চীনের কারখানা ছিনিয়ে নিতে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা ভারতের
ভারতে প্রায় অর্ধেক অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়; আর পরিকল্পনার সময় ব্যয়ের যে প্রক্ষেপণ করা হয় বাস্তবায়নকালে- প্রতি চারটি প্রকল্পের একটিতে বেড়ে যায় সেই ব্যয়। আমলাতান্ত্রিক লালফিতার দৌরাত্ম্য এবং বছরব্যাপী চলা এসব বিপত্তি নিরসনে প্রযুক্তিকেই সমাধান মনে করছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এই বাধা নিরসনে ১৬টি মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে মোদি সরকার, যার নাম দেওয়া হয়েছে 'গতি শক্তি'। অর্থাৎ, দ্রুততাই যেখানে হবে বিকাশের শক্তি। সরকারের নতুন এ ডিজিটাল পোর্টালে প্রকল্পের নকশা জমা দিতে পারবে বিনিয়োগকারী ও বেসরকারি কোম্পানিগুলো। আর অনুমোদন প্রক্রিয়াও হবে মসৃণভাবে। ফলে সহজেই করা যাবে প্রকৃত ব্যয়ের প্রক্ষেপণ।
নয়াদিল্লিতে এক সাক্ষাৎকারে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লজিস্টিক্স বিষয়ক বিশেষ সচিব অমৃত লাল মিনা বলেন, 'সময় ও ব্যয় সীমার মধ্যে রেখে প্রকল্প বাস্তবায়নই আমাদের মিশন। (উন্নত অবকাঠামোর সুবাদে) বৈশ্বিক কোম্পানিগুলো যেন পণ্য প্রস্তুতের জন্য ভারতকে বেছে নেয়– সেটাই মূল লক্ষ্য'।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে চীন নিয়েছে 'শূন্য সহনশীলতার নীতি'। সংক্রমণ বাড়ায় সরকারের নেওয়া লকডাউনের মতো কড়া বিধিনিষেধে দেশটির সাথে বিদেশি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায় ব্যাঘাত ঘটছে। আবার পশ্চিমা কোম্পানিগুলোও ভূরাজনৈতিক কারণে চীন থেকে সরিয়ে নিতে চায় তাদের কারখানা। এখানে মহার্ঘ সুযোগ দেখছে ভারত।
অবকাঠামো প্রকল্প দ্রুততর হলে এ সুবিধা নিতে ভারত সত্যিকার অর্থেই এগিয়ে যাবে। তাছাড়া, অনেক কোম্পানিই নিচ্ছে চায়না প্লাস ওয়ান নীতি। যেখানে চীনে কারখানা রাখার পাশাপাশি অন্য দেশেও কারখানা করছে তারা। এর মাধ্যমে নিজেদের সরবরাহ চক্রে বৈচিত্র্য আনছে তারা। কমাচ্ছে এককভাবে চীন-নির্ভরতা।
এশিয়ার তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে ভারতে আবার রয়েছে সস্তা শ্রমের সুবিধা। রয়েছে ইংরেজিতে দক্ষ বিপুল শিক্ষিত জনসংখ্যা। এত কিছু থাকার পরও অনেক বিনিয়োগকারী ভারতে আসতে চান না অবকাঠামো নিয়ে জন্ম-জন্মান্তরের জটিলতা দূর না হওয়ায়।
বাজেট ছাড়িয়ে যাওয়া
পরিবহন ও অবকাঠামো পরামর্শক সংস্থা কেয়ার্নি ইন্ডিয়ার পার্টনার অংশুমান সিনহা বলেন, "বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে অনেক দেশের কোম্পানি চীন ছাড়ছে; সেকথা বাদ দিলে, চীনের সাথে প্রতিযোগী সক্ষম হওয়ার একমাত্র পথ হলো– উৎপাদন খরচেও যতোটা সম্ভব প্রতিযোগী হয়ে ওঠা। দেশের প্রতিটি অঞ্চলজুড়ে পণ্য প্রবাহ ও উৎপাদিত যন্ত্রাংশ চলাচল সহজতর করার উদ্যোগই হলো– 'গতি শক্তি'।"
এই প্রকল্পের মূল ভিত্তিগুলোর একটি হলো– এমন উৎপাদন কেন্দ্রগুলি চিহ্নিত করা যেসব বর্তমানে নেই, কিন্তু ভবিশ্যতে গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং ওইসব কেন্দ্রকে দেশজুড়ে রেলপথ, নৌবন্দর ও বিমান বন্দরের সাথে সম্পৃক্তকরণ।
অংশুমান বলেন, 'গতি শক্তি উদ্যোগটির মূলে দেখলে বুঝবেন– এটিতে সম্ভাবনা শনাক্তকরণ এবং সে অনুসারে, লজিস্টিকস নেটওয়ার্ক দৃঢ়করণের পরিকল্পনা রয়েছে'।
প্রযুক্তির সাহায্যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য হ্রাস– ভারতের স্থবির অবকাঠামো উদ্যোগগুলিতে প্রতিবন্ধকতা দূর করে প্রাণসঞ্চারের জন্য অপরিহার্য। গতি শক্তি পোর্টালের অধীনে বর্তমানে তদারকি করা হচ্ছে মোট ১,৩০০টি প্রকল্পের; এরমধ্যে ৪০ শতাংশ বাস্তবায়ন পর্যায় পর্যন্ত যেতে দেরি হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণ, বন ও পরিবেশগগত ছাড়পত্র ইত্যাদির জটিলতায়। ফলে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়েছে বলে জানিয়েছে বলে জানান অমৃত লাল মিনা।
অন্যদিকে ৪২২টি প্রকল্পে কিছু সমস্যা ছিল– যার মধ্যে ২০০টির সমাধান করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এ সচিব।
ভারতে বিদেশি বিনিয়োগ প্রসারে জড়িত সরকারি সংস্থার মতে, গতি শক্তি একটি সুপরিকল্পিত কাঠামো। ফলে এর অধীনে নির্মিত কোনো নতুন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে বেছানো হবে না টেলিফোন কেবল বা গ্যাসের পাইপলাইন। এই পরিকল্পনা অনুসরণ করবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের পুনঃনির্মাণ প্রকল্প এবং ১৯৮০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত চীন যে মডেলে অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে সেগুলিকে। চীন এই উদ্যোগের মাধ্যমেই বৈশ্বিক 'প্রতিযোগিতা সূচকে' এগিয়ে যায় বলে জানিয়েছে ইনভেস্ট ইন্ডিয়া নামক সরকারি সংস্থাটি।
