নির্বাচনে ‘লিটল ম্যান’ কেন নিখোঁজ হয়ে গেল?
২০২০-এর ৮ মার্চ ঢাকায় প্রথম কোভিড শনাক্ত হয়। এর তেরো দিন পর, ২১ মার্চ খুব ভোরে শুরু হয় ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচন।
ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের পদত্যাগের পর আসনটি শূন্য হয়েছিল।
ভোটের দিন আসার আগেই ঢাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। করোনায় সংক্রমিট হওয়ার আশঙ্কায় ভোট দিতে আসেন মাত্র ৫ শতাংশ বা প্রায় ১৬ হাজার ভোটার। দেশের দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এর চেয়ে কম ভোট পড়েনি আর কোনো নির্বাচনে।
একপর্যায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাবুলকে ফোনে বলতে শোনা যায়, 'আপনার স্ত্রী-সন্তানকে পাঠান। ভোট দেওয়ার হার খুব খারাপ।'
এর কয়েক মাস পর, ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচন। করোনার ভয়ে তখনও তটস্থ ছিলেন ভোটাররা। তাই ওই উপনির্বাচনে ভোট পড়ে মাত্র ১০.৪৩ শতাংশ।
২০২০ সালে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ছিল মহামারি। তবে বুধবার (১ ফেব্রুয়ারি) ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে—বহুল আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে—ভোটারদের উপস্থিতি এত কম হওয়ার কারণ কী হতে পারে?
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল স্বীকার করেছেন, ডিসেম্বরে বিএনপি নেতাদের পদত্যাগের পর শূন্য হয়ে পড়া ছয়টি আসনে উপনির্বাচনে গড় ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচন। অথচ সেই আসনেই ভোট পড়েছে ১৬ শতাংশ, যা ছয়টি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে সর্বনিম্ন।
আবদুস সাত্তার ভূঁইয়াকে সত্যিকার অর্থেই বিনাকষ্টে জিতিয়ে দিয়ে সম্মানিত করেছে আওয়ামী লীগ। এই উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী সরে দাঁড়িয়েছেন। আরেক প্রার্থী নিখোঁজ হয়ে গেছেন। যদিও নির্বাচনের পরদিন বৃহস্পতিবার তার খোঁজ পাওয়া গেছে।
এদিকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক উপদেষ্টা সাত্তার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৪০ হাজার ৮১৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছেন মাত্র ৯ হাজার ৫৮০ ভোট।
তার জন্য এটি ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনুমোদন পাওয়া ওয়াকওভার।
ডিসেম্বরে সংসদ থেকে পদত্যাগের পর ফের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দাঁড়ানো, তারপর দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া, শেষে নির্বাচনে জেতা—তার এই পুনরুত্থানে ব্লকবাস্টার সিনেমার সব উপাদানই মজুত ছিল।
কিন্তু খুব কম দর্শকই—অর্থাৎ ভোটার—ক্লাইম্যাক্স দেখতে এসেছেন।
'লিটল ম্যান' থিয়োরি
গণতন্ত্রে ভোটারদের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করার সময় বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন রায়ে উইনস্টন চার্চিলের সাত দশকেরও আগের একটি বিখ্যাত মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়েছেন—'দ্য লিটল ম্যান, ওয়াকিং ইনটু আ লিটল বুথ, উইদ আ লিটল পেন্সিল, মেকিং আ লিটল ক্রস অন আ লিটল বিট অভ পেপার'।
১৯৪৪ সালে সংসদীয় অধিবেশন চলাকালে দেওয়া বক্তব্যকে 'লিটল ম্যান থিয়োরি' বলা যেতে পারে।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শোচনীয় রকমের কমসংখ্যক ভোটার উপস্থিতি মূল সত্যটি বলে দিচ্ছে: নির্বাচনে সেই 'লিটল ম্যান'কে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এই মানুষদের তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে? আর তাদের আমরা ফিরিয়েই বা আনব কীভাবে? এবং তারা নিখোঁজ হতে শুরু করেছিল কখন?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মাগুরা
