‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ আজ থেকে ঢাকায় মিছিল করবে বিএনপি
চলমান আন্দোলনকে আরও বেগবান করতে ৪ দিনব্যাপী নতুন পদযাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। আজ শনিবার (২৮ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর বাড্ডার শাহজাদপুর থেকে মালিবাগের আবুল হোটেল পর্যন্ত পদযাত্রার মধ্য দিয়ে এ কর্মসূচি শুরু হবে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের সিনিয়র নেতাবৃন্দ ও মহানগরের নেতাকর্মীরা এ কর্মসূচিতে অংশ নিবেন বলে জানিয়েছে দলটি।
গত বৃহস্পতিবার (২৬ জানুয়ারি) বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, "গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, বর্তমান সংসদ ঙেঙ্গে দেয়া, সরকারের পদত্যাগ ইত্যাদি ১০ দফা দাবি আদায়ে আগামী সপ্তাহে রাজধানীর চার স্থানে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি।"
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে— ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ পদযাত্রা করবে যাত্রাবাড়ী থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত এবং ১ ফেব্রুয়ারি যাত্রা করবে মুগদা থেকে মালিবাগ পর্যন্ত।
অন্যদিকে, মহানগর উত্তর বিএনপি ২৮ জানুয়ারি বাড্ডার শাহজাদপুর থেকে মালিবাগ আবুল হোটেল এবং ৩১ জানুয়ারি গাবতলী থেকে মিরপুর ১০নং গোলচত্বরে পদযাত্রা করবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, "আমরা আশা করি, এই কর্মসূচি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হবে। এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি আরও বেগবান হবে।"
তাছাড়া বিএনপি মনে করে, তাদের সমাবেশের দিন পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে উস্কানি দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে বিএনপি নানা অভিযোগও করে আসছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থেকে সরে আসার জন্য আওয়ামী লীগের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তাদের কর্মসূচিকে বিএনপির পাল্টা নয় বলে বহুবার উল্লেখ করেছেন।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে এক সভায় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বলেন, "আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির কর্মসূচিতে কোনো ধরনের উস্কানি না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।"
ওবায়দুল কাদের বলেন, "২০২২ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। আমাদের কর্মসূচিতে কোনো প্রকার বিরতি থাকবে না, বিরতিহীনভাবে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মসূচি চলবে।"
"গণসংযোগ এবং সতর্ক অবস্থানে থাকবো আমরা। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত, আগুন-সন্ত্রাসের যেসব ঘটনা মাঝে মাঝে দেখা দেয় এসব ঘটনার বিরুদ্ধে আমরা সতর্ক অবস্থানে থাকব," বলেন তিনি।
বিএনপির আন্দোলনে খানিকটা ভাটা
একটানা ১০টি বিভাগীয় সমাবেশের পর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ধারাবাহিকভাবে সরকার বিরোধী নানা কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে।
এসব কর্মসূচীর মধ্যে ছিল বিক্ষোভ সমাবেশ, গণ-অবস্থান, গণ-মিছিল এবং পদযাত্রা। দাবি আদায়ে নির্বাচনের আগে ঘেরাও, রোডমার্চ এবং লাগাতার কর্মসূচী পালনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে দলটির বিভিন্ন সূত্রে।
গত ২০২২ সালে সবশেষ সারাদেশে দশটি বিভাগীয় গণসমাবেশ কর্মসূচীতেও বিএনপি নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু গত ৭ তারিখ দলীয় কার্যালয়ের সামনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং ১০ ডিসেম্বরের পর সেই আন্দোলনে খানিকটা ভাটা পড়েছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মারুফ মল্লিক টিবিএসকে বলেন, "১০ ডিসেম্বরের পর বিএনপি একই টাইপের কর্মসূচি বারবার দেয়ার কারণে উজ্জীবিত নেতাকর্মীরা কিছুটা ঝিমিছে যাচ্ছে।"
