যুদ্ধবিমান, নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর তৈরিতে চিরশত্রু চীন-রাশিয়ার ওপরই নির্ভরশীল আমেরিকা
রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাপে-নেউলে সম্পর্ক হলেও মজার ব্যাপার হলো, দেশটি নিজেদের আকাশ প্রতিরক্ষার অনেক অস্ত্র-সরঞ্জামের কাঁচামাল এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশের জন্য এ দুই দেশের ওপরই নির্ভর করে। খবর দ্য ইউরেশিয়ান টাইস-এর।
সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, মার্কিন অনেক ফার্ম বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর তৈরিতে রাশিয়ায় তৈরি হাই অ্যাসে লো এনরিচড ইউরেনিয়াম বা হ্যালেউ'র ওপর নির্ভরশীল।
বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট, জৈবজ্বালানি ব্যবহার কমানো ও কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে বিশ্ব যখন উন্মুখ, তখন বেসামরিক ব্যবহারের জন্য ছোট আকারের, সহজে তৈরি করা যায় এমন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের দিকে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো।
এফ-৩৫ ও এসআর-৭১-এর নির্ভরশীলতা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্রবাহিনীর অন্যতম শক্তিশালী যুদ্ধবিমান এফ-৩৫। আর এটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয় চীনে নির্মিত ধাতু।
এর আগে গত সেপ্টেম্বর মাসে এফ-৩৫-এর হানিওয়েল কোম্পানির তৈরি টার্বোমেশিনের একটি চুম্বক চীনের কোবাল্ট ও সামারিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে- এমনটা খুঁজে পাওয়ার পর পেন্টাগন বেশকিছু এফ-৩৫-এর সরবরাহ স্থগিত করেছিল।
এরপর আরও অনুসন্ধানে জানা যায়, চীনা ধাতুতে তৈরি ওই যন্ত্রাংশ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৫টি দেশে থাকা ৮২৫টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের সবগুলোতে রয়েছে। প্রসঙ্গত, টার্বোমেশিন জেট ইঞ্জিনের স্টার্টার বা জেনারেটরকে শক্তি যোগায়।
তারপর অক্টোবর মাসে অনেক মূল্যায়নের পর পেন্টাগন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, চীনে উৎপন্ন ধাতু দিয়ে তৈরি ওই যন্ত্রাংশ কোনো তথ্য সরবরাহ করেনি বা বিমানের কোনো ক্ষতি করেনি। এরপর তারা পুনরায় এফ-৩৫ সরবরাহ শুরু করে।
তবে এ নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার পর চীন সেটাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে। দেশটি মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরল মৃত্তিকা ধাতুর ওপর নির্ভরশীল।
চীনের এ ধরনের ধাতুর প্রাচুর্য রয়েছে। আর এগুলো অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ তৈরিতে বেশ দরকারি। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন বিদেশি বিনিয়োগ দেশে ধরে রাখে। ফলে এসব বিদেশি কোম্পানি চীনের স্থানীয় আইন মেনে অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালাতে যেমন বাধ্য থাকে, তেমনিভাবে স্থানীয় চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও প্রযুক্তিগত বিষয়ে তাদেরকে যৌথভাবে কাজ করতে হয়।
চীনের গণমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস তখন এক প্রতিবেদনে দেশটির একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ধাতু প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারের বরাত দিয়ে জানিয়েছিল, কেবল চীনই কোবাল্ট ও সামারিয়াম ধাতু নিষ্কাশন করতে পারে। অর্থাৎ সামারিয়াম অক্সাইড নামক মধ্যবর্তী উপাদানটি প্রায় শতভাগ চীনের কারখানাগুলোতেই তৈরি হয়।
ইউরেশিয়ান টাইমসের অতীতের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, এর আগেও মার্কিন সামরিক সরঞ্জামে চীনের উপাদান বা যন্ত্রাংশ পাওয়া গিয়েছিল। ২০১৪ সালে জানা যায়, অনেকগুলো লকহিড মার্টিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ও বোয়িং বি-১বি বোমারু বিমানেও চীনা উপাদান ছিল।
শত্রুদেশে তৈরি উপাদানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এমন নির্ভরতা কেবল আধুনিক বিমানগুলোতে নয়, বরং স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার বিখ্যাত এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড স্টেলথ যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রেও ছিল। এ বিমানটির জন্য প্রয়োজনীয় টাইটানিয়াম গোপনে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমদানি করত যুক্তরাষ্ট্র।
তখন টাইটানিয়াম আমদানির জন্য সিআইএ অনেকগুলো শেল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিল। টাইটানিয়ামের চালানগুলো তারা আনত তৃতীয় বিশ্বের দেশের মাধ্যমে।
এসআর-৭১ একটি তীব্রগতির বিমান ছিল। এটি ঘণ্টায় ৩,০০০ কিলোমাটারের বেশি বেগেও ছুটতে পারত। ফলে আকাশে ওড়ার সময় এর এয়ারফ্রেমে প্রচণ্ড তাপমাত্রা ও ঘর্ষণ তৈরি হতো। কেবল টাইটানিয়াম ধাতুর পক্ষে তা সহ্য করে টিকে থাক সম্ভব ছিল।
মার্কিন পারমাণবিক শক্তির জন্য রাশিয়ান ইউরেনিয়াম
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি কোম্পানি রোসাটমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান টেনেক্স কেবল বাণিজ্যিকভাবে হ্যালেউ বিক্রি করে।
মার্কিন ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি'র একজন মুখপাত্র বলেছেন, 'হ্যালেউ'র উৎপাদন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আর এটির উৎপাদন বাড়ানোর সবধরনের প্রচেষ্টা বিবেচনা করা হচ্ছে।'
বেশিরভাগ নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টে যেসব ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হয় সেগুলো ৫ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ (এনরিচড) করা থাকে। আর হ্যালেউ সমৃদ্ধ করা হয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত।
রয়টার্স জানিয়েছে, মার্কিন প্ল্যান্টগুলো আশঙ্কা করছে হ্যালেউ'র নির্ভরযোগ্য উৎস না পেলে তারা তাদের প্ল্যান্টের জন্য অর্ডার পাবে না।
আর মার্কিন পলিসিমেকাররাও জানেন, এ ইউরেনিয়ামের স্থিতিশীল সরবরাহ না পেলে তা পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে যার প্রভাব পড়ব অন্য খাতেও।
এ ধরনের বাণিজ্যিক ও বেসামরিক ব্যবহারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতেমধ্যে তাদের সামরকি ইউরেনিয়ামের দিকে হাত দিতে শুরু করেছে।