গত সপ্তাহে গতি শক্তি কর্মসূচির উদ্বোধনকালে মোদি বলেন, 'আজকের ভারত (অবকাঠামোয়) আরও বিনিয়োগ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; তাই প্রকল্প যেন মাঝপথে বাধাগ্রস্ত হয়ে গতি না হারায়– তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে'।
'মানসম্মত অবকাঠামো বহু ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরুর উদ্দীপক শক্তি, যা বড় পরিসরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। আধুনিক অবকাঠামো ছাড়া ভারতের সার্বিক উন্নয়ন তাই হতেই পারে না' – যোগ করেন তিনি।
নির্দিষ্ট মেয়াদের চেয়েও পিছিয়ে
মহামারি- পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। আন্তর্জাতিক পণ্য ও কাঁচামালের বাজার অস্থিতিশীল। ফলে অবকাঠামো নির্মাণে আমদানির খরচ বাড়ছে। শক্তিশালী মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন হওয়াটাও চাপ সৃষ্টি করছে। এরইমধ্যে বাস্তবায়নের মেয়াদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া, বাজেট ছাড়িয়ে যাওয়া– প্রকল্প দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ব্যাহত করছে বলে জানিয়েছে ভারতের পরিসংখ্যান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত মে নাগাদ ভারতে চলমান ছিল মোট ১,৫৬৮টি প্রকল্প; এর মধ্যে পিছিয়েছে ৭২১টি। অন্যদিকে ৪২৩টির প্রকৃত বাস্তবায়ন ব্যয় বেড়েছে।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারতের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যাপক ব্যয় বাড়িয়েছেন মোদি। নির্মাণকাজে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি এখন করোনা মহামারির ভয়াল সংক্রমণে নাকাল ভারতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চাইছেন। এক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্যও পেয়েছেন তিনি।
অর্থাৎ, আকর্ষণ করতে পারছেন বৈশ্বিক বিনিয়োগকে। যেমন এখন ভারতে আইফোন-১৪ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে অ্যাপল ইনকর্পোরেশন। চীন থেকে পণ্যটি লঞ্চের মাত্র ২ মাস পরেই ভারতের প্রতি এই আস্থা দেখালো দুনিয়ার নামজাদা কোম্পানিটি।
ভারতের উন্নয়নের প্রচেষ্টায় আস্থা রেখে এর আগে ২০১৮ সালেই দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন প্রস্তুতকারক কারখানা খোলে স্যামসাং ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি।
স্থানীয় কোম্পানি- ওলা ইলেকট্রিক মোবিলিটি প্রাইভেট ভারতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈদ্যুতিক স্কুটার প্রস্তুতকারক কারখানা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
উদ্যোক্তাদের আশ্বাস সঞ্চার করতেই যেন দেশটির শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব অমৃত লাল মিনা বলেন, অবকাঠামোর সাথে কোনো শিল্পাঞ্চলের সার্বিক যোগাযোগ সুবিধা নির্মাণে কোথায় কোথায় ঘাটতি রয়েছে– সেসব চিহ্নিত করতে সরকার গতি শক্তি পোর্টাল ব্যবহার করছে।
তিনি বলেন, কয়লা, ইস্পাত ও খাদ্যপণ্য চলাচলের জন্য সরকার বন্দরের সাথে স্থানীয় অবকাঠামোর সংযোগ ঘাটতি দূরীকরণে ১৯৬টি প্রকল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
ভারতের সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সরকারি এই পোর্টাল ব্যবহার করছে ১১টি গ্রিনফিল্ড প্রকল্পের নকশা করতে। প্রকল্পগুলি সরকারের ১০৬ বিলিয়ন ডলারের সুবিশাল ভারতমালা পরিকল্পনার আওতায় বাস্তবায়িত হবে। এর আওতায় ২০২২ বা চলতি বছরের শেষ নাগাদ ৮৩ হাজার ৬৭৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের লক্ষ্য রয়েছে।
অমৃত লাল মিনা বলেন, 'আধুনিক গুদাম নির্মাণ, সরবরাহ প্রক্রিয়ায় আরও ডিজিটাইজেশন, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং লজিস্টিকস খরচ কমানোতেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে পণ্য উৎপাদনের জন্য ভারতকে বেছে নেওয়া– বিশ্বের যেকোনো সংস্থার কাছে হয়ে উঠবে সবচেয়ে প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত'।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