ট্রাম্পকে একসময় ‘আমেরিকার হিটলার’ ডাকা ভ্যান্স এখন তারই ভাইস প্রেসিডেন্ট!
নতুন ইতিহাস গড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে পরাজিত করে তিনি এ জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন।
ট্রাম্পের এই ভূমিধস জয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এক স্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে। একইসাথে এর মধ্য দিয়ে রানিং মেট জেডি ভ্যান্স যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।
তবে কয়েক বছর আগেও ট্রাম্প ও ভ্যান্সের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। অথচ এবার এই দুই রিপাবলিকানই হোয়াইট হাউজের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন।
সময়টা ২০১৬ সাল। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হননি। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওই সময় বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও টুইটে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন দেশটির তরুণ রাজনীতিক ভ্যান্স।
নিজেকে একজন ট্রাম্পবিরোধী হিসেবে পরিচয় দিতেন ভ্যান্স। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, "আমি কখনোই ট্রাম্পের লোক নই। আমি কখনোই তাকে পছন্দ করিনি। আমি তাকে নিন্দার যোগ্য মনে করি। হায় ঈশ্বর, তিনি (ট্রাম্প) একজন নির্বোধ মানুষ।"
একই সময় জেডি ভ্যান্সের একটি স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। নাম 'হিলবিলি এলিজি'। এ বই তাকে দেশজুড়ে খ্যাতি এনে দেয়। একই বছর ট্রাম্পকে 'আমেরিকার হিটলার' আখ্যা দিয়েও ফেসবুকে লিখেছিলেন ভ্যান্স।
তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ট্রাম্পকে নিয়ে ভ্যান্সের মনোভাব বদলে যায়। কট্টর সমালোচক থেকে শুভাকাঙ্ক্ষী বনে যান তিনি। হয়ে ওঠেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের একজন।
বর্তমানে ভ্যান্সের বয়স ৩৯ বছর। তিনি ওহাইওর সিনেটর ছিলেন। ২০২২ সালে তিনি এ অঙ্গরাজ্যের সিনেটর নির্বাচিত হন।
ভ্যান্সের জন্ম মিডল্টাউন, ওহাইওতে। তার মা দীর্ঘদিন মাদকাসক্তির সাথে লড়াই করেছেন এবং তিনি ছোট থাকতেই তার বাবা তাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।
দাদা-দাদির কাছে বড় হওয়া ভ্যান্সের জন্ম ওহাইওতে হলেও তার পরিবার এক সময় অ্যাপালাচিয়ার দক্ষিণের বাসিন্দা ছিলেন।
স্মৃতিকথা 'হিলবিলি এলেজি'-তে ভ্যান্স অকপটে তার পরিবারের সংগ্রামকে চিত্রিত করেছেন এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বের ওপর জোর দিয়ে অ্যাপালাচিয়ায় সামাজিক অবক্ষয়ের সংস্কৃতি হিসেবে তিনি যা দেখেছেন তার সমালোচনা করেছেন।
ভ্যান্সের রাজনৈতিক পথচলা শুরুতে ততটা মসৃণ না হলেও সামরিক সেবা প্রদান, মর্যাদাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণ এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজমের ক্যারিয়ারের মাধ্যমে তিনি সাফল্যে উন্নীত হন।
'হিলবিলি এলিজি' তাকে শুধু একজন বেস্টসেলিং লেখকই করেনি বরং শ্বেতাঙ্গ, শ্রমজীবী ভোটারদের মাঝে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা ফুটিয়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যদিও তিনি ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের সমালোচনা করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থকরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে হামলা চালানোর পর ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হন তিনি। ট্রাম্পের সমর্থন ২০২২ সালের সিনেটর নির্বাচনে ভ্যান্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছিল। একইসাথে তার জয় নিশ্চিত করতে সাহায্য করেছিল।
বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ভ্যান্স বলেছিলেন, ট্রাম্প সম্পর্কে তার মতামত ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার প্রাথমিক বিরোধিতা ট্রাম্পের নীতির চেয়ে তার (ট্রাম্প) ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি ছিল। ফলে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তার বিরোধিতার কোন মূল্য নেই। তাই বিভিন্ন বিষয়ে ট্রাম্পের সমর্থন ও মতামতের সঙ্গে একমত হতে শুরু করেন ভ্যান্স।
মার্কিন সিনেটে ভ্যান্স ধারাবাহিকভাবে রক্ষণশীল হিসেবে ভোট দিয়েছেন। জনসমর্থনমূলক অর্থনৈতিক নীতি সমর্থন করেছেন এবং ইউক্রেনে সহায়তার ব্যাপারে সোচ্চার সমালোচক হয়ে উঠেছেন।
ভ্যান্স গাজায় ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ এবং নথিপত্রবিহীন অভিবাসীদের নিয়োগকারী কলেজগুলোতে ফেডারেল তহবিল আটকে রাখার বিল প্রবর্তন করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন মেনে না চললে মার্কিন পুঁজিবাজারে চীনাদের প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করার জন্য আইন স্পনসর করেছিলেন।
চলতি রিপাবলিকান প্রাইমারিতে ট্রাম্পের সাথে ভ্যান্সের সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তিনি দৃঢ় আনুগত্য দেখিয়ে অন্যান্য সম্ভাব্য ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের আগেই ২০২৩ সালের জানুয়ারির শুরুতে ট্রাম্পকে সমর্থন করেছিলেন।
পর্দার আড়ালে ভ্যান্স ডোনাল্ড ট্রাম্পের তহবিল সংগ্রহের প্রচেষ্টায় সহায়তা করেছেন এবং ধনী দাতাদের তহবিলে দান করতে রাজি করিয়েছেন। উদাহরণ স্বরূপ, ভ্যান্স জুন মাসে একটি বে এরিয়া তহবিল সংগঠিত করতে সাহায্য করেছিলেন। যেটির আয়োজক ছিলেন ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট ডেভিড স্যাক্স এবং চামাথ পালিহাপিটিয়া।
যদিও কিছু সমালোচক মনে করেন, ভ্যান্স নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন না দেখিয়ে ট্রাম্পকেই নকল করছেন। সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড নিভেন বলেন, "ভ্যান্স ট্রাম্পেরই প্রতিধ্বনি।"
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান