১৮ বছর ধরে জ্বলে না ফ্লাডলাইট, তবুও গুনতে হয় লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল
রাজশাহী শহরে দুইটি স্টেডিয়াম রয়েছে। একটি নগরীর তেরোখাদিয়ায় অবস্থিত শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বিভাগীয় স্টেডিয়াম এবং আরেকটি নগরীর শালবাগান এলাকায় অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়াম। দুইটি স্টেডিয়ামেই ফ্লাডলাইটের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু রাতে খেলা হয় না বিধায় বাতি জ্বলেনা। তাই স্টেডিয়াম দুইটিতে ফ্লাডলাইটের ব্যবহার নেই দেড় যুগের বেশি সময় ধরে। শুধু ফ্লাডলাইটের জন্য বিদ্যুতের বাড়তি লোড নিয়ে রাখার কারণে প্রতি মাসে মিনিমাম চার্জ হিসেবে দিতে হচ্ছে লাখ টাকারও বেশি। বিষয়টি বিসিবি ও স্টেডিয়াম সংশ্লিষ্ট সবাই জানেন।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সূত্রে জানা যায়, রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামটি ২০০৪ সালে নির্মিত হয় এবং এর ধারণক্ষমতা ৩৫,০০০। এই স্টেডিয়ামে ২০০৪ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের তিনটি গ্রুপ পর্বের ম্যাচ এবং ২০১০ সালের দক্ষিণ এশীয় গেমসের চারটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ইন্দো-বাংলা খেলায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচটিও অনুষ্ঠিত হয়। এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। এটি জাতীয় ক্রিকেট লিগের রাজশাহী বিভাগের হোম গ্রাউন্ড। এই স্টেডিয়ামের পাশে ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমী অবস্থিত।
রাজশাহী বিভাগীয় স্টেডিয়ামটি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড-বিসিবি কর্তৃক পরিচালিত। এই অঞ্চলের ক্রিকেট জনপ্রিয় করতেই স্টেডিয়ামটি গড়ে তোলা হয়।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ জামাল জানান, ২০০২ সালে বিভাগীয় স্টেডিয়ামকে সংস্কার করে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হয়। এইজন্য ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপের তিনটি গ্রুপ পর্বের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। ফ্লাডলাইটে খুব ভালো মানের বাল্ব লাগানো হয়েছিলো। আইসিসির তৎকালীন ভেন্যু ম্যানেজার রাজশাহীর মাঠ ও পিচ দেখে এটাকে দেশের মধ্যে সবচেয়ে ভালো মানের মাঠ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালে একদফা ও ২০১৫ সালে আরেক দফা ফ্লাডলাইট থেকে কিছু বাল্ব খুলে চট্টগ্রামে নেওয়া হয়। তারপর সেই বাল্ব আর ফিরে আসেনি। বাকি যেগুলো আছে সেগুলোরও ঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ নেই। গুদামজাত করে রাখা হয়েছে বাল্বগুলো।
আর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট আছে তারও আগে থেকে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি ফ্লাডলাইট টাওয়ার ভেঙে পড়েছে ঝড়ে। আরেকটিতে ধরেছে ফাটল। চট্টগ্রামের স্টেডিয়ামের জন্য এখানকারও কিছু বাল্ব খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামের পূর্ব নাম ছিল রাজশাহী জেলা স্টেডিয়াম। রাজশাহী রেলগেটের পাশে বিমান বন্দর রোডের শালবাগান এলাকায় স্টেডিয়ামটি অবস্থিত। এতে ২০ হাজারের বেশি দর্শকের বসার সুবিধা আছে। জেলা প্রশাসক খান মোহাম্মদ শামসুর রহমান ১৯৬২ সালে স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করেন এবং জেলা প্রশাসক পিএ নাজির এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ জায়গাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (তৎকালে রাজশাহী পৌরসভা) ভাগাড় ছিল।
রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামের বর্তমান নাম মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়াম। ১১ এপ্রিল ২০১১ তারিখে রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভায় রাজশাহী জেলা স্টেডিয়ামের পরিবর্তে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়াম নামকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে এ সিদ্ধান্ত জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ অনুমোদন প্রদান করে।
