‘ম্যানহাটনের ম্যাডফ’ যেভাবে গৌতম আদানির সাম্রাজ্য পতনের সূচনা করতে পারেন
এ যেন দস্তানা ছাড়াই দুই মুষ্টিযোদ্ধার প্রাণপণ লড়াই, যা চলছে ভারতের পুঁজিবাজারে। নিউইয়র্ক-ভিত্তিক হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের সাথে ভারতের বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী- আদানি গ্রুপের এই যুদ্ধ, আরো তীব্রই হচ্ছে। আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলোর বাজারমূল্য জালিয়াতির মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়েছে এমন অভিযোগ বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থাটির। তারা বলেছে, ভারতীয় টাইকুন গৌতম আদানির তত্ত্বাবধানেই ঘটেছে 'কর্পোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি'। এর পাল্টা জবাবে গৌতম আদানি নিউইয়র্ক ভিত্তিক সংস্থাটিকে 'ম্যানহাটনের ম্যাডফ' বলে সমালোচনা করেছেন। আর শর্ট-সেলারের প্রতিবেদনটিকে বলেছেন, 'ভারতের ওপর, ভারতের প্রবৃদ্ধির সাফল্য ও উচ্চাকাঙ্খার ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ'।
এই উক্তির যথার্থতা কতখানি? বার্নি ম্যাডফ ছিলেন ইতিহাসের সেরা এক জালিয়াত। তিনি পঞ্জি স্কিমের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের ৬৫ বিলিয়ন ডলার লুটেছিলেন। এই জালিয়াতির গোমর ফাঁস করেছিলেন বিশ্লেষক হ্যারি মার্কোপোলোস। আর হিন্ডেনবার্গের প্রতিষ্ঠাতা নাথান অ্যান্ডারসন ছিলেন হ্যারির সহকারী। এতেই স্পষ্ট, নাথান আসলে ম্যাডফের মতো জালিয়াতদের বিরোধী শিবিরের। তাই আদানি গ্রুপের প্রতিবাদ বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানাতেও দেরি করেনি হিন্ডেনবার্গ। তারা জানায়, তাদের গবেষণায় উত্থাপিত ৮৮টি প্রশ্নের মধ্যে মাত্র ৬২টির জবাব দিয়েছে আদানি গ্রুপ। এই প্রেক্ষাপটে, শর্ট সেলার সংস্থাটি এবার বিনিয়োগকারীদের– মনোভাব ও অর্থ দুইই নিজের পক্ষে আনতে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে– তা জানা ও বোঝার চেষ্টা করা যেতেই পারে।
পুঁজিবাজারের ভাষায় শর্ট সেলিং হলো একটি কোম্পানির শেয়ারের বিরুদ্ধে বাজি লাগানোরই কৌশল।
হিন্ডেনবার্গ আদানি গ্রুপের শেয়ারের শর্ট পজিশন প্রকাশ করেই সাম্প্রতিক ঘটনার সূত্রপাত করেছে। পুঁজিবাজারে শর্ট পজিশন হলো- স্বল্পমেয়াদে কোনো কোম্পানির শেয়ার কতখানি কমবে তা নির্ধারণের কৌশল। সাধারণত আগামী কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য এটা নিরূপণ করা হয়।
নিউইয়র্কের আর্থিক খাতের সংস্থাগুলির কাছে হিন্ডেনবার্গের বেশ সুনাম রয়েছে। কিন্তু, তার মানেই এশিয়ার বাজারে তারা সহজেই সফল হবে- এমনটা ভাবাও ঠিক না। অতীতে হাই-প্রোফাইল শর্ট সেলারদের আক্রমণের পরও বাজারমূল্য পতন থেকে রক্ষা পাওয়ার নজির রয়েছে এশিয়ার বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর। যেমন চীনের এভারগ্রান্ডে গ্রুপ এবং এইচএনএ গ্রুপের। এই জায়ান্টগুলো কেবল তখনই বাজারমূল্য পতনের শিকার হয়, যখন রাজনৈতিক হাওয়া তাদের প্রতিকূলে বইতে শুরু করে। আর একথা বলাই বাহুল্য, ভারতে ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদধন্য হলো আদানি গ্রুপ। ফলে রাজনৈতিক সমর্থন লাভেও দৃঢ় অবস্থানে।
তবে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের অভিযোগও গুরুতর। তাদের প্রধান অভিযোগ স্টক ম্যানিপুলেশন, বা কোম্পানির শেয়ারমূল্যে কারসাজির। হিন্ডেনবার্গের তথ্যমতে, আদানি গ্রুপের চারটি পুঁজিবাজার নিবন্ধিত অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ৭৫ শতাংশ শেয়ার এই শিল্পগোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণরাই গোপনে নিয়ন্ত্রণ করছেন। একাজ করায় তারা ভারতের সিকিউরিটিজ আইন অনুসারে, বাজার নিবন্ধন হারানোর যোগ্য।
