‘হিরো আলম’ দুইবেলা বনাম মুচলেকা!
গান না শুনলে আমার চলে না। দিন পার হলেও রাত পার হয় না। ঘুমের অনুষঙ্গ হচ্ছে গান আর বই। দুটো অভ্যাস বহুকাল ধরে আমার ঘুম ডেকে আনে। সেই নিয়মে চিড় ধরলো। কয়েকদিন ধরে ঘুম কমলো, প্রেশার বাড়লো; ফলাফল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। হাসপাতালের এক চিকিৎসক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রেসার ও ঘুমের ওষুধ দিলেন তিনি। বললাম বই ও গান ছাড়া আমার যে ঘুম আসে না? ডাক্তার বন্ধু হাসতে হাসতে বললেন- তাহলে সকাল আর রাতে 'হিরো আলম দুই বেলা'! আর দুপুর বেলাতে ডক্টর সাহেবের গানও শুনতে পারেন!
'হিরো আলম' দুই বেলা আমার মনে ধরলো। একই সাথে প্রশ্ন জাগলো মনে, ডাক্তার বন্ধু কি আমাকে ওষুধ দিলো নাকি শাস্তি? এমন অনেক শাস্তির গল্প কিন্তু প্রচলিত আছে। যেমন পুলিশ এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরে এনে 'মৃদু' পিটুনি দিয়েছে। পুলিশের পিটুনি সবসময় কেন যেন 'মৃদু' হয়! পত্রিকায় লেখা হয় পুলিশ 'মৃদু লাঠিচার্জ' করেছে। যাই হোক হাজত খানায় শীর্ষ সন্ত্রাসী পিটুনি খাওয়ার 'আফটার ইফেক্ট' হিসেবে আহ উহু করছে। তার শিষ্যরা তার গা হাত পা টিপে দিচ্ছে।
এমন সময় সেখানে দেশের এক বড় ব্যবসায়ীকে আনা হলো। তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছেন। হাজত খানায় চেয়ার দেওয়া হলে তিনি বসলেন। ব্যবসায়ী মন খারাপ করে বসেছিলেন। হাজতখানায় সন্ত্রাসীর কষ্ট দেখে তিনি বললেন- 'দেশব্যাপী গান গাওয়ার জন্য আমার অনেক সুনাম আছে। আপনাকে একটা গান শোনাই?' শীর্ষ সন্ত্রাসী চিৎকার করে পুলিশ ডেকে বললো, 'ভাই প্রয়োজনে আমারে আবারো বাঁশডলা দেন। দয়া কইরা এনার গান শোনার শাস্তি আমারে দিয়েন না!'
আইন সবার জন্য সমান না। এটা শুধু বইপত্রে লেখা থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে অরওয়েলের 'অ্যানিমেল ফার্ম' উপন্যাসের সেই বিখ্যাত দুই লাইনের মতো- এভরিবডি ইজ ইকুয়াল বাট সামবাডি ইজ মোর ইকুয়াল।
বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতির কবিতা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। আমরা সেইদিকে না যাই। আমরা আপাতত সামান্য সময়ের জন্য 'হিরো আলম' নিয়ে থাকি। প্রিয় পাঠক আপনারা জানেন ২০২২ সালের কোরবানীর ঈদে (জুলাই) কয়েক লাখ টাকা দামের একটা গরুর নাম রাখা হয়েছিল হিরো আলমের নামে। এরও আগে একটা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে যার নাম 'সাহসী হিরো আলম'!
ভিডিও বা কন্টেন্ট বানিয়ে ভাইরাল হওয়া, নির্বাচনে দাঁড়ানো, বড় একটা দল থেকে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন চাওয়া, স্ত্রীর অভিযোগে জেল খাটা, সবশেষে দেশি-বিদেশি গান গেয়ে আলোচনায় আসা বা ভাইরাল হওয়া হিরো আলমের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কেউ তারে অবজ্ঞা করতেন, নাক সিটকাতেন। কেউ এড়িয়ে যেয়ে চুপ করে থাকতেন। কেউ হিরো আলমের তৈরি কোনো কন্টেন্ট শেয়ার দিলে অনেকেই 'রুচির বিকৃতি' হিসেবে মন্তব্য করতেন। হিরো আলম সম্পর্কে সবার ধারণা ছিল এমন-ওকে থামান, ওকে আটকান। সবকিছুর একটা লিমিট থাকা দরকার! শেষমেষ পুলিশ তাকে আটকিয়ে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিলো।
এখন হিরো আলমকে দেখে যারা নাক সিটকাতেন তারা সরব হয়ে বলছেন- ওরে আটকাইলেন কেন? মুচলেকা নিলেন কেন? পুলিশ কি বিশ্বভারতী, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা রবীন্দ্র সৃজন কলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলেছে? কেউ কেউ জানতে চাচ্ছেন রবীন্দ্র সংগীত কেউ সুরে গাচ্ছে নাকি বিকৃতি করছে সেটার সার্টিফিকেট দেওয়ার পুলিশ কে? কেউ কেউ আবার পুলিশের প্রশংসা করে বলছেন- তাও ভালো পুলিশ রিমান্ডে নেয় নি বা বাঁশডলা দেয় নি। জিজ্ঞাসাবাদের পর মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে! পুলিশের ভাষ্য ছিল কয়েকজনের অভিযোগের ভিত্তিতে হিরো আলমকে ডাকা হয়েছিল। সবাই হুমড়ি খেয়ে পরে জানতে চাচ্ছেন কারা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেছেন?
