ঐতিহ্যের স্মারক শতবর্ষী বাড়িগুলো সংরক্ষণে নেমেছে ভারতের নতুন প্রজন্ম
কলকাতার জগৎ নিবাস নামক ১২০ বছর পুরোনো বাড়িতে ছোটবেলা কাটিয়েছেন রোহান দেওয়ানজী। এ মাসে বাড়িটি স্থানীয় বিল্ডারদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পর ভেঙে ফেলা হয়।
বাড়ির সদস্যরা আর রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছিলেন না বলে এমন সিদ্ধান্ত। তবে ভাঙার আগে বাড়িতে একটি আর্ট ইভেন্ট করেছিলেন দেওয়ানজি। এভাবেই শতবর্ষী পৈতৃক বাড়ির শেষ স্মৃতিটুকু ধরে রাখলেন তিনি।
সারা ভারতজুড়ে এরকম শত-শত পুরোনো বাড়ি পড়ে আছে। কলকাতাতেও এ ধরনের বাড়ির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এ বাড়িগুলোর সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
ভারতের তরুণ-তরুণীরা এখন এসব বাড়িগুলোর ওপর সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছেন। তাদের উদ্দেশ্য এ বাড়িগুলোকে যেন ভেঙে ফেলার হাত থেকে রক্ষা করা যায়, যেন মানুষের স্মৃতি থেকে হারিয়ে না যায় এগুলো।
এজন্য অনেকে ইনস্টাগ্রামে এসব ভবনগুলো নিয়ে কনটেন্ট তৈরি করছেন। এসব বাড়ির বর্তমান অধিবাসীদের বাড়ি নিয়ে স্মৃতিচারণ, তাদের গল্পগুলোকে তুলে আনছেন তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমনকি তহবিল গঠন করে এ বাড়িগুলোকে রক্ষার ব্যাপারেও ভাবছেন তারা।
এসব বাড়ি যেমন পরিবারগুলোর স্মৃতির ভাণ্ডার, তেমনি তাদের একসময়ের সামাজিক মর্যাদা আর অর্থনৈতিক ভিতেরও প্রতীক। আর এগুলোর রয়েছে ঐতিহাসিক তাৎপর্যও।
কলকাতার সাবেক কালের প্রাসাদোপম বাড়িগুলোতে রয়েছে ইউরোপীয় স্থাপত্যের সঙ্গে ভারতীয় প্রভাবের ছোঁয়া। গোয়ার অনেক পুরোনো বাড়ি এখনো সেখানকার ঔপনিবেশিক সময়ের পর্তুগিজদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
বাড়িগুলোর বেশিরভাগই এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে অথবা বিক্রি হওয়া বা ভেঙে ফেলার অপেক্ষায় আছে।
মুম্বাইভিত্তিক কনজার্ভেশন আর্কিটেক্ট আভা নারাইন লাম্বা বলেন, ভারতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ঐতিহ্যবাহী পৈতৃক সম্পদগুলোর ব্যাপারে খুব কম সহায়তার ব্যবস্থাই রয়েছে।
'এ বাড়িগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন কাজ। বর্মি সেগুনকাঠ, এনকস্টিক টাইল ইত্যাদি উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বাড়িগুলো। এসব উপাদান এখন অনেক দামি, আর পাওয়াও যায় না সহজে। অনেক ভবনের নকশাও এখন সেকেলে হয়ে গেছে,' বলেন তিনি।
কেরালার ৫৪ বছর বয়সী রাজকুমার বাসুদেবের পৈতৃক বাড়িটি ৬০০ বছরের পুরোনো। একসময়ে পরিবার যৌথ ছিল বলে বাড়িটি গমগম করত। এখন সবাই নিজেদের একক পরিবার তৈরি করে ফেলায় এত বড় বাড়িতে কেবল তিনি আর তার মা বাস করছেন।
বাড়িটিকে রক্ষায় সহায়তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধারিন্নি'র কথা জানতে পারেন রাজকুমার। কেরালাভিত্তিক এই ট্রাস্ট কাজ করছে বাস্তুবিদ্যা ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণে। ধারিন্নি পরিচালনা করেন তিন জন স্থপতি।
২০২১ সালে ধারিন্নি 'রেসপনসিবল ট্যুরিজম থ্রু আর্কিটেকচার' শীর্ষক একটি প্রকল্প শুরু করে। এ প্রকল্পের আওতায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িগুলোতে পর্যটকদের থাকতে দিয়ে তার থেকে প্রাপ্ত অর্থে বাড়িগুলোর জন্য তহবিল তৈরি করা হয়।
একইভাবে গোয়ার পৈতৃক বাড়িগুলো 'মেক ইট হ্যাপেন' নামক একটি পর্যটন উদ্যোগের মাধ্যমে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছেন মুরালি শংকরন ও তার স্ত্রী মারিয়া ভিক্টর।
পর্যটকদের কাছে বিক্রি করা টিকিটের দামের কিছু অংশ রাখা হয় বাড়িগুলো রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দে। এরকমই একটি বাড়ি হচ্ছে ফার্নান্দেজ ম্যানসন। ৬০০ বছরের পুরোনো এ বাড়িটি অতীতে চন্দরের দুর্গ দেওয়ালের অংশ ছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপে জানা গেছে।
এছাড়া আরও কিছু বাণিজ্যিক উপায় রয়েছে এ বাড়িগুলো পরিচালনার জন্য।
অনেকে এসব প্রাচীন বাড়িকে বিলাসবহুল বাংলো, বুটিক হোটেল ইত্যাদিতে পরিণত করে ফেলেছেন। তবে এমন উদ্যোগ নেওয়ার মতো পুঁজি অবশ্য সবার কাছে নেই।
আর এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক জ্ঞানেরও প্রয়োজন রয়েছে। যেসব ব্যক্তি নিজেদের বাড়িগুলোকে হোটেলে পরিণত করতে চান না, তাদেরকে সাহায্য করে প্রজেক্ট ধারিন্নি।
কলকাতায় রোহান দেওয়ানজির বাড়ি হারিয়ে গেলেও শেষ মুহূর্তে তিনি এর যে স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছেন, তা দিয়েই বাড়িটিকে মনে রাখা হবে আরও অনেক বছর।
দেওয়ানজির প্রতিবেশীদের কাছেও এ বাড়িটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত হতো। তার ছোটবেলার বন্ধুদের কাছে জগৎ নিবাস ছিল মার্বেলে গড়া মেঝে, হাতির দাঁতের মূর্তি, ও ভূতের গল্পের এক রহস্যময় সত্তা।
বাড়িটি ভেঙে ফেলার কয়েক বছর আগে অন্য বাড়িতে উঠে গিয়েছিলেন দেওয়ানজি। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পারিবারিক জিনিসপত্রগুলো পরিবারে সদস্যদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছিল।
'আমরা মানুষেরা অন্য বাড়িতে গিয়ে উঠেছি, কিন্তু জগৎ নিবাসের ভূতেদের কী হয়েছে তা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি,' বলেন রোহান।
'ওরা গেল কোথায়?'
সূত্র: বিবিসি