বিনিয়োগকারীদের আদানির মতো বৃহৎ গ্রুপের শেয়ার বিক্রিতে রাজি করাতে শুধুমাত্র এই অভিযোগই যথেষ্ট নয়। যেমন এর আগে হংকং এর বাজারনিবন্ধিত এভারগ্রান্ডের বিরুদ্ধে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল, পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বিক্রি করা যায়- কোম্পানিটির এমন 'ফ্রি ফ্লোট' শেয়ারের সীমিত সরবরাহ এবং অধিকাংশ শেয়ারের 'কনসেন্ট্রেটেড' মালিকানা নিয়ে। যখন কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদসহ ঊর্ধবতন কর্মকর্তাদের কাছে শেয়ার মালিকানা থাকে, সেটা হয় কনসেন্ট্রেটেড শেয়ার, যা তারা পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বিক্রি করতে পারেন না। কিন্তু, এর পরিমাণ বেশি হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ সংস্থাগুলো এভারগ্রান্ডের শেয়ার শর্টসেলেও সুবিধে করতে পারছিল না।
কিন্তু, চীনের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ যখন কঠোর পদক্ষেপ নেন, শুধুমাত্র তখনই দুর্দশা নামে এভারগ্রান্ডের ওপর। এসময় স্থানীয় ব্যাংকগুলোও ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠানটিকে।
এই প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের ওপর হিন্ডেনবার্গের কতোটা প্রভাব রয়েছে, তার ওপর নির্ভর করবে আদানি গ্রুপের ঋণের কোনো চ্যানেল বন্ধ হবে কিনা। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বড় পরিসরের পুঁজি-নির্ভর। পুনঃঅর্থায়ন নাহলে ভালো প্রতিষ্ঠানও মন্দের খাতায় নাম লেখায়। আদানি গ্রুপের পুঁজিবাজার-নিবন্ধিত সাতটি কোম্পানির মধ্যে পাঁচটিরই বর্তমান রেশিও ১ এর নিচে, অর্থাৎ স্বল্প-মেয়াদি দায় মেটানোর মতো যথেষ্ট তারল্য (নগদ অর্থ) নেই তাদের। এই হিসাবে, আদানি গ্রুপের জন্য তাদের দেনা পরিশোধের সক্ষমতা থাকাটাও অতি-গুরুত্বপূর্ণ।
আদানি গ্রুপের ৩০ শতাংশ ঋণই বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া হয়েছে। যেমন ডলার বন্ডে তাদের ঋণ ১০ বিলিয়ন। আর এক্ষেত্রেই হিন্ডেনবার্গের যুক্তি অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, লর্ড অ্যাবেট আন্ড কোং, ব্লাকরক ইনকর্পোরেশন এবং গোল্ডম্যান স্যাকসের মতো বৈশ্বিক সম্পদ ব্যবস্থাপকরা এসব পুঁজি দিয়েছে।
ইতোমধ্যেই আদানি ইলেকট্রিসিটি মুম্বাই লিমিটেড কোম্পানির ডলার বন্ডের দাম আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। আদানি গ্রুপের ক্রেডিট সক্ষমতা নিয়ে বাজারের উদ্বেগকেই তুলে ধরেছে এ ঘটনা।
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আদানি গ্রুপের বন্ড নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ফিচ গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ক্রেডিটসাইটস। তখন থেকেই বন্ডের দাম পড়তে শুরু করে, হিন্ডেনবার্গের প্রতিবেদনের পর এখন তা তীব্র রূপ নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে এভারগ্রান্ডের নাটকীয় পতনের কথা বৈশ্বিক বন্ড ব্যবসায়ীরা বিস্মৃত হননি। তাই আদানি গ্রুপের ক্ষেত্রেও তারা ইতস্তত করতেই পারেন। এরমধ্যেই আদানি পোর্ট ও স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড– গ্রুপের বৃহত্তম বন্ড ইস্যুকারী প্রতিষ্ঠানকে বিবিবি রেটিং দেওয়া হয়েছে, যা বিনিয়োগের সর্বনিম্ন গ্রেড। এখন ক্রেডিট রেটিংস সংস্থাগুলো যদি কোম্পানিটির বন্ডকে নিতান্তই ফেলনা/ অলাভজনক হিসেবে রেটিং দেয় তাহলেই বিপত্তি। কারণ, তারা মনে করতে পারে, বাজারে শেয়ার বিক্রির হিড়িক কোম্পানিটির অর্থায়নের উৎস বন্ধ করে দেবে। চীনের রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের ক্ষেত্রেও তারা এমনটাই করেছিল। এই শঙ্কা থেকেই বন্ড বিক্রি করে পালানো শুরু করতে পারেন বিদেশিরা।
এখন পর্যন্ত আদানি গ্রুপের শর্ট পজিশন নিয়ে যা হচ্ছে তা পুঁজিবাজারেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু, চীনে যেমনটা দেখা গিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই এর প্রভাব ঋণ বাজারেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্রেডিট রেটিং এর মাত্র একটি অবনতি, বা একটি কোম্পানির শেয়ারের মুনাফা মার্জিন নিম্নতর ঘোষিত হলে– উল্টে যাবে সব সমীকরণ। তবে এজন্য হিন্ডেনবার্গকেও আরো প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
শুলি রেন ব্লুমবার্গের এশীয় বাজার বিষয়ক মতামত কলাম লেখক। সাবেক এই ব্যাংকার এর আগে মার্কিন গণমাধ্যম ব্যারনস এর পুঁজিবাজার প্রতিবেদক ছিলেন।