বই সংগ্রহই তাদের নেশা!
বই পড়লেই যে তা সবার সংগ্রহে থাকবে, এমনটা একেবারেই নয়। মার্ক টোয়েনের বই স্তূপ হয়ে থাকতো। কিন্তু এর বেশিরভাগই তার বন্ধুদের থেকে ধার করা বই। অবশ্য সেসব ধার করা বই দিয়েই তার বিশাল লাইব্রেরি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অনেকে আছেন, বই পড়লেও যাদের সংগ্রহ নেই। তারা হয়তো ধার করে বা হালের যুগে অনলাইনেই বই পড়ছেন। অনেকে আবার পড়ার পর বিক্রিও করে দিচ্ছেন।
তবে বই যারা সংগ্রহ করেন, তাদের কাছে বই পড়া বাদেও, বই সংগ্রহ করা আলাদা একটি নেশা। এই নেশা একপর্যায়ে বই পড়াকে ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ, বই হয়তো তারা নিয়মিত পড়ছেন না, কিন্তু কিনছেন ঠিকই। মাসে হয়তো এক কি দু বার বই হাতে নিচ্ছেন। অথচ নতুন বই একদিনে বিশটা কিনে ফেলতেও দ্বিধা করছেন না!
কারণ ঐ যে, বই পড়ি বা না পড়ি, সংগ্রহ করা চাই। নতুন বা আকর্ষণীয় বই দেখলেই সেটা নিজের করে নেওয়া চাই!
আজ এমনি কয়েকজন বইপ্রেমীদের কথা বলবো। যারা শুধু বই পড়েইনি, সেইসাথে তাদের বইয়ের সংগ্রহও বিশাল। তবে, এখন তারা যতটা না পড়েন, তারচেয়ে বেশি কেনেন।
বই পড়ার সময় ডায়েরী কলম নিয়ে বসেন তিনি
বই সংগ্রহকারীদের একজন হাসান শিবলী। পাঁচ বছর বয়স থেকেই জানালার গ্রিল দিয়ে বেয়ে পুরোনো পত্রিকাগুলো আলমারির উপর থেকে নামিয়ে পড়তেন তিনি। একটু বড় হয়ে ক্লাস টু-থ্রিতে থাকার সময়ই ফাইভ সিক্সের বাংলা বইয়ের সব গল্প পড়া শেষ তার। ছোট থেকেই বই পড়ার বেলায় কোনো বাছ বিচার করতে যাননা তিনি। সামনে যা পান, পড়ে ফেলেন। এই তো একবার নীলক্ষেতে ফুটপাতে পড়ে থাকতে দেখলেন, 'এনসাইক্লোপিডিয়া স্টুপিডিটি'। মানুষ কতরকম বোকামো করতে পারে তার একটি সংগ্রহ। খুব মজা পেলেন বইটা পড়ে। অন্য আর দশটা সাধারণ মানুষের এসব অদ্ভুত বইগুলোর প্রতি আগ্রহ না থাকলেও, শিবলী ঠিকই পড়ে মজা পান। যাবতীয় নতুন জিনিস জানায় তার সর্বদা আগ্রহ। তা সে যে বিষয়ই হোক না কেন। তবে হ্যাঁ, ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় শীর্ষে আছে উপন্যাস, কবিতা আর প্রবন্ধ।
পরিবারের সবার ভাগ মিলিয়ে এখন প্রায় পনেরো হাজার বই আছে শিবলির সংগ্রহে। বইও যে সংগ্রহের বিষয় তা বাবার থেকেই শেখা তার। তাই যেমন পড়ার জন্য কিনেছেন, তেমন সংগ্রহের জন্যও কিনেছেন। তবে এই যে বিশাল বইয়ের সমাহার, এত বই কি তার পড়া হয়েছে?