"বিএনপির বর্তমান কর্মসূচির দেখে মনে হচ্ছে, তারা আন্দোলনে এখন কিছুটা কালক্ষেপণ ও নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে। যা আওয়ামী লীগকে একটু এডভান্টেজ দিচ্ছে। এই সুযোকে আওয়ামী লীগ আন্দোলনসহ সবকিছু ট্যাকেল দেয়ার সময় পেয়ে যাচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বিএনপির এখন উচিত দাবি আদায়ে সরকারকে দেড়-দু,মাসের আল্টিমেটাম দেয়া, আল্টিমেটামের মধ্যে দাবি না মানলে 'ঢাকায় মার্চ' কর্মসূচি দেয়া, যা হতে পারে ঢাকা কেন্দ্রীক লাগাতার কর্মসূচি।"
১৯৯৬ সালেও 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। এমনকি ২০০৬ সালেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রদান উপদেষ্টা নিয়োগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দাবিতে জোরালো কর্মসূচি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ, তখন আওয়ামী লীগ বিএনপির সরকার থেকে সভা-সমাবেশের অনুমতির তেমন একটা তোয়াক্কা করতো না।
কিন্তু বর্তমানে বিএনপির কর্মসূচিগুলো সরকারের অনুমতি নিয়ে করতে হচ্ছে, আন্দোলনের স্থান ও সময়ও নির্ধারণ করে দিচ্ছে সরকারের পুলিশ প্রশাসন, যা সরকার পতনের একটি গণআন্দোলন সৃষ্টিতে বিএনপিকে মাঠের রাজনীতি ও মনসত্ত্বাতিকভাবে কিছুটা পিছিয়ে রাখছে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী বলেন, "এভাবে অনুমতি নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করলে সরকার একটুও বিচলিত হবে না বলে আমি মনে করি। বিএনপিকে এই সময়ে এসে আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে হবে।"
"বর্তমান সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার কারণে বিএনপির দাবির প্রতি সমর্থন আছে, দেশের মানুষ এখন বিএনপির কাছে আরো জোরালে কর্মসূচি প্রত্যাশা করছে," যোগ করেন তিনি।
শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কৌশলে এগাচ্ছে বিএনপি
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাসসহ প্রায় সিনিয়র নেতাই সভা-সমাবেশে সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছেন।
বিএনপির দাবি, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ পর্যন্ত সারাদেশে দলটির নেতা-কর্মীদের নামে যেসব মামলা হয়েছে, তার সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এসব মামলায় আসামী ৩৬ লাখ। আর কারাগারে আটক ২০ হাজার।
গত অক্টোবরে বিএনপির ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর নতুন করে মামলা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার এবং খুন হয়েছেন দলের ১৫ জন নেতাকর্মী।
বিএনপির নেতারা বলছেন, বর্তমান সরকার বিএনপির হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে নিজেরাই সহিংসতা করে বিএনপির উপর এসব মামলা-হামলা ও দায় চাপায়। কিন্ত এবার বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হওয়ায় সেই সুযোগটি তেমন পাচ্ছে না সরকার।
এর ফলে সরকারের প্রতি যেমন দেশি-বিদেশী চাপ বাড়ছে, অহিংস আন্দোলন হওয়ার কর্মসূচি গুলোতেও জনসম্পৃক্ততা বাড়ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "এবার আন্দোলনে আমরা দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কারণ আমাদের আন্দোলন তো দেশে ভোটাধিকারের জন্য, মানবাধিকারের জন্য, বিচার-বহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমানোর জন্য।"
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলছেন, "বর্তমান নিপীড়নমূলক সরকার ও শাসন ব্যবস্থার মতো অবস্থা আমরা কখনোই দেখিনি। সরকার পতন করতে জনগণকে সাথে নিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের বিকল্প নেই, তাই আমরা শান্তিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছি। এবার সরকারের বিরুদ্ধে 'গণআন্দোলন' সৃষ্টি হবে বলে আমরা আত্মবিশ্বাসী।"
আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা টিবিএসকে বলেন, "এবার আন্দোলনটি জনগণের ক্ষোভের স্বতস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। তাছাড়া সরকার বিগত বছরগুলোতে গুম-খুন-দমন-পীড়ন করে জনগণের মধ্যে যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এবারের বিএনপির আন্দোলনে সেই ভয় কেটে গেছে।"
"এভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বিএনপি সরকারের পতন ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবে।"