ভারতবর্ষের গরম সইতে না পেরে আমেরিকা থেকে বরফ আমদানি করেছিল ব্রিটিশরা
১৮ শতকে ভারতবর্ষে আগমনের পর এক বড় ধাক্কা খেয়েছিল ব্রিটিশরা। এ অঞ্চলের ভূমি থেকে বিশেষ প্রতিরোধের মুখে না পড়লেও এখানকার আকাশ ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল না। গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রখর তাপ তাদের জন্য প্রাণান্তকর হয়ে উঠত বলেই ইতিহাসে প্রকাশ।
এ গরম সইতে না পেরে অনেক ব্রিটিশ ওই মৌসুমে পাহাড়ি শহরগুলোতে চলে যেতেন। যারা পারতেন না, তারা অন্য অনেক ব্যবস্থা নিতেন। কেউ কেউ জামাকাপড় একটু ভিজিয়ে পরতেন। উত্তর ভারতের বিভিন্ন নদী থেকে তাদের জন্য বরফ আনা হতো। অবশ্য তার জন্য বিস্তর অর্থও খরচ করা লাগত।
তখন রেফ্রিজারেটরের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু পানি ঠান্ডা রাখার জন্য ব্রিটিশদের নানা উপায় অবলম্বন করার কথা জানা যায়। পানি, ওয়াইন, বিয়ার এসব শীতল রাখার জন্য সেগুলোতো শোরা [লবণজাতীয় পদার্থ] মেশানো হতো। দরজা ও জানালায় ভেজা মাদুর লাগানো থাকত। স্থানীয়ভাবেও বরফ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেছিল ব্রিটিশরা, কিন্তু সে বরফে বালি ভরা থাকত, তাই খাওয়ার জন্য বিশেষ উপযুক্ত ছিল না সেগুলো।
মোগলরা হিমালয়ের বরফ ব্যবহার করত। কিন্তু এর জন্য 'আইস ফিল্ড' যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হতো, আর লাগত প্রচুর শ্রমিক। সেজন্য এই বরফ ব্যবহারে ব্রিটিশদের প্রচুর খরচ পড়ে যেত। আর ছিল হুগলীর বরফ। এ বরফ তৈরি হতো অগভীর গর্তে পানি জমিয়ে। কিন্তু হুগলী বরফে কুচি হতো অনেক। এছাড়া বরফ দ্রুত গলে যেত বলে দূরে কোথাও বয়ে নেওয়া যেত না।
১৮৩০ থেকে ১৮৭০—এই চার দশক ধরে ব্রিটিশ ভারতের প্রাদেশিক শহরগুলোতে বরফ ছিল বিলাসপণ্য। এই বরফ আমদানি করা হতো উত্তর-পূর্ব আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড থেকে। উনিশ শতকে ইন্দো-আমেরিকান বরফ ব্যবসা নিয়ে লেখা ডেভিড ডিকেনসনের 'দ্য নাইন্টিনথ্ সেঞ্চুরি ইন্দো-আমেরিকান আইস ট্রেড' নামক নিবন্ধে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
১৮৩০-এর দশকে বরফ ব্যবসা করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান ফ্রেডেরিক টিউডর। ওই সময় তাকে ডাকা হতো 'আইস কিং' বা বরফরাজা নামে।
বরফ সংগ্রহ সম্পর্কিত এক ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, টিউডরের জন্ম বোস্টনের এক বনেদি পরিবারে। কিন্তু কোনো কাজেই তার কপাল খুলছিল না। এমনকি বরফ ব্যবসাতেও শুরুর দিকে তিনি খুব একটা লাভের মুখ দেখেননি। প্রথমদিকে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের কিছু রাজ্য ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বরফ চালান দিতেন। সেখান থেকে সেই অর্থে তিনি লাভ করতে পারেননি।
এরপর কফি ব্যবসায়ও ঋণখেলাপি হয়ে পড়েন টিউডর। ঋণখেলাপি হিসেবে জেলে যাওয়া থেকে বাঁচতে টিউডর মরিয়া হয়ে এবার ব্রিটিশ ভারতে বরফ ব্যবসায় নামার ঝুঁকি নেন। কলকাতায় বরফ পরিবহনের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এ তার দুই অংশীদার ছিলেন স্যামুয়েল অস্টিন ও উইলিয়াম রজার্স। রজার্স পরবর্তীতে ব্যবসার অংশীদারদের জন্য কলকাতায় বরফের এজেন্ট হিসেবেও কাজ করেন।
লর্ড কর্নওয়ালিস নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পর আমেরিকার বণিকরা ১৭৭৮ সালে ভারতে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু বরফ পরিবহন ও এর ব্যবসা পুরোটাই আলাদা ব্যাপার।
১৮৩৩ সালের কথা। ওই সময় সমুদ্রপথে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগর পাড়ি দিতে মাস চারেক লাগত। কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দশকের দিকে বরফ সংগ্রহের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হওয়ায় এ সমুদ্রপথে বরফ ব্যবসার বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়।
এই সম্ভাবনা সৃষ্টিতে বড় অবদান ছিল টিউডরের সহযোগী নাথানিয়েল জার্ভিস ওয়াইথের। ওয়াইথ দুই ব্লেডযুক্ত ঘোড়ায় টানা বরফ কাটার যন্ত্র আবিষ্কার করেন। যার ফলে স্বল্প সময়ে অনেক বেশি পরিমাণ বরফকে বর্গাকারে কাটা সম্ভব হয়। এতে একদিকে সময় বাঁচে, অন্যদিকে মানুষ ও ঘোড়ার উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
যাতে গলে না যায়, সেজন্য এই বড় আকারের বরফগুলোকে শক্ত করে প্যাকেটজাতও করা যেত। বরফ পরিবহনের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন ওয়াইথ। যেমন, দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় বরফ যাতে কম গলে, সেজন্য তিনি দুই দেয়ালবিশিষ্ট স্টোহাউস ব্যবহার করতেন। এই সংরক্ষণাগারে ব্যবহার করতেন করাতের গুঁড়ো, চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি।
১৮৩৩ সালে প্রথম আইসক্রিমের স্বাদ পান কলকাতাবাসী — ওই আইসক্রিম তৈরি করা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস থেকে আনা বরফ দিয়ে।
১৮৩৩ সালের ১২ মে ১৮০ টন বরফ নিয়ে বোস্টন থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে টাসক্যানি নামক জাহাজ। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার বন্দরে নোঙর করে জাহাজটি। সে সময় ওতে অক্ষত ছিল ১০০ টন বরফ।
কলকাতা বন্দরে বহু মানুষ জড়ো হয় আমদানি করা বরফ দেখার জন্যে। উপস্থিত প্রত্যেকে ওই বিশাল বিশাল সব বরফ দেখে অবাক হয়েছিল।
উৎসুক দর্শকদের একজন দাবি করেন, আমদানি করা ওই বরফ স্পর্শ করে তার হাত পুড়ে গিয়েছিল। এতে অন্যদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। আরেকজন তো জাহাজের ক্যাপ্টেকে জিজ্ঞেসই করে বসেন, আমেরিকায় বরফ গাছে ধরে কি না।
অল্পদিনের মধ্যেই ফুলে-ফেঁপে ওঠে ভারতে আমেরিকান বরফের ব্যবসা। ওই সময়ে যেসব বরফ পাওয়া যেত, সেগুলোর তুলনায় আমেরিকা থেকে আমদানি করা বরফ অনেক বেশি অক্ষত থাকত।
উচ্চ অক্ষাংশ ও আটলান্টিকের পূর্ব তীরে অবস্থিত ম্যাসাচুসেটসেরর মিঠাপানির হ্রদগুলোতে প্রচুর পরিমাণে বরফ উৎপন্ন হতো। যেমন ওয়েনহ্যাম লেকের বরফের বিশুদ্ধতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন মাইকেল ফ্যারাডের মতো বিজ্ঞানীরাও। এ বরফ যেত ইংল্যান্ডে। ফ্যারাডে আবিষ্কার করেন, বাতাসের বুদবুদ ও লবণ থাকত বলে এই বরফ দ্রুত গলত না।