উত্তরে জানান, 'আমার সংগ্রহে প্রায় হাজারখানেক উপন্যাস আছে, কিন্তু পড়া হয়তো হয়েছে একশোটা।'
মূলত ব্যস্ততা, পরিবার সবকিছুর পর সময়টা বের করা মাঝে মাঝে কঠিন। আর লেগে থাকার ধৈর্য্যটাও কমে গেছে। এখন আর একটা বই পড়ে শেষ করে, আরেকটা বইয়ে হাত দেওয়া হয়না। বরং একসাথে তিন চারটা বই নিয়েই বসা হয়। এতে সময় লেগে যায় অনেক বেশি। পড়াও হয় কম।
তবে বই পড়ার অভ্যেস তার অন্য সবার মতো না। আগের তুলনায় এখন অনেক কম বই পড়া হলেও বই পড়ার ধরনে আসেনি কোনো হেলাফেলা।
জাপানিজ চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়া একবার বলেছিলেন, বই পড়তে দরকার কাগজ আর কলম; যেন সব টুকে ফেলা যায়। শিবলীও তা-ই করেন। সবসময় কাগজ আর কলম রাখেন বই পড়ার সময়। যেন প্রয়োজনীয় তথ্য টুকে ফেলতে পারেন। যা পড়েন, দরকারি বা পছন্দের লাইনগুলো টুকে ফেলেন। এখন নিজের গবেষণার কাজেই এই টুকে রাখা ডায়েরী থেকে টুকটাক তথ্য নিতে পারছেন।
তবে, বইয়ের সংখ্যা এত বেশি হয়ে যাওয়ায় এগুলোর যত্নআত্তি নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে এখন। না হয় বই পড়া, না হয় বইগুলোর যত্ন নেওয়া। ঘরভর্তি বইয়ের ভিড়ে মাঝে মাঝে গঞ্জনাও শুনতে হয়। কিন্তু তাতে শিবলী থেমে নেই।
বই কেনার অভ্যেস এখনো চলমান। এতটুকু চিড় ধরতে দেননি তাতে। রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে কোনো বই পছন্দ হলেই কিনে ফেলেন। একসাথে ৩০টা বই কেনার রেকর্ডও আছে তার। তবে এখন নাকি আর সব একসাথে নিয়ে ঘরে ঢোকেন না। পাছে বকা খেতে হয়! তাই বেশি বই হয়ে গেলে অফিসে নিয়ে যান। এরপর প্রতিদিন একটা দুটা করে বাসায় নিয়ে ঢোকেন…
পড়ার চেয়েও বিভিন্ন এডিশন, প্রচ্ছদ সংগ্রহে রাখাই যখন নেশা
শিবলীর মতো কোথাও কোনো বই পছন্দ হলেই কিনে ফেলেন জুনাইদ। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে শিক্ষকতা করছেন।
ছোটোবেলায় দাদু গল্প পড়ে শোনাতেন। মুখে মুখে শুনেই ঠাকুমার ঝুলি, বিভিন্ন বাচ্চাদের বই, এডভেঞ্জারের গল্পগুলো জানা হয়ে গিয়েছিল জুনাইদের। তখন থেকেই গল্পের প্রতি এক আগ্রহ তৈরি হয়। এছাড়া বাসার সবাই অল্পবিস্তর বই পড়তেন। কেজি টুতে পড়ার সময় থেকেই বই পড়ার অভ্যেস। ছাত্র থাকাকালীন নিউমার্কেট থেকে বই কিনতেন, আবার পুরোনো কিনতে হলে অন্যদের মতো নীলক্ষেতে ঢুঁ মারতেন।
এখন বেশি কেনা হয় অনলাইনেই। কোনো এক লেখককে ধরে তার সবগুলো বই সংগ্রহ করতে চেষ্টা করতেন। ক্লাস এইটে থাকতেই তিন গোয়েন্দা, অনুবাদ, সেবা প্রকাশনীর বই, হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো পড়া হয়ে যায় তার। কমিক বইয়ের প্রতি একটা ঝোঁক ছিল ছোটোবেলা থেকেই। খুব বেশিনা, তবে খুব দুর্লভ কিছু সংগ্রহ তার রয়েছে। যেমন- ওলভেরাইন, অ্যালেন মুরের মিরাকেলম্যান, ব্রায়ান মিশেলের ডেয়ারডেভিল, ব্যাটম্যান ভার্সেস প্রিডেটর, সোয়াম্প থিং, নিউ এক্সমেনের সম্পূর্ণ সিরিজ তো আছেই। সাথে ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ব্যাটম্যান, দ্যা ভ্যাম্পায়ার ক্রনিকেলস, স্পাইডারম্যান এন্ড ওলভেরাইনের মতো বিখ্যাত কিছু কমিকের প্রথম এডিশন তার আছে। তাছাড়া স্টিফেন কিংয়ের যে বিশাল সংগ্রহ তার আছে, তা এই দক্ষিণ এশিয়ায় খুব কম জনের কাছেই আছে বলে জুনাইদের বিশ্বাস।
