করস্বর্গগুলোয় বছরে এক লাখ কোটি ডলার মুনাফা সরিয়ে নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2023/03/05/138629-ejwqerrgpw-1584707107.jpg)
যেসব দেশ বা অঞ্চল তাদের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে শিথিল কর নীতি অবলম্বন করে তারা হয়ে ওঠে 'কর স্বর্গ'। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা এসব অঞ্চলে তাদের মুনাফা রাখে কম করের সুবিধা নিতে। অনেকক্ষেত্রেই এসব অর্থ যেখান থেকে ব্যবসার মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে, সেই দেশ বা অঞ্চলের কর্তৃপক্ষকে করফাঁকি দিয়ে পাচার করা হয়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো অনেক আগে থেকেই কর স্বর্গের সুযোগ নিচ্ছে।
এবিষয়ে এক দশক আগে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলো বহুজাতিক সংস্থার অন্যায্যভাবে কর স্বর্গকে ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্মত হয়। এরই আওতায় করা হয় এক ১৫ দফা কর্মপরিকল্পনা, যাতে কর্পোরেট মুনাফার বৃহৎ অংশ কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে পাচারের প্রবণতা ঠেকানো যায়।
'কিন্তু, আমাদের সাম্প্রতিক হিসাবনিকাশ বলছে, এ নীতিটি কার্যকর হয়নি। ফলে বাহামা বা কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের মতো যেসব দেশে কর খুবই অল্প বা নেই বললেই চলে – সেসব স্থানে পুঁজি স্থানান্তরের আপদ দিন দিন আরো গুরুতর হচ্ছে' (কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক লুদউইগ ওয়্যার এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল জুকম্যান তাদের গবেষণার বরাতে বলেছেন)।
আমাদের প্রাক্কলন, ২০১৯ সালে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো তাদের নিজ দেশ থেকে কর স্বর্গগুলোয় প্রায় এক লাখ কোটি ডলার মুনাফা স্থানান্তর করেছে। ২০১৫ সালের ৬১ হাজার ৬০০ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও যা ছিল উচ্চ। যদিও এর মাত্র এক বছর পর গ্রুপ অব টোয়েন্টি-খ্যাত বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশ তাদের বৈশ্বিক কর স্বর্গ বিষয়ক অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করে।
নতুন গবেষণায় আমরা কর স্বর্গে বাণিজ্যিক সংস্থার ঘোষিত অতিরিক্ত মুনাফার পরিমাণ হিসাব করেছি। 'কর স্বর্গ' হিসেবে পরিচিত দেশে তারা যে মুনাফা ঘোষণা করেছে, তা যদি সেখানে বিদ্যমান কোম্পানির বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড – কর্মী সংখ্যা, কারখানা বা গবেষণা ইত্যাদির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়– তখনই তা অতিরিক্ত মুনাফা হিসেবে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ, এই মুনাফা ওই দেশে হয়নি। এসেছে কোম্পানির আয়ের অন্য কোনো উৎস থেকে। কাগজেকলমে দেখানো এই মুনাফা কর স্বর্গে বিপুল হারে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এবং কর্পোরেশনগুলো তা ১৯৮০'র দশক ধরেই করে চলেছে।
বৈশ্বিক প্রতিরোধ চেষ্টার কী অবস্থা
২০১২ সাল থেকেই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের অর্জিত মুনাফা কর স্বর্গে সরিয়ে নেওয়ার চর্চা ঠেকানোর উদ্যোগ শুরু হয়। ওই বছরের জুনে মেক্সিকোর কাবোসে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনের বৈঠকে বিশ্বনেতারা এ বিষয়ে একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন।
গণতান্ত্রিক ও বাজার-অর্থনীতির ৩৭ দেশের জোট- অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এরপর ১৫টি পদক্ষেপের একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। তখন ধারণা করা হয়েছিল, এগুলো কার্যকর হলে কর্পোরেটদের কর ফাঁকির সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। এরমধ্যে সর্বজনীন একটি আন্তর্জাতিক কর বিধিমালা চালু এবং করস্বর্গগুলোর ক্ষতিকর কর বিধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাবও ছিল।
২০১৫ সালে জি-২০ আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে। পরের বছর থেকেই বিশ্বব্যাপী এর বাস্তবায়ন শুরু হয়।
কর্পোরেট কর ফাঁকির বিভিন্ন গোপনীয় দিক এরপর উঠে এসেছে পানামা পেপার্স ও প্যারাডাইজ পেপার্সের মতো ফাঁস হওয়া নথিতে। এতে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্ধ হয় জনগণ; চাপের মুখে ইউরোপের দেশগুলোও উদ্যোগী হয়।
তবু মুনাফা স্থানান্তর কেন বেড়েছে
কিন্তু, আমাদের গবেষণা বলছে, এসব প্রচেষ্টার প্রভাব সামান্যই হয়েছে।
আমরা জানতে পেরেছি, বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলো ২০১৯ সালে তাদের মোট মুনাফার ৩৭ শতাংশ বা ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি ডলার তাদের সদর দপ্তর যে দেশে তার বাইরে কর স্বর্গে সরিয়েছে। যা ২০১২ সালে করা ২০ শতাংশের চেয়েও বেশি, যেবছর বিশ্বনেতারা প্রথম করফাঁকি কমানোর উদ্যোগ নেন। অথচ ১৯৭০'র দশকে কর স্বর্গে মুনাফা পাচার ২ শতাংশেরও কম ছিল। এরপর বিপুল হারে তা বেড়েছে ১৯৮০'র দশকে কর ফাঁকি দেওয়ার মতো বিভিন্ন আইনি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা করফাঁকি সহায়ক শিল্পের দৌলতে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের নীতিও উচ্চ করের দেশ থেকে করস্বর্গ দেশগুলোয় মুনাফা সরিয়ে নেওয়াকে সহজ করে তোলে।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/03/05/screenshot_1_0.png)
ফলে ২০১৯ সালে অর্জিত মোট বাণিজ্যিক আয়ের ১০ শতাংশের ওপরই কর আদায় করা যায়নি। ১৯৭০'র দশকে যা ছিল শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।
২০১৯ সালে বৈশ্বিক সরকারগুলো ২৫ হাজার কোটি ডলার কর আদায় হারিয়েছে। এরমধ্যে অর্ধেক কর ফাঁকির জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। এরপরে রয়েছে যথাক্রমে যুক্তরাজ্য ও জার্মানি-ভিত্তিক কর্পোরেশন।
![](https://www.tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/03/05/screenshot_1_1.png)
বৈশ্বিক ন্যূনতম কর
বলাইবাহুল্য নীতিনির্ধারকদের জন্য এই সমস্যা মোকাবিলা বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। তবে সরকারগুলো আপাত সহজ সমাধানের পথেই হেঁটেছে পর্যায়ক্রমে কর্পোরেট কর হ্রাসের মাধ্যমে। তারা আশা করেছে, এতে কর স্বর্গে মুনাফা পাচার কমবে। ফলে গত ৪০ বছরে বৈশ্বিকভাবে কার্যকর বাণিজ্যিক কর গড়ে ২৩ শতাংশ থেকে কমে ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, এই ঘাটতি পূরণে ভোক্তা কর বাড়ানো হয়েছে। এই ধরনের কর সাধারণ ভোক্তাকে দিতে হয়, তাই এটা যেমন পশ্চাদমুখী তেমনই বাড়ায় বৈষম্য ।
সহজ প্রশ্ন, কর্পোরেশনকে দেওয়া নিম্ন করের সুবিধার নেতিবাচক পরিণতি কেন ভোক্তা বহন করবে? আর তাতেও তো কমছে না কর ফাঁকি। তবে কেন এই অন্যায্যতা?
এখানে মূল সমস্যা হলো- কর স্বর্গ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর অস্পষ্ট ও অস্বচ্ছ কর নীতি এবং নিম্ন কর হার। তাই সব দেশ যদি বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি ন্যূনতম করহার চালু করতে (ধরা যাক অন্তত ২০ শতাংশ) একমত হয়, তাহলেই এ সমস্যার অনেকাংশে সমাধান হবে। কর স্বর্গ বলেও কোনো কিছুর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
২০২১ সালে এমন এক ব্যবস্থার পক্ষেই সই করেছে ১৩০টি দেশের সরকার। ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বৈশ্বিক এ করহার চালু হতে চলেছে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল থেকেই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ শীর্ষ অনেক অর্থনীতি এতে অংশ নিচ্ছে। তবে প্রধান বাধা যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন বৈশ্বিক এ কর চালুর বিষয়ে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিলেও, এখনও মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে এর পক্ষে কোনো আইন পাশ করতে পারেনি।
কিন্তু, আমাদের গবেষণা বলছে, প্রধান অর্থনীতিগুলোকে যেভাবেই হোক বৈশ্বিক কর সংস্কারের অগ্রভাগে থাকতে হবে। যাতে কর স্বর্গে চলে যাওয়া বিপুল এ অর্থপ্রবাহকে থামানো যায়। এতে সরকারগুলো বৈধ মুনাফার ওপর রাজস্ব যেমন আদায় করতে পারবে, তেমনি সমাজের জন্য তৈরি হবে ব্যবসা পরিচালনা ও আর্থিক মূল্য সৃষ্টির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
লেখকদ্বয়: লুদউইগ ওয়্যার কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির প্রভাষক এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক গ্যাব্রিয়েল জুকম্যান।