বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবিধান কোনটি?
সংবিধান একটি জাতি, রাষ্ট্র বা সামাজিক গোষ্ঠীর মৌলিক ধারণা ও বিধিবিধান। এটি সরকারের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করে এবং এর মধ্যে বসবাসরত জনগণের অধিকার নিশ্চিত করে। তাই মানুষের জীবনমান যতো উন্নত হয়েছে তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে ফেরাতে সংবিধান প্রবর্তিত হয়েছে। তবে সংবিধান প্রবর্তনের ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি নতুন নয়। ১৬০০ সালে সান ম্যারিনোতে সর্বপ্রথম সংবিধান প্রবর্তন করা হয়। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে এমনই সংবিধানের প্রবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে রাজতন্ত্র থেকে পরিবর্তিত হয়ে গণতন্ত্র কিংবা নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতেই সংবিধানের বেশি প্রয়োগ দেখা গেছে। তারাই কিছু প্রতিচ্ছবি দেখা গেছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ১০ সংবিধানে। চলুন জেনে আসি সেই ১০ সংবিধান সম্পর্কে।
১. রিপাবলিক অব সান ম্যারিনো (৮ অক্টোবর ১৬০০)
বিশ্বের সবচেয়ে পুরানো সংবিধান হচ্ছে রিপাবলিক অব স্যান ম্যারিনোর। এটি ১৬০০ সালের ৮ অক্টোবর থেকে কার্যকর আছে। এটি '১৬০০ সালের স্ট্যাটিউটস' নামে পরিচিত। এর ছয়টি অধ্যায় রয়েছে। মধ্যে
সান মারিনো রিপাবলিকের বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবিধান রয়েছে, যা ৮ অক্টোবর ১৬০০ সালে কার্যকর হয়। এটি "১৬০০ সালের স্ট্যাটিউটস" নামে পরিচিত ছয়টি ল্যাটিন পাঠের একটি সংকলন। এর আগে ১৩০০ সালে কাছাকাছি সময় থেকে ব্যবহৃত স্ট্যাটুটি কমুনালির (টাউন স্ট্যাটিউটস) পরিবর্তে নতুন সংবিধানটি ব্যবহৃত হতে থাকে।
২. ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা (২১ জুন ১৭৮৮)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবিধানগুলোর মধ্যে একটি। এতে সাতটি ধারা, একটি প্রস্তাবনা এবং একটি উপসংহার রয়েছে। এই চুক্তিটি জুন ১৭৮৮ সালে অনুমোদিত হয় এবং ১৭৮৯ সাল থেকে কার্যকর হয়। জেমস ম্যাডিসন ভার্জিনিয়া সংবিধান তৈরি করতে সহায়তা করেছিলেন। তাই তাকে 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের জনক' নামে অভিহিত করা হয়।
৩. পোল্যান্ড (১৭৯১)
১৭৯১ সালের ৩মে পোল্যান্ডের সংবিধান গঠন করা হয়। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় পুরোনো এবং ইউরোপের সবচেয়ে পুরোনো সংবিধান হিসেবে ধরা হয়। ১৭৯১ সালের সংবিধানের লক্ষ্য ছিল একটি সফল সাংবিধানিক মোনার্কি গঠন করা। এ সংবিধানে নির্বাহী, আইনসভার এবং বিচার বিভাগীয় কাজের স্পষ্ট বিভাজন ছিল। পরবর্তীতে ১৭৯১ সালের সংবিধান থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯৯৭ সালে নতুন সংবিধান গঠিত হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালে সংবিধানটি সংশোধিত হয়।
৪. নরওয়ের সংবিধান (১৭ মে ১৮১৪)
নরওয়ে সংবিধান গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে নরওয়ে নিজস্ব সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ৪৩৪ বছরের ডেনিশ-নরওয়েজিয়ান রাজতন্ত্রের পতনের পর প্রণয়ন করা হয়েছে। এই সংবিধানের আদর্শগুলোর মধ্যে জনগণের সার্বভৌমত্ব, মানবাধিকার এবং ক্ষমতার বিভাজন অন্তর্ভুক্ত।
৫. নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসের সংবিধান প্রায় ১৮১৪ বা ১৮১৫ সালের কাছাকাছি সময়ে রচনা করা হয়। এটি অসংখ্য বার সংশোধন করা হয়। প্রথম উল্লেখযোগ্য সংশোধন করা হয় ১৮৪৮ সালে। এসময় সংশোধনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান ডাচ সংবিধান ১৯৮৩ সালে প্রবর্তন করা হয়। এই সংবিধান, অন্যান্য সংবিধানের মতো, ডাচ সরকারের নিয়মাবলি এবং জনগণের মৌলিক অধিকারগুলোকে সমন্বয় করা হয়েছে। ডাচ সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গোপনীয়তার অধিকার, ভোট দেওয়া ও নির্বাচনে দাঁড়ানোর অধিকার এবং সমান আচরণের অধিকারের মতো বিভিন্ন অধিকারের কথা লেখা আছে।
৬. বেলজিয়াম (৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৩১)
১৮৩১ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি বেলজিয়ামের জাতীয় কংগ্রেস বেলজিয়ান সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৯৩ সালের ১৪ জুলাই সংবিধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন গৃহীত হয়। এই সংশোধন বেলজিয়ামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থেকে ফেডারেল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে।
৭. লুক্সেমবার্গ (১২ অক্টোবর ১৮৪১)
লুক্সেমবার্গ একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছর পর ১৮৪১ সালে প্রথম সংবিধান লেখা হয়। বর্তমান সংবিধান ১৮৬৮ সালে গৃহীত হয় এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়। লুক্সেমবার্গের সংবিধানে ১২১টি ধারা রয়েছে যা ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। এই সংবিধানে রাষ্ট্রের গঠনমূলক ভিত্তি, ব্যক্তিদের অধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা এবং ক্ষমতার কাঠামো সম্পর্কে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।
১৮৪১ সাল থেকে লুক্সেমবার্গের সংবিধান একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। তবে ১৯১৯ সালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনটি করা হয়। এ সংশোধনের মাধ্যমে ২১ বছর বয়সী ভোটার নাগরিকদের ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালে সংশোধন করে এ বয়সী কমিয়ে ১৮ করা হয়। এর আগে, শমাত্র ২৫ বছরের বেশি বয়সী এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ কর প্রদানকারী পুরুষরা ভোট দেওয়ার যোগ্য ছিলেন।
৮. সুইজারল্যান্ড (১২ সেপ্টেম্বর ১৮৪৮)
১৮৪৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সুইস ফেডারেল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুইস ফেডারেল সংবিধান লিখিত হয়। এ সংবিধানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান এবং ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতির শক্তিশালী প্রভাব ছিল। এ সুইস ফেডারেল সংবিধানের খসড়া তৈরির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি দ্বিকক্ষীয় সমাবেশ যা একটি ফেডারেল বডি, ন্যাশনাল কাউন্সিল এবং কাউন্সিল অফ স্টেটসের সমন্বয়ে গঠিত।
এছাড়াও, সুইস ফেডারেল সংবিধান নাগরিকদের জন্য মৌলিক ব্যক্তিগত অধিকার, একটি ফেডারেল সরকার, এবং একটি ফেডারেল বিচারক আদালত প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৪৮ সালের এই সংবিধান ১৮৭৪ সালে সংশোধিত হয়। ১৮ এপ্রিল, ১৯৯৯ তারিখে বর্তমান সুইস ফেডারেল সংবিধান অনুমোদিত হয়, যা ১৮৭৪ সালের সংবিধানের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে।
৯. ডেনমার্কের সংবিধান (৫ জুন ১৮৪৯)
ডেনিশ সংবিধান ১৮৪৯ সালের ৫ জুনে কার্যকর হয়। ডেনমার্ক একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংবিধান ডেনিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে এবং নাগরিকদের অধিকার ব্যাখ্যা করে। এর মধ্যে ধর্মের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও অন্তর্ভুক্ত আছে। দেশের বাধ্যতামূলক সামরিক দায়িত্বের জন্য এখানে একটি অংশ নির্ধারিত আছে।
১০. কানাডা (১ জুলাই ১৮৬৭)
১৮৬৭ সালের সংবিধান আইন অনুসারে কানাডার সংবিধান প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে কানাডা এখনও যুক্তরাজ্যের রাজতন্ত্রের অধীনে আছে।
১৮৬৭ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত, যুক্তরাজ্য তাত্ত্বিকভাবে কানাডার সংবিধানে যেকোনো সময় পরিবর্তন করতে পারে। তবে ১৯৮২ সালে সংবিধান আইনত গৃহীত হওয়ার পর সংবিধানে পরিবর্তন শুধু কানাডাতেই করা যেতে পারে।
অনুবাদ: সাদিয়া আফরিন রেনেসাঁ