে উঠতে প্রায় দুই মাস সময় লাগতে পারে। নির্যাতনের কারণে সে কিছুটা মানসিক ট্রমায় রয়েছে।'
ভুক্তভোগী কল্পনা আক্তার জানায়, সবসময় কাজের ভুল ধরে তাকে মারধর করতেন গৃহকর্ত্রী আদর। দুই মাস আগে কাঠের ব্রাশ দিয়ে তার ৪টি দাঁত ভেঙে দেন তিনি। দুই দিন আগে হেয়ার স্ট্রেইটনার গরম করে মুখে ছ্যাঁকা দেন তিনি। চিকিৎসার জন্যও কখনও বাসার বাইরে যেতে দেওয়া হতো না তাকে। একবেলা খাবার খেতে পারত সে।
শনিবার বাসার একটি বিড়ালকে চিকিৎসার জন্য গাড়ি দিয়ে কল্পনাকে চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়। সেখানে ওই চিকিৎসক তার শরীরের জখম দেখে তার বাসার ঠিকানা রেখে দেন। পরে তিনিই সাংবাদিক ও পুলিশের সাহায্য নেন। উদ্ধার হয় কল্পনা।
এদিকে রোববার কল্পনাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে যান জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ । তিনি মেয়েটির চিকিৎসার দায়িত্বও নিয়েছেন।
সাংবাদিকেদের তিনি বলেন, অনেক পরিবার দরিদ্রতার জন্য অন্যের বাসায় কাজ করে। তাই বলে নির্মমতার শিকার হবে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এই মেয়েটিকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। মেরে তার চারটি দাঁত ফেলে দেওয়া হয়েছে। তার শরীরে সব ধরনের আঘাত রয়েছে। কোনো সুস্থ মানুষ এ ধরনের নির্যাতন করতে পারে না।
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমাদের দেশে পাঁচ লাখ শিশু শ্রমিক ও গৃহকর্মী আছে। এই মেয়েটি পাঁচ বছর ধরে একটা পরিবারে কাজ করে। সাড়ে চার বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অথচ কেউ জানেও না। এরকম আরও কত হচ্ছে, অনেকেই তা জানি না।'
তিনি বলেন, এটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন, এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক, এটা বন্ধ করা উচিত।
'আমরা সর্বশেষ গৃহকর্মী নিরাপত্তা আইনের একটা খসড়া প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি। আমরা বারবার বলছি, অতিশিগগির প্রস্তুত করে আইনটি পাস করা দরকার। কারণ পূর্ণাঙ্গ আইনে গৃহকর্মী নির্যাতনের বিষয়টিকে দেখা হয় না। এরকম নিষ্ঠুর আচরণের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' যোগ করেন তিনি।