শিনজো আবের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও বেশি কেন?
সম্প্রতি জাপানের একটি সংবাদপত্রের খবরের শিরোনাম ছিল- 'শিনজো আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়ে বেশি হয় কী করে?'
যদিও ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচের পরিমাণ প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু ডেইলি মিররের এক প্রতিবেদনে তা আনুমানিক ৮ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১.৩ বিলিয়ন ইয়েন ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, জাপানের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় খরচ হতে চলেছে ১.৬৬ বিলিয়ন ইয়েন।
জাপানের অনেকেরই ধারণা, সত্যিকার অর্থে এ ব্যয়ের পরিমাণটা আরও বেশি যা জনগণের কাছ থেকে লুকানো হয়েছে। এই যেমন, টোকিও অলিম্পিকের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ বিলিয়ন ডলার... যা আসল হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ। আবার কারো কারো প্রশ্ন ছিল, দুই রাষ্ট্রের ব্যয়ের মধ্যে এই পার্থক্য হওয়ার কারণ কী সেই প্রতিষ্ঠানগুলো নাকি, যারা রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো বড় ইভেন্টের আয়োজক হিসেবে ছিল।
কিন্তু টোকিওভিত্তিক আয়োজক প্রতিষ্ঠান 'মুরাইয়ামা' যখন জানালো যে তারাই ছিল একমাত্র বিডার- অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজনের জন্য ১৭৬ মিলিয়ন ইয়েনের চুক্তি তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ই পেয়েছে, তখন সাধারণ মানুষের সন্দেহ আরও জোরাল হয়। কারণ একবার শিনজো আবে এই প্রতিষ্ঠানটিকেই একটি বার্ষিক চেরি ব্লসম পার্টি আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যেখানে তার বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছিল।
সম্প্রতি সংবাদ সংস্থা কিয়োডোর একটি পোলে ৭০ শতাংশেরও বেশি জাপানি জানিয়েছেন, তারা মনে করেন শিনজো আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সরকার অনেক বেশি টাকা খরচ করছে। বরাদ্দ অর্থের প্রায় অর্ধেকটাই ব্যয় হয়েছে অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ ব্যয় হবে বিদেশী সফরকারীদের আপ্যায়নে।
মঙ্গলবার শিনজো আবের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে সামনে রেখে বিদেশী অতিথিরা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে সাক্ষাত করতে জাপানে আসতে শুরু করেছেন। তিন দিনব্যাপী এ আয়োজনকে 'ফিউনারেল ডিপ্লোমেসি' নামে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের ২১৭টি দেশ থেকে ৭০০ অতিথি এ অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজি।
কিন্তু জাপানের সাধারণ মানুষ লন্ডনে সদ্য প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন- রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যেখানে বর্তমান বিশ্বনেতারা অংশগ্রহণ করছেন, সেখানে শিনজো আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আগত অতিথিদের বেশিরভাগই সাবেক নেতা।
রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুতে ব্রিটেন কতখানি শোকার্ত, আর সে তুলনায় জাপানের পরিস্থিতিটা কতটা ভিন্ন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
গত ৮ জুলাই জাপানের নারা শহরে এক রাজনৈতিক কর্মসূচির অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় শিনজো আবেকে গুলি করা হয়। চিকিৎসকেরা জানান, শিনজো আবের ঘাড়ে দুটি গুলি লাগে এবং তাঁর হৃদযন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কয়েক ঘণ্টা মৃত্যুর সাথে লড়াই করে অবশেষে হার মানতে হয় জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রীকে। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। শিনজো আবেই জাপানের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী যাকে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মাধ্যমে বিদায় জানানো হবে।
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া দেওয়া হয়েছিল শিগেরু ইয়োশিদাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরপরই জাপানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধোত্তর জাপানের গতিপথ পাল্টে দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রশংসিত তিনি।
এদিকে শিনজো আবের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয়ের পরিমাণ নিয়ে ক্ষুদ্ধ, জাপানের স্থানীয় কয়েকটি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ১৯৬৭ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ব্যয় হয়েছিল মাত্র ১৮ মিলিয়ন ইয়েন, যা বর্তমানের ৭০ মিলিয়ন ইয়েনের সমতুল্য।
গত কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে জাপান। এমতাবস্থায়, সমালোচকদের মতে- রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এত ব্যয় না করে সেই অর্থ নিম্নআয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে বিতরণ করা যেতো।
তাছাড়া, আবের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় এত ব্যয় করার ফলে অসন্তুষ্টি থেকে বর্তমান সরকারের উপরে জাপানিদের ভরসা কমে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিনজো আবের নীতি জাপানকে বিভক্ত করেছিল এবং তার ব্যাপারে জাপানিদের তিক্ততাও সহসা দূর হবে বলে মনে হচ্ছে না।
সূত্র: বিবিসি