ব্রাহামবাড়িয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ১৯৯৪ সালের মাগুরা-২ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ওই বছর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে মাগুরা-২ আসন শূন্য হয়।
তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। ইসি উপনির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের কাছে অপমানজনক পরাজয়ের পর ক্ষমতাসীন দল জানত এ উপনির্বাচনে তাদের জিততেই হবে।
এরপর যা ঘটে, তা ছিল নির্লজ্জ কারচুপি। সেই ঘটনা বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচনের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
বিএনপি-প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলে আওয়ামী লীগ নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে।
তখন নির্বাচন কমিশন এ আন্দোলনকে গ্রাহ্য করেনি। তারা নির্বাচনকে 'অবাধ ও সুষ্ঠু' বলে অভিহিত করে।
সেই থেকে প্রতিটি নির্বাচনের ওপর ছায়া ফেলেছে মাগুরার এই অভিশাপ।
ব্যালট ভরার ঘটনাও বারবার দেখা গেছে, যার নামকরণ করা হয়েছে 'মধ্যরাতের নির্বাচন'।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ আসন কেড়ে নেয়নি। তারা বরং প্রকাশ্যেই সাত্তারকে ওই আসন উপহার দিয়েছে।
কোনো নায়ক পাওয়া যায়নি
হিরো আলমের বড় আকর্ষণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভোটের দিন তার অনুসারীদের একাংশের দেখাও পাওয়া যায়নি।
সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের জন্য এই নির্বাচনী সফর ভীষণ কঠিন ছিল। তিনি বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন।
নির্বাচনের একদিন আগে হিরো আলম সাহসিকতার সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এবারও তিনি যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকবেন।
তিনি বলেছিলেন, '২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় আমাকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল, কিন্তু এবার আমার প্রবল সমর্থন আছে, এবং আমি যেকোনো মূল্যে মাঠে থাকব।'
তার শক্তিশালী সমর্থন অবশ্য হারিয়ে গেছে এবং আরেকটি কম ভোটার উপস্থিতি দেখা গেছে।
এবার কোভিড ছিল না।
একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা বলেন, ভোটারদের আনার দায়িত্ব প্রার্থীদের। অসহনীয় মূল্যস্ফীতিতে কি ভোটাররা কেন্দ্রে আসার খরচ জোটাতে পারেননি?
কিন্তু কোভিডের আগে এবং অর্থনৈতিক সংকটের আগের ভোটার উপস্থিতি হার এত কম হওয়ার কারণ কী?
২০২০ সালের সিটি নির্বাচনের—প্রথম যেবার ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা হয়—তথ্য বলছে, মাত্র ২৭.১৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে গিয়েছিলেন, যা যেকোনো সিটি নির্বাচনে সর্বনিম্ন।
চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনেও এই চিত্র বদলায়নি। ২০০৫ সালে যেখানে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫৩.৬ শতাংশ, ২০২০ সালে তা ২২.৫ শতাংশে নেমে আসে।
মৃত ভোটারের ভোট পড়ার ঘটনাও ঘটেছে প্রতিবার। সম্ভবত ভূতের আঙুলের ছাপের অভাবের ফলে তারা ইভিএম ব্যবহার করতে পারছে না?
কিন্তু জীবিত, নিশ্বাস নিচ্ছেন যেসব ভোটার, তাদের কী হবে? ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য প্রার্থীদের ভোটার টানার ব্যর্থতা ছাড়াও রিটার্নিং কর্মকর্তারা শীতের তীব্রতাকেও দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন আরেকটি শিকার খুঁজে পেয়েছে—গণতন্ত্র।
নানা অসংগতি সত্ত্বেও, একটি জিনিস নিশ্চিত হয়েছে: জিতেছে সংবিধান। একটি আসন খালি হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করেছে নির্বাচন কমিশন। এখন তাদের পণ্যের গুণমান কেমন, সেটি পুরোপুরি আলাদা বিষয়।