পাকিস্তানের ‘প্রবল ক্ষমতাধর’ সেনাবাহিনী এখন বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে!
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবেই সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তবে সম্প্রতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর থেকে দেশটির আর্মি জেনারেলরা যেন একটু বেকায়দায় পড়ে গিয়েছেন। খবর নিউ ইয়র্ক টাইমসের।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি একদল বিক্ষোভকারী দেশটির আর্মি হেডকোয়ার্টারের গেটে পর্যন্ত হামলা করেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা একজন সিনিয়র আর্মি অফিসারের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের এমন সহিংস প্রতিবাদ যেন অনেকটা অকল্পনীয়। কেননা এতদিন পর্যন্ত দেশটির টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও সেনাবাহিনী ছিল অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দীর্ঘ ৭৫ বছর ধরে দেশটির রাজনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ছিল। যার ফলশ্রুতিতে তিনটি সফল সেনা অভ্যুত্থান ও কয়েক দশকের সেনা শাসনের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তানের জনগণ।
এমনকি জনগণের ভোটে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের সময়ও সেনা কর্মকর্তারাই মূল কলকাঠি নেড়েছেন। নিজেদের পছন্দনীয় রাজনৈতিক নেতাকে ক্ষমতায় থাকতে সহায়তা করেছেন; আর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেই তাকে করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত। তবে খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তিই প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর এ কাজের সমালোচনা করেছেন।
রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যারা অভিযোগ করেছেন, তারা সরাসরি দেশটির সেনাবাহিনী কিংবা শক্তিশালী আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করেননি। বরং অনেকটা পরোক্ষভাবে 'এস্টাবলিশমেন্ট' এর বিপক্ষে আওয়াজ তুলেছেন। কেননা সকলেই জানতেন যে, সরাসরি সেনাবাহিনীকে দায়ী করলে গ্রেপ্তার, দেশত্যাগ কিংবা গুম হয়ে যাওয়ার মতো বাজে পরিস্থিতির স্বীকার হতে পারেন।
তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খানের আবির্ভাব যেন ধীরে ধীরে সব সমীকরণ পাল্টে দিতে থাকে। একসময় দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিতে আনেন সাবেক এ তারকা ক্রিকেটার। দীর্ঘ দুই দশকের রাজনৈতিক জীবনে ধীরে ধীরে জনসাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পান ইমরান খান.
বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় ইমরান খান দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সংস্কার ও দুর্নীতি প্রতিরোধের মতো প্রকট সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেন। এতে করে দেশটিতে বিদ্যমান প্রথাগত রাজনৈতিক ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী এক নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ইমরান খান। কিন্তু তার ক্ষমতা গ্রহণের ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে দেশটির সেনাবাহিনীর নামও বার বার উঠে এসেছে। এমনকি প্রতিপক্ষকে ইমরানের বিরুদ্ধে না যেতে চাপ প্রদান কিংবা গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণেরও অভিযোগ রয়েছে তাদের ওপর।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর সময়ের সাথে সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে ইমরানের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এমনকি সাবেক এ তারকা ক্রিকেটার ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে সংসদে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান।
প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পেছনে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হাত ছিল বলে সেসময় অভিযোগ করেন ইমরান। তিনি তার রাজনৈতিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে আর্মি জেনারেলদের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন।
এরপর গত বছরের নভেম্বরে দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরাবাদে লংমার্চের সময় ইমরান খান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। তাকে 'হত্যাচেষ্টা'র পেছনে সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে তাকে অভিযুক্ত করেন সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পর থেকেই ইমরান খানের বিরুদ্ধে বহু মামলা হতে থাকে। আর গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর নিজের নিরাপত্তাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলাগুলোর জন্য কোর্টে হাজিরা দেওয়া এড়িয়ে চলেন তিনি।
ইমরান খানের কোর্টে হাজিরা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে যেকোনো সময়েই তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল। অন্যদিকে তার দল পিটিআই সমর্থকেরা তীব্র সমালোচনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করার পেছনেও সামরিক বাহিনীকে দায়ী করতে থাকেন।
গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজিরা দিতে গেলে ইমরান খানকে আল কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে ইমরান খানের সমর্থকেরা বিক্ষোভের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর স্থাপনাগুলোতে হামলা করতে থাকেন।
ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীত্ব হারানোর পর থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের ক্ষমতা চলাকালে দেশটিতে রেকর্ড মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়; নিত্য-প্রয়োজনীয় বস্তুর দাম বাড়তে থাকে। অর্থনৈতিক এ টালমাটাল পরিস্থিতি যেন চলমান বিক্ষোভে আরও বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে।
বিক্ষোভ দমনে দেশটির অন্তত দুটি প্রদেশে ইতোমধ্যেই সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। কিছু কিছু স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করছে পুলিশ।
বিক্ষোভ চলমান থাকলে পাকিস্তানজুড়ে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এ অবস্থায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফও অনেকটা বেকায়দায় পড়তে পারেন। একইসাথে সামরিক স্থাপনাগুলোতে হামলার ঘটনায় দেশটির সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হতে পারে। এ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা সেনাবাহিনীর জন্য খুব একটা সহজ হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলেন, "বর্তমান পাকিস্তানের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির ফলাফল খুবই ভয়াবহ। পূর্বে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সংকটে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমানে এমন ভূমিকা পালন করার জন্য দেশে আর কোনো প্রতিষ্ঠানই নেই।"
গতকাল (১০ মে) ইসলামাবাদ পুলিশ লাইনে গঠিত বিশেষ আদালতে ইমরান খানকে তোলা হয়। ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে করা মামলাটিতে সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর আট দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
অন্যদিকে স্থানীয় গণমাধ্যমে রিপোর্ট মতে, ইমরান খান তার বিরুদ্ধে আনা সকল দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। একইসাথে তিনি নিজের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থা পাওয়া রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগেও তার বিরুদ্ধে পৃথক মামলা রয়েছে।
স্থানীয় গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, ইমরান খান গ্রেপ্তারের পর থেকে চলমান বিক্ষোভে অন্তত পাঁচ জন নিহত হয়েছে। শুধু পাঞ্জাব প্রদেশেই প্রায় ১ হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কর্তৃপক্ষ বহু জায়গায় ইন্টারনেট সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে এতসব দমন-পীড়নের মাঝেও বিক্ষোভকারীদের থামানো যাচ্ছে না। ফলে নবনিযুক্ত আর্মি চিফ জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী যেন একটু অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছেন।
কেননা ইমরান খানের প্রতি সেনাবাহিনীর একটা অংশের সমর্থন রয়েছে। এক্ষেত্রে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিপীড়নের মাত্রা বাড়ানো হলে সেনাবাহিনীর ভেতরেই অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। ২০০৭ সালে সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের ক্ষমতা হারানোর মধ্য দিয়ে যেমনটা ঘটেছিল।
ইউনাইটেড ইন্সটিটিউট অফ পিসের সিনিয়র এক্সপার্ট আসফান্দার মীর বলেন, "সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে, বিশেষ করে সিনিয়র জেনারেলদের পক্ষ থেকে আর্মি চিফ জেনারেল মুনিরকে সম্ভবত কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসে ইমরান খানের সাথে সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে।"
তবে পাকিস্তানের নাগরিকদের একটা অংশ এখনো মনে করেন, দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক অবস্থাকে সামাল দিতে সেনাবাহিনীর কার্যকর ভূমিকা পালনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
দেশটির বন্যা থেকে শুরু করে সকল দুর্যোগে সেনাবাহিনী সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছে। একইসাথে তালেবান সংকটসহ দেশটিতে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা রয়েছে।
তবে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ইমরান খান যে আর্মি জেনারেলদের দায়ী করেছেন, সে অভিযোগে জনগণের একটা বিরাট অংশের সমর্থন রয়েছে। এর প্রমাণ মেলে পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের কিছু উপ-নির্বাচনে পিটিআইয়ের জয়ের মধ্যে দিয়ে। এমনকি ইমরান খান আগাম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও দাবি জানিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে ওয়াশিংটনের ব্রুকিংস ইন্সটিটিউটের ফেলো মাধিহা আফজাল বলেন, "ইমরান খানের জনপ্রিয়তার কারণেই তিনি এতদিন পর্যন্ত এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে টিকে আছেন। কিন্তু বর্তমানে এস্টাবলিশমেন্টই সংকটের মুখে আছে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের জন্য ভবিষ্যতে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।"