হোয়াইট হাউসে বিতর্কে কিশোরের রেকর্ড: যেভাবে বোকা বনল দেশের গণমাধ্যম
গত ২৯ মার্চ দেশের বেশ কিছু প্রথম সারির গণমাধ্যম বাংলাদেশি এক স্কুলছাত্র হোয়াইট হাউস আয়োজিত মার্কিন সরকারের এক ভার্চুয়াল সংসদীয় বিতর্কে অংশ নিয়ে সব রেকর্ড ভেঙেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে।
ওই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, ১৭ বছর বয়সী ওই ছেলেটি টানা ১৪৪টি বিতর্কে জয়লাভ করার মাধ্যমে আগের যেকোনো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে কোনো বুলিয়িংয়ের শিকার হওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড তার নাম এ প্রতিবেদনে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছে। তবে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে ইতোমধ্যে মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করা শুরু করেছেন।
দিনাজপুরের এ ছেলেটি 'শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার' বলে কিছু কিছু প্রতিবেদনে জানানো হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৫৩৪ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে সে শ্রেষ্ঠ বিতার্কিকের খেতাব অর্জন করে বলে এসব প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ ধরনের ভাইরাল কন্টেন্ট অনেক গণমাধ্যমই লুফে নেয়। এ ছেলেটির ক্ষেত্রে পুরো ঘটনাটিই ছিল অসত্য। হতে পারে এটা ছিল পুরোদস্তুর একটি প্রতারণা অথবা পুরোটাই তার কল্পনাপ্রসূত।
ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে সন্দেহের মাত্রা আরও প্রকট হয়। তার মিথ্যা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করে।
বানোয়াট বিজয়
ছেলেটার সঙ্গে কথা বলার সময় বেশকিছু ধোঁয়াশার দেখা মেলে।
প্রথমত, ওই বিতর্ক প্রতিযোগিতার কোনো ছবি ছিল না। ওই অনুষ্ঠানের কোনো স্ক্রিনশটও দেখাতে পারেনি সে।
'আমি কোনো ছবি তুলিনি, কারণ আমার মনে হয়নি আমি শেষ পর্যন্ত জিতব,' বলল সে।
খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে মেডেল পরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে নিজের পাসপোর্ট না থাকায় তা সম্ভব হয়নি, জানাল সে।
নিজের বিজয়ের প্রমাণ হিসেবে সে গণমাধ্যমগুলোতে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও পাঠায় — দাবি করে, ওই বিজ্ঞপ্তিটি হোয়াইট হাউসের।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির প্রথম লাইনে লেখা ছিল, 'প্রতি নির্বাচনের বছরগুলোতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার সংসদীয় বিতর্কের আয়োজন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ নেতাদের আধুনিকায়ন ও তাদের খুঁজে বের করার জন্য হোয়াইট হাউস সাধারণত প্রতি বছর একটি ব্রিটিশ সংসদীয় বা এশীয় সংসদীয় বিতর্কের আয়োজন করে।'
ইংরেজি ভাষার এ সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাকরণগত অনেকগুলো ভুল ছিল। এছাড়া এটিতে হোয়াইট হাউসের কোনো লোগো বা স্বাক্ষরও ছিল না।
আরও স্পষ্ট ব্যাপারটি হচ্ছে, ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিটি যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, তার ঠিকানা হচ্ছে http://whitehouse.gov.unaux.com। কিন্তু হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটের প্রকৃত ঠিকানা হলো হোয়াইটহাউস ডটগভ।
আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ওই ওয়েবসাইটটি তৈরি করা হয়েছে ওয়ার্ডপ্রেস ব্যবহার করে।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও দাবি করা হয়, রাশিয়ার হল্যান্ড লপ মিশিগান নামক একজন সেরা বক্তা হয়েছেন।
তবে হল্যান্ড লপ মিশিগান কোনো রুশ নাম নয়। বরং এটি খরগোশ প্রজনন বিষয়ে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের কিছু ব্যক্তির একটি ফেইসবুক গ্রুপ।