পুলিশের পিটুনি সবসময় কেন যেন 'মৃদু' হয়! পত্রিকায় লেখা হয় পুলিশ 'মৃদু লাঠিচার্জ' করেছে।
আসলে ভাইরাল টেন্ডেন্সী হিরো আলমের পিছু ছাড়ছে না। তিনি 'ভাইরাল কপাল' নিয়ে জন্মেছেন। সবাই তার জন্য কিছু প্রশ্ন রাখছেন। উত্তর পাওয়া যাচ্ছে আবার যাচ্ছেও না। যেমন-
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথকে কি কোনো কারণে মুচলেকা দিতে হতে পারে?
উত্তর: পারে। মৃত্যুপরবর্তীকালেও শাস্তি বা পুরস্কারের ব্যবস্থা আছে যাকে বলা হয় মরণোত্তর। রবীন্দ্রনাথ যেমন 'সোনারতরী' লিখেছেন তেমনি 'নৌকাডুবি'ও লিখেছেন। নৌকাডুবি লেখার কারণে মুচলেকা নেওয়া হবে কিনা সেটা ভাবনার পর্যায়ে আছে।
প্রশ্ন: ডিবি, এসবি, সোয়াট (পুলিশের এই বিভাগটা অনন্ত জলিলের 'দিন দ্য ডে' ছবির জন নতুনভাব্যে বিখ্যাত হয়েছে), সিআইডি নামে পুলিশের কিছু ডিপার্টমেন্ট আছে। পুলিশের একেবারে নতুন কোনো ডিপার্টমেন্ট কি খোলা হয়েছে? যাদের কাজ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শুদ্ধতা রক্ষা করা, রবীন্দ্র শাখা দিয়ে যার কাজ শুরু হয়েছে? হিরো আলমের মুচলেকা দেওয়ার মাধ্যমে কী প্রমাণ হয়, দেশে আইনী অধিকার জোরালো ভাবে প্রতিষ্ঠিত আছে?
উত্তর: এই প্রশ্নের মধ্যেই ফাঁক। আইন সবার জন্য সমান না। এটা শুধু বইপত্রে লেখা থাকে। অধিকারও সবার সমান না। 'আমারই দেশ সব মানুষের' এমন কথা গায়ক রথীন্দ্রনাথ রায়ের গানেই থাকে! বাস্তবটা হচ্ছে ২০০৭-২০০৮ সালে যখন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে জেলে নেয়া হয়েছিল তখন দুই দলের প্রধানের জন্য সাবজেল তৈরি করা হয়েছিল। আইন কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমান না। একজন সংসদ সদস্য এটা বলেছিলেন। বাস্তবতা হচ্ছে অরওয়েলের 'অ্যানিমেল ফার্ম' উপন্যাসের সেই বিখ্যাত দুই লাইনের মতো- এভরিবডি ইজ ইকুয়াল বাট সামবাডি ইজ মোর ইকুয়াল।
কেউ কি জানে কোন কাজে মুচলেকা দিতে হবে আর কোন কাজে মুচলেকা দিতে হবে না?
একারণে হিরো আলম মুচলেকা দিতে বাধ্য হন, কিন্তু ব্যবসায়ী, প্রখ্যাত গায়করা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ব্যানারে নজরুল-রবীন্দ্র-লোক গান ইচ্ছেমতো যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহারে বিকৃত সুরে গাইলে, বারোটা বাজালে কিংবা কোন একজন কোটি কোটি টাকা খরচ করে নিজের বানানো ছবিতে 'সেরাম' অভিনয় করার পরও মুচলেকা দিতে হয় না।
তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? মুচলেকা নিয়ে এত হৈচৈ কেন? আসল কারণ অন্য জায়গায়। এখন পরিচয়হীন, নিম্নবর্গীয় কেউ হয়ে নজরুল ও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হলে অনুমতি নিতে হবে? উল্টাপাল্টা হলে মুচলেকা দিতে হবে? কেউ নাটকে কোনো ভুল করলে ধরবে? কেউ যদি ওয়াজে কোনো ভুল করে তাকে ধরবে? মুচলেকা দিতে হবে? প্রশ্ন হলো কেউ কি জানে কোন কাজে মুচলেকা দিতে হবে আর কোন কাজে মুচলেকা দিতে হবে না? খুবই দুর্ভাবনার বিষয়!
সকল দুর্বলতা সত্ত্বেও, আমি বলি হিরো আলমের নিজের রুচি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তার মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়েছে! জানি না সংস্কৃতিকে পুলিশী আওতায় আনা হলো কেন। যাত্রাপালা, প্রদর্শনী, লাঠি খেলা, কবি গানের আসর, মেলা অনেক কিছু বন্ধ করা হয়েছে শুধুমাত্র মৌলবাদীদের আক্রমণের ভয়ে। হিরো আলমের মতো খুব সাধারণ, খ্যাতি প্রত্যাশী একজন নতুন করে যোগ হলেন কেবল, এই তো!
- আহসান কবির: রম্য লেখক