পরের তিন দশকে কলকাতা ও অন্যান্য প্রেসিডেন্সি শহরগুলো টিউডরের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে ওঠে। এই শহরগুলোতে ব্যবসা করে অকল্পনীয় লাভ করেন তিনি। চোখের পলকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন।
ওয়ালডেন পন্ড থেকে বরফ সংগ্রহের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন প্রখ্যাত মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক হেনরি ডেভিড থরো। তিনি ১৮৫৪ সালে লিখেছেন, 'নিউ অরলিন্স, চার্লসটন, মাদ্রাজ, বোম্বে ও কলকাতার ঘর্মাক্ত বাসিন্দারা আমার কূপের পানি পান করে।'
ওয়ালডেন পন্ড থেকে আসা বরফ যেত অভিজাত অ্যাংলো সমাজে। এর বিনিময়ে টিউডর ব্রিটিশদের কাছে থেকে অনেক সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নেন। বরফ এজেন্ট উইলিয়াম রজার্সকে কাস্টমস হাউসের আনুষ্ঠানিকতা কিংবা নিয়মনীতির জন্য বরফ নিয়ে বন্দরে আটকে থাকতে হতো না। আমদানি করা বরফের চালান তিনি সোজা গুদামে তোলার অনুমতি পেয়েছিলেন। এছাড়া তিনি রাতে বরফ নামানোর অনুমতিও পান। পাশাপাশি তইনি নিজের পছন্দমতো জায়গায় জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ পান। পান শুল্কমুক্ত সুবিধাও।
পরের কয়েক বছরে বরফ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে বরফঘর নির্মাণ করে তা নামমাত্র ভাড়ায় টিউডরের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। টিউডরের নিজের অর্থায়নে তার দ্বিতীয় সমুদ্রযাত্রা চরম ব্যর্থ হতে পারত। কারণ এই যাত্রায় ৩৫০ ব্যারেল আপেলের সবই পচে যায়। কিন্তু কলকাতাস্থ আমেরিকান আইস কমিটি ও গভর্নর লর্ড বেন্টিঙ্কের অপ্রত্যাশিত বদান্যতায় সে যাত্রায় টিউডর রক্ষা পেয়ে যান।
এরপর বরফ ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন টিউডর। বরফের পাশাপাশি নিউ ইংল্যান্ডের আপেল, স্প্যানিশ আঙুর ও আমেরিকান মাখন পরিবহনও অচিরেই ব্যয়বহুল ও ব্যবসার জন্যে লোভনীয় পণ্যে পরিণত হয়। এছাড়া বরফঘরেরও সম্প্রসারণ করা হয় সম্পূর্ণ সরকারি খরচে।
বোম্বেতে জাহাঙ্গীর নুসেরভানজি ওয়াদিয়া-র প্রতিষ্ঠান বরফ বিক্রি শুরু করে। আর ডিনার পার্টিতে আইসক্রিম সরবরাহ শুরু করেন জামশেদজি জিজিভয়। প্রথম পার্টিতে আইসক্রিম খেয়ে অতিথিদের কয়েকজন সর্দিতে আক্রান্ত হলে গুজরাটি পত্রিকা 'বম্বে সমাচার' একে উপযুক্ত মূল্য বলে উল্লেখ করে। কলকাতায় দ্বারকানাথ ঠাকুরও বরফ পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু টিউডরের একচ্ছত্র আধিপত্য আরও কয়েক দশক বজায় থাকে।
১৮৫৬ ও ১৮৮৩ সালে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ায় যথাক্রমে ৩৫৩ ও ৪৫০ টন বরফ পাঠানো হয়। এসব বরফের কিছু কিছু প্রেসিডেন্সি শহরগুলোর মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে সংরক্ষণ করা হতো। যেসব বছরে সরবরাহ কম থাকত, ওই সময় বরফ রেশন করা হতো।
আশ্চর্য শোনালেও, বরফের চাহিদা বাড়ার পর গতানুগতিক বরফশিল্পের পতন ঘটতে থাকে। কারণ বেশি চাহিদার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে মানুষ কৃত্রিমভাবে বরফ সংরক্ষণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে।