ইঁদুরের ত্বক স্বচ্ছ করার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার: এইচ. জি. ওয়েলসের উপন্যাস এখন ‘বাস্তব’
যুক্তরাষ্ট্রে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা একটি চমকপ্রদ আবিষ্কার করেছেন। তারা দেখতে পেয়েছেন যে, ইঁদুরের ত্বকে একটি বিশেষ খাদ্য রং প্রবেশ করালে তার ত্বক স্বচ্ছ হয়ে যায় এবং অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্রম ও গঠন পর্যবেক্ষণ করা যায়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি ও ছোট গল্পের জন্য পরিচিত ইংরেজ লেখক এইচ.জি. ওয়েলস ১৮৯৭ সালে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন 'দ্য ইনভিজিবল ম্যান'। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র এমন একটি সিরাম উদ্ভাবন করেছিলেন যার ব্যবহারে শরীরের কোষগুলো আলোর প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে।
সেই কাল্পনিক উপন্যাসই যেন বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে। উপন্যাস লেখার ১০০ বছর পর বিজ্ঞানীরাই এমন একটি উপাদান আবিষ্কার করেছেন। গত বৃহস্পতিবার 'সায়েন্স' নামে একটি জার্নালে এমনই একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ওই রংটি ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুরের অঙ্গপ্রতঙ্গগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা যায়।
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু সেসব পদ্ধতি প্রায়শই শুধু বায়োপসি বা মৃত্যুর পর প্রাণীর শরীরে প্রয়োগ করা যায়। জীবিত অবস্থায় কোনো প্রাণীর অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ দেখা গেলে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জীববৈজ্ঞানিক কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে পারবেন এবং গবেষণায় আরও অগ্রগতি আনতে পারবেন। একইসঙ্গে, এটি একটি মানবিক উপায় হতে পারে যা প্রাণীদের কষ্ট বা মৃত্যুর ঝুঁকি ছাড়াই গবেষণা করার সুযোগ দেবে।
কোনো জীবন্ত প্রাণীর ত্বকের মধ্য দিয়ে খালি চোখে কিছু দেখা সম্ভব নয়। কারণ ত্বকের প্রোটিন ও চর্বি-ভিত্তিক উপাদানগুলোর কারণে ত্বক আলোকে বিচ্ছুরিত করে। যার কারণে ত্বক কার্যত অস্বচ্ছ থাকে। তবে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা টারট্রাজিন নামে পরিচিত একটি খাদ্য রং (যা এফডি এন্ড সি ইয়েলো ৫ নামেও পরিচিত) আবিষ্কার করেছেন। এ রং আলোর বিচ্ছুরণ প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক জিহাও ওউ এ গবেষণার প্রধান লেখক। তিনি গবেষণায় বলেন, "যারা এ গবেষণার পেছনের মৌলিক পদার্থবিদ্যা বোঝেন তাদের জন্য এটি যৌক্তিক। কিন্তু যারা এর সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের কাছে এটি জাদুর মতো।"
গবেষণায় দেখা গেছে, এই রং বিশেষভাবে অতি বেগুনি রশ্মি এবং নীল আলোর তরঙ্গ শোষণ করে। এর ফলে লাল এবং কমলা রঙের আলো ইঁদুরের টিস্যুর গভীরে প্রবেশ করতে পারে। এটি ইঁদুরের ত্বককে স্বচ্ছ করে তোলে এবং রংটি ধুয়ে ফেললেই এই প্রভাব সহজেই চলে যায়।
গবেষকরা ইঁদুরের পেটে এই রং প্রয়োগ করে ইঁদুরের অন্ত্রের গতিপ্রকৃতি দেখতে পেয়েছেন। এটি প্রয়োগ করার কারণে ফ্লুরোসেন্ট মার্কার দিয়ে ট্যাগ করা নিউরনগুলোকে বাস্তব সময়ে কাজ করতে দেখা গেছে। এই পদ্ধতি ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোমের (আইবিএস) মতো হজমজনিত সমস্যাগুলো বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া, তারা ইঁদুরের মাথার খুলিতে রং প্রয়োগ করে মস্তিষ্কের রক্তনালীগুলোর কার্যক্রম এবং ইঁদুরের পেছনের পায়ে প্রয়োগ করে পেশীগুলোর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেছেন।
গবেষকরা তাদের এই আবিষ্কার সম্পর্কে লিখেছেন, "আমাদের এ পদ্ধতি অস্ত্রোপচার ছাড়াই গভীরতর টিস্যু এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন, কার্যকলাপ এবং কার্যক্রম দেখতে সহায়ক হতে পারে।"
এ আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের গবেষণার স্বার্থে আরো বিভিন্ন প্রাণীর ওপর এটি প্রয়োগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণাটি সম্পর্কে ক্রিস্টোফার জে. রোল্যান্ডস এবং জন গোরেস্কি লিখেছেন, জেব্রা ফিশ এবং নিমাটোড প্রায়ই গবেষণার জন্য বাছাই করা হয়। কারণ তাদের ত্বক স্বচ্ছ হওয়া শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়াগুলো দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। তবে নতুন এ রং ভিত্তিক পদ্ধতি সাময়িকভাবে প্রাণীর ত্বককে স্বচ্ছ করে দেওয়ার কারণে প্রাণীগুলোর অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীদের বড় সুযোগ করে দিতে পারে।
তাদের লেখায় রোল্যান্ডস এবং গোরেস্কি এই আবিষ্কারের তাৎপর্যও তুলে ধরেছেন। তারা লিখেছেন, "এ ফলাফলের ভিত্তিতে অনুমান করা যায় যে, প্রাণী দেহে যথাযথ রঙের প্রবেশ নিশ্চিত করা গেলে ১০ গুণ বেশি গভীর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এর ফলে একটি ইঁদুরের পুরো মস্তিষ্কে মাল্টিফোটন ইমেজিং করা কিংবা অপটিক্যাল কোহেরেন্স টোমোগ্রাফি ক্যাথেটারের মাধ্যমে সেন্টিমিটার-ঘন টিস্যুর নিচে অথবা রক্তনালীগুলোর চারপাশে টিউমার আছে কিনা তা নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে।"