দুইটি স্টেডিয়ামেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড নেসকো এর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৩ থেকে। এর মধ্যে নগরীর শালবাগান এলাকার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামের বিদ্যুৎ বিল আসে রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক বরাবর। গত আগস্ট মাসের বিদ্যুৎ বিল থেকে দেখা গেছে, আগস্ট মাসে তাদের পরিশোধযোগ্য বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৪৫,৯২৭ টাকা। এর মধ্যে ডিমান্ড চার্জ ২৪, ০০০ টাকা। ফ্লাডলাইট জ্বালানোর জন্য ৪০০ কিলোওয়াট লোড বরাদ্দ দেওয়ায় এই ডিমান্ড চার্জ দিতে হয় মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামকে।
রাজশাহী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ওয়াহেদুন্নবী অনু জানান, বাতি জ্বলুক বা না জ্বলুক আমাদের প্রতি মাসে ফ্লাডলাইটের জন্য ২৪ হাজার টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হয়। এছাড়া অফিসের লাইট ও এসিসহ অন্যান্য বিদ্যুৎ বিল তো আছেই। আমরা প্রতি মাসেই বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করি। কোনোমাসের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া নাই।
নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার বিভাগীয় স্টেডিয়ামের বিদ্যুৎ বিল আসে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ রাজশাহীর উপপরিচালক বরাবর। গত আগস্ট মাসের বিদ্যুৎ বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত আগস্ট মাসের বিদ্যুৎ বিল এসেছে ১,২০,৪৪৬ টাকা। ফ্লাডলাইট জ্বালানোর জন্য এক হাজার কিলোওয়াট লোড বরাদ্দ দেওয়ায় এই স্টেডিয়ামের ডিমান্ড চার্জ ৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ফ্লাডলাইট না জ্বালানো হলেও প্রতি মাসে এই স্টেডিয়াম থেকে ৬০ হাজার টাকা ডিমান্ড চার্জ দিতে হয়।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ রাজশাহীর উপ-পরিচালক ফারুক আহম্মেদ সরকার জানান, আমার বরাবর বিদ্যুৎ বিল আসে। আমি বিদ্যুৎ বিল ঢাকার বিসিবি বরাবর পাঠিয়ে দিই। তারাই বিল পরিশোধ করে।
শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বিভাগীয় স্টেডিয়ামের ভেন্যু ম্যানেজার আরেফিন ইসলাম জানান, বিভাগীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় ক্রিকেট লীগ, বিপিএল, বিভাগীয় পর্যায়ের ক্রিকেট, জাতীয় পর্যায়ের অনূর্ধ্ব ১৮, ১৯ সহ জাতীয় ক্রিকেট দলের প্র্যাকটিস ম্যাচও অনুষ্ঠিত হয়। ফলে দেখা যায় ফ্লাডলাইট ছাড়াও অফিসে এসি ও লাইটের ব্যবহারের কারণে বিদ্যুৎ বিল আসে।
তবে নেসকোর বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শরিফুল আওলাদ জানিয়েছেন, অতিরিক্ত লোড নিয়ে থাকার কারণে বিভাগীয় স্টেডিয়ামে এক লাখ থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত মিনিমাম চার্জ হিসেবে বিল উঠতে পারে। আর জেলা স্টেডিয়ামে বিল আসতে পারে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। বিদ্যুৎ ব্যবহার না করলেও এ বিল দিতে হয়। স্টেডিয়াম দুটি আনুপাতিক হারে বিল দিয়ে যাচ্ছে। লাইট জ্বলে কি না তা তাদের দেখার বিষয় না।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পরিচালক (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) মুহাম্মদ সারওয়ার জাহান, দেশে সাধারণত ঢাকার মিরপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট স্টেডিয়ামে খেলাধুলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। ফলে অগ্রাধিকারের দিক থেকে সেখানে ফ্লাডলাইট জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ বাতি না জ্বালালে সেগুলো নষ্ট হয়ে যায়। রাজশাহীতেও যদি বিসিবি রাতে খেলার আয়োজন করে থাকে তখন আমাদের বলা হলে বাল্ব লাগানোর ব্যবস্থা করে দিবো।