আন্দোলনকারীদের পানির বোতল দিচ্ছিলেন, কিছুক্ষণ পরই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন
২৫ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মীর মাহফুজুর রহমান, যিনি মুগ্ধ নামেও পরিচিত, ঢাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন।
প্রাথমিকভাবে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের লক্ষ্যে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
১৮ জুলাই ঢাকায় ধারণকৃত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আন্দোলনকারীদের হাতে পানির বোতল তুলে দিচ্ছেন মুগ্ধ। ১৫ মিনিট পর মাথায় গুলি লাগে তার, তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান বন্ধু ও সহযোদ্ধারা। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তার যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ সিএনএনকে বলেন, "আমি শুধু তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিলাম।"
মুগ্ধর মৃত্যুর ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পরার পর তা আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং বিক্ষোভে যোগ দিতে আরও বেশি লোককে সংগঠিত করে। অস্থিরতা একটি সহিংস ক্র্যাকডাউনের দিকে পরিচালিত করে, যার ফলে কমপক্ষে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়।
ঢাকার একটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে কর্মরত ২৩ বছর বয়সী আন্দোলনকারী ফারাহ পোরশিয়া বলেন, "হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকে এবং সবাই নীরব ছিল। আমাদের নিজেদের জন্য এবং গণতন্ত্রের জন্য দাঁড়াতে হয়েছিল।"
ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মধ্যেই ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন এবং তার বাসভবনের দিকে বিশাল জনতা মিছিল এগিয়ে আসার সময়ে তিনি হেলিকপ্টারে ভারতে পালিয়ে যান।
পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকায় ফিরে আসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন।
পোরশিয়া বলেন, "আমরা যে কী পরিমাণ শক্তি ধারণ করি তা বুঝতে পেরে আমি বিস্মিত। কারণ বহু বছর ধরে আমরা আমাদের ক্ষমতা অনুধাবন করতে পারিনি।"
ন্যায়বিচার চান নিহতদের পরিবারের সদস্যরা
গত মাসের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এখন কিছুটা শান্ত হওয়ার পর অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর বিচার চাইছে।
জন্ম থেকেই অভিন্ন যমজ মুগ্ধ ও স্নিগ্ধ সবসময় একসাথে থাকতো – খাওয়া, ঘুমানো এবং পড়াশোনা সব একসাথে করতো, এমনকি একই পোশাক পরা থেকে শুরু করে এবং নিজেদের গোপন কথা একজন আরেকজনকে বলতেন।
স্নিগ্ধ বলেন, "সে শুধু আমার ভাই নয়, সে আমার সেরা বন্ধু, আমার শরীরের একটি অংশ। আমরা সবকিছু একসাথে করতাম।"
গণিতে স্নাতক মুগ্ধ এমবিএর জন্য পড়াশোনা করছিলেন, আর স্নিগ্ধ আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যমজ ভাইয়েরা এই শরতে ইতালিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল– সেখানে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া এবং মোটরবাইকে চড়ে ইউরোপ ঘোরার স্বপ্ন ছিল। তাদের যাত্রার খরচ যোগাতে তারা অনলাইন ফ্রিল্যান্সার হাব ফাইভারে সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং করছিলেন।
এখন স্নিগ্ধ এবং তাদের বড় ভাই দীপ্ত– মির মাহমুদুর রহমান– মুগ্ধকে ছাড়া নতুন এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েছেন।
তারা মুগ্ধর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রটি এখনও রেখে দিয়েছেন, যেটি তার গলায় ঝুলানো ছিল মৃত্যুর সময়। মুগ্ধর রক্তের দাগ শুকিয়ে সেটি এখন সেই অন্ধকার দিনের একটি প্রতীক হয়ে আছে।
এখন তারা আন্দোলনে মুগ্ধ যে অবদান রেখেছেন, তা ভেবেই কিছুটা শান্তি পাচ্ছেন।
স্নিগ্ধ বলেন, "তার কারণে মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পেয়েছিল। সে (মুগ্ধ) সবসময় বলতো, 'একদিন আমি আমার বাবা-মাকে গর্বিত করব।' সেই মুহূর্তটি এসে গেছে।"
মুগ্ধর মৃত্যুর দুই দিন আগে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ২৫ বছর বয়সী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু। তার মৃত্যুর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ১২-গেজ শটগান দিয়ে আবু সাঈদের "ইচ্ছাকৃত ও অপ্ররোচিত হামলা" চালানোর অভিযোগ আনে এবং কর্তৃপক্ষকে "অবৈধ বলপ্রয়োগের" জন্য নিন্দা জানায়।
সিএনএন পুলিশের মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও কোনো মন্তব্য পায়নি।
আবু সাঈদ এবং মুগ্ধর মর্মান্তিক মৃত্যু শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে মূলধারায় নিয়ে আসে।
পোরশিয়া বলেন, "সবাই রাস্তায় নেমে এসেছিল। বর্ণ, ধর্ম, জাতি, বয়স নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশার মানুষ, শিক্ষার্থী, এমনকি শিশুদেরকেও রাস্তায় দেখা গিয়েছিল।"
গত কয়েক সপ্তাহের সংঘর্ষে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে, যাদের মধ্যে ইউনিসেফের মতে অন্তত ৩২ জন শিশু ছিল।
ঢাকার কেন্দ্রস্থলে টিন ও কাদামাটি দিয়ে তৈরি একটি ছোট কুটিরে থাকতেন ১৩ বছর বয়সী মুবারক। আন্দোলনে মৃত্যু হয় তার। মুবারকের বাবা-মা এখনও তাদের ছেলের সাথে কী ঘটেছিল, তা বোঝার চেষ্টা করছেন।
তার মা ফরিদা বেগম মোবাইলে মুবারকের টিকটক ভিডিও দেখতে দেখতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এটি এখন তার কাছে ছেলের একমাত্র স্মৃতি।
চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মুবারকই একমাত্র বাড়িতে থাকত, প্রায়ই তাদের গরুগুলোর যত্ন নিত যাতে তার বাবা-মা দুধ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন।
মোবারকের বাবা মো. রমজান আলী বলেন, "ও খুবই হাসিখুশি ছেলে ছিল। ওকে কোনো কাজ দিলে কখনোই সে না বলত না, হাসি মুখে তা করত। ও মাঝে মাঝে একটু দুষ্টামিও করত।"
মুবারক ১৯ জুলাই তার বন্ধুদের সাথে বাইরে খেলছিল। তখন কৌতূহলী এই কিশোর তাদের বাড়ির কাছ থেকে সামান্য দূরে ঢাকার কেন্দ্রে চলমান আন্দোলন দেখার জন্য যায়।
পরবর্তীতে তার বাবা-মা হাসপাতালে থেকে ফোন পেয়ে জানতে পারেন, তাদের ছেলেকে গুলি করা হয়েছে।
স্ত্রী ফরিদাকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে রমজান আলী বলেন, "আমার ছেলে এই আন্দোলনের জন্য শহীদ হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আমি আগে এই কোটা আন্দোলন বুঝতে পারিনি, আমরা অশিক্ষিত। কিন্তু পরে আমি যা বুঝেছি তা হলো, এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের জন্য নয়, এটি গোটা বাংলাদেশের জন্য।"