দ্বিতীয় আরেকটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিতর্ক প্রতিযোগির একটি ছবি অবশ্য দেখা যায়। কিন্তু গুগলে সাধারণ রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা যায়, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে।
দুটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রদর্শন করা ওই ওয়েবসাইটটির দ্বিতীয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ওয়েবাসাইটটি আগামী ২৮ মার্চের পর সরিয়ে ফেলা হবে।
ওয়েবসাইটটি ঘুরে দেখা যায়, এটির সঙ্গে হোয়াইট হাউস সম্পর্কিত আর কোনো সংস্থার কোনো সম্পর্ক নেই।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বিষয়টি নিয়ে মার্কিন দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত মুখপাত্র ব্রায়ান শিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি বলেন, 'এ ধরনের কোনো প্রোগ্রাম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্যের জন্য আমি আপনাকে হোয়াইট হাউসে যোগাযোগ ও হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইট দেখার জন্য বলব। আপনি আমাকে যে ঘোষণাটি পাঠিয়েছেন, এটি দেখে আসল মনে হচ্ছে না। যেমনটা আপনি বলেছেন, এখানে হোয়াইট হাউসের কোনো লোগো নাই। পাশাপাশি এটি "ডটকম" সাইট, যেখানে হোয়াইট হাউস "ডটগভ" ঠিকানা ব্যবহার করে।'
এ ধরনের কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিয়ে হোয়াইট হাউসের ওয়েবসাইটেও কোনো তথ্যের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনের ইনস্টাগ্রাম পাতায়ও কোনো মেডেল বিতরণ অনুষ্ঠানের ছবি পাওয়া যায়নি।
এতেই নিশ্চিত হওয়া যায়, পুরো ব্যাপারটাই ছিল আগাগোড়া প্রতারণা।
প্রতারক নাকি প্রতারণার শিকার?
কোনো পেশাদার প্রতারক এ বিতর্ক প্রতিযোগিতা ব্যবহার করে ছেলেটির কাছ থেকে অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা করেছে কি না এমন সন্দেহও ছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সে জানায়, প্রতিযোগিতার জন্য সে কোনো নিবন্ধন ফি জমা দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেওয়ার কথা ছিল না।
নিজের ফেইসবুক পেইজে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার হওয়া তার সাফল্যের গল্পের অনেকগুলো লেখা শেয়ার করেছে সে।
ফেইসবুকে প্রতিযোগিতায় লাভ করা কিছু সার্টিফিকেটের ছবিও উন্মুক্ত করেছে সে। এ সার্টিফিকেটগুলো দেখলেই বোঝা যায় এগুলো দায়সারাভাবে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরও জাল করা হয়েছে ওই সব সার্টিফিকেটে।
বিষয়টি নিয়ে ছেলেটি ও তার মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
তারা সবাই জানিয়েছেন, ছেলেটি প্রতারণার শিকার।
ছেলেটির দাবি, সে আদতেই একটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। তবে সেটি আসল না ভুয়া ছিল তা সে জানত না।
'এটা নিয়ে কথা বলতে চাইনা। কিন্তু আমি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি এবং আয়োজকেরা আমাকে সার্টিফিকেট পাঠিয়েছেন। ওই সার্টিফিকেটগুলো আমার কাছে আসল মনে হয়েছিল,' সে জানায়।
তার মা জানান, 'সে একজন বিতার্কিক। আর ১০টা প্রতিযোগিতার মতো সে এটাতেও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু এর সত্য-মিথ্যা নিয়ে আমার ছেলে কিছু জানত না। আমরা প্রতারণার শিকার।
'আমরা কিছু সার্টিফিকেট পেয়েছি যেগুলো আমার ছেলে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করেছে। অনেক গণমাধ্যম কোনো কিছু যাচাই না করেই ওই খবর প্রকাশ করেছে।'
এ অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে ছেলেটির পড়ালেখা ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে জানিয়ে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে তার পরিবার।