ভারী বৃষ্টিপাতে সাহারা মরুভূমিও সবুজ হতে শুরু করেছে!
বিশ্বের অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাহারা মরুভমি এখন সবুজে পরিণত হচ্ছে। প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণের সেখানে উদ্ভিদ জন্মাচ্ছে। কিন্তু এর আগে অঞ্চলটি ছিল একদম শুকনো ও নিষ্প্রাণ।
সম্প্রতি নাসার প্রকাশিত স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা যাচ্ছে, উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার বড় একটি অংশে গত ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর এক্সট্রাট্রপিকাল সাইক্লোনের ফলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর ফলে সাহারা মরুভূমির বিভিন্ন স্থানে উদ্ভিদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং লিবিয়ায় সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না। নাসার আর্থ অবজারভেটরির তথ্য অনুযায়ী, সেখানকার বৃক্ষহীন ভূমিগুলোতে এখন সবুজের ছাপ দেখা যাচ্ছে।
কলাম্বিয়া ক্লাইমেট স্কুলের ক্লাইমেট ভ্যারিয়েবিলিটি গবেষক সিলভিয়া ট্রাসকা এবিসি নিউজকে বলেন, সাহারা মরুভূমির নিম্নাঞ্চল- যেমন নদীর পাড়গুলোতে ঝোপঝাড় এবং গাছের বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে, সাহারায় প্রবল বৃষ্টিপাত হলে উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগম একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আফ্রিকার এই অংশে খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয তখন উদ্ভিদজগৎ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখায় বলে জানিয়েছেন উডস হোল ওশেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের প্রেসিডেন্ট এবং পরিচালক পিটার ডে মেনোকাল।
তিনি বলেন, "যখন খুবই ব্যতিক্রমী বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে, তখন বালিয়াড়িগুলো অল্প সময়ের মধ্যেই সবুজ এবং ফুলের ক্ষেত্র হয়ে যায়, যেখানে উদ্ভিদগুলো দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
এই অঞ্চল একসময় স্থায়ীভাবে সবুজে ঘেরা ছিল। পিটার ডে মেনোকালের ২০১২ সালের একটি গবেষণাপত্র অনুযায়ী, ১১,০০০ থেকে ৫,০০০ বছর আগে সাহারা মরুভূমি উদ্ভিদ ও হ্রদে পরিপূর্ণ ছিল।
সিলভিয়া ট্রাসকা বলেন, "এটি এখন মরুভূমির মতো দেখায়, কিন্তু যখন বৃষ্টি আসে, তখন সবকিছু খুব দ্রুত সবুজ হয়ে ওঠে।"
নাসার এক বিবৃতিতে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সায়েন্স ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মোশে আরমন বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে সাধারণত শূন্য থাকা হ্রদগুলোও এখন ভরতে শুরু করেছে।
আরমন ও তার সহকর্মীদের পরিচালিত গবেষণা অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে আলজেরিয়ার কেন্দ্রস্থলের একটি লবণাক্ত সমতল হৃদ সেবখা এল মেলাহ মাত্র ছয়বার পূর্ণ হয়েছে।
নাসার প্রাথমিক স্যাটেলাইট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছু কিছু এলাকায় আধা ফুটেরও বেশি হয়েছে। সাহারার কিছু অংশে প্রতি বছর মাত্র কয়েক ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়।
পিটার ডে মেনোকাল বলেন, পশ্চিম আফ্রিকার মনসুন মৌসুমের কারণে প্রতি গ্রীষ্মে কিছু পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়া স্বাভাবিক, তবে ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোন বা ক্রান্তীয় বৃষ্টিপাত প্রবণ অঞ্চল সাহারার এত উত্তরে পৌঁছানো অস্বাভাবিক।
নাসার মতে, ঝড়ের গতিপথের উত্তরমুখী সরে যাওয়া একটি বিকাশমান সিস্টেমকে সাহায্য করছে। এটি কিছু এলাকায় কয়েক দিনের মধ্যেই এক বছরের সমান বৃষ্টিপাত ঘটিয়েছে। নাসার তথ্যমতে, এই সিস্টেমটি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপরে গঠিত হয়েছিল এবং দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল, যার ফলে নিরক্ষীয় আফ্রিকা থেকে আর্দ্রতা টেনে নিয়ে উত্তর সাহারায় পৌঁছে দিচ্ছে।
ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ক্লাইমেট প্রেডিকশন সেন্টারের মতে, জুলাইয়ের মাঝামাঝি থেকে ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোন দক্ষিণ সাহারায় ঝড় বাতাস পাঠাচ্ছে।
অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবল বৃষ্টিপাত বেশিরভাগ জনবসতিহীন এলাকায় ঘটলেও, চাদ, নাইজেরিয়া, মালি এবং নাইজারসহ পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণে ১,০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, ১৪টি আফ্রিকান দেশে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পিটার ডে মেনোকাল বলেন, উত্তরের আটলান্টিক মহাসাগরের রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ তাপমাত্রা বৃষ্টিপাত প্রবণ অঞ্চলের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে, যা নিরক্ষীয় অঞ্চলের ভারী বৃষ্টিপাতকে আরও উত্তরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সিলভিয়া ট্রাসকা বলেন, এল নিনো থেকে লা নিনায় পরিবর্তন সম্ভবত ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোন কতটা উত্তরে সরেছিল তার উপর প্রভাব ফেলেছে।
এ বছর প্রাথমিকভাবে 'নেচার' জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে বৃষ্টিপাত প্রবণ অঞ্চলটি আরও উত্তরের দিকে সরে যেতে পারে। তবে বিশ্বের অন্যান্য মহাসাগরের তাপমাত্রা আটলান্টিকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গেলে, বৃষ্টিপাত প্রাবণ অঞ্চলটি আবার নিচে, এমনকি নিরক্ষ রেখার দক্ষিণে ফিরে আসবে বলে মন্তব্য করেছেন পিটার ডে মেনোকাল।
তিনি বলেন, "কয়েক দশক পরে, যখন বৃহত্তর মহাসাগরগুলো আরও সমানভাবে উষ্ণ হবে, তখন আমরা আশা করছি বৃষ্টি অঞ্চলটি তার আসল অবস্থানে ফিরে যাবে এবং এটি অন্য গোলার্ধেও সরে যেতে পারে।"
পশ্চিম আফ্রিকা জুড়ে ইন্টারট্রপিকাল কনভার্জেন্স জোনের উত্তরমুখী সরে যাওয়াও আটলান্টিক বেসিনে ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কার্যকলাপের মন্দার জন্য দায়ী হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এনওএএ-র ক্লাইমেট প্রেডিকশন সেন্টারের আবহাওয়াবিদ ড্যান হার্নোস গত মাসে এবিসি নিউজকে বলেন, এই অঞ্চলের বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তা আটলান্টিকের অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা পানির ওপর প্রবেশ করছে। মধ্য-অক্ষাংশ থেকে শুষ্ক বায়ুর অধিক প্রবাহের কারণে ঝড়ের বিকাশের সম্ভাবনাও কমে যাচ্ছে।