আগে যেখানে মাসে তিন চারটে বই পড়তেন। এখন মাসে তিনশো পৃষ্ঠার বইও পড়া হয় না। এটা অনেকটাই কমেছে ব্যস্ততার কারণে। তবে, বই শুধু পড়ার জন্যই কিনতেন না তিনি। বইয়ের যত্ন নিতেও ভালোবাসতেন। সেই কেজি টু থেকেই বইয়ের ব্যাপারে খুব যত্নশীল জুনাইদ। একদম যেখান থেকে বই বের করতেন, সেখানেই উঠিয়ে রাখতেন তিনি।
এখন বই পড়া না হলেও, এত সুন্দর সাজানো গোছানো আলমারি ভর্তি বই দেখলেই একটা গর্ব কাজ করে মনে মনে। বই পড়া হোক বা হোক, বই সংগ্রহ এখনো চলছে। একই বই নতুন প্রচ্ছদে এলে, বইয়ের কভার বা বিশেষ কোনো এডিশন ভালো লাগলেই কিনে ফেলেন তিনি। একইসাথে এত দুর্লভ এডিশন এবং সুন্দর প্রচ্ছদের এত দারুণ সংগ্রহ থাকায় নিজেকে ভাগ্যবানও মনে করেন জুনাইদ। শোপিস বা আর্ট দিয়ে যেমন মানুষ ঘর সাজায়, জুনাইদের কাছে বইও হলো তেমন এক অনুষঙ্গ।
'তুমি বই নিয়ে বাসায় চলে যাও'
জুনাঈদের মতো বই সাজানোর পেছনে এত শক্তি সময় দেন না শামসুল আলম (৬৭)। আগে যখন শক্তি ছিল, বয়স ছিল নিজ হাতে যত্ন করতেন ঠিকই। কিন্তু এখন আর সে শক্তি, ইচ্ছে হয়না তার। বইগুলো একপ্রকার স্তূপ আকারেই রাখা তার বাসায়। বসার ঘর, শোবার ঘর ঘরের প্রায় সবখানেই তার বইয়ের সমাহার। আলমারি, মাটি সবেতেই বইয়ের ছড়াছড়ি। প্রায় আট দশ হাজার বই পাওয়া যাবে তার সংগ্রহে।
শামসুল আলমকে সবাই স্যার হিসেবেই চেনে। ঢাকা সিটি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। একবছর হবে অবসর নিয়েছেন। ঢাকার নিউমার্কেটের আশেপাশেই থাকেন। কিন্তু শামসুলের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা একদমই অজপাড়াগ্রামে। ফলে বই পড়ার অভ্যাস এবং কেনার মতো সুযোগ, কোনোটাই সেখানে ছিল না। তবে স্কুলের লাইব্রেরি ঘরটা তাকে টানতো। কতশত বই রাখা সেখানে! কিন্তু সাহস হতো না ওখানে গিয়ে বইগুলোতে হাত দেওয়ার। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর সে সুযোগ হয়। লাইব্রেরি কার্ডের সুবাদে শুরু হয় লাইব্রেরিতে বসে বসে পড়া। তার আগ্রহ দেখে লাইব্রেরিয়ানও তাকে ব্যাগ ভরে বই দিয়ে দিত। যেন বাসায় গিয়ে পড়তে পারে।
বড় হয়েও এই লাইব্রেরিতে পড়ার অভ্যাস তার যায়নি। সাহিত্যের প্রতি ভালো লাগা তো ছোটো থেকেই ছিল। এরপর সাহিত্য নিয়ে পড়ার সুযোগ পাওয়ায় শামসুলের যেন ষোলোকলা পূর্ণ হলো। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হন। সেখানে তার রুমমেট সারাদিন পড়ার বই মুখস্থ করতেন, আর শামসুল আলম মেতে থাকতেন সাহিত্য নিয়ে। প্রতিদিন ক্লাস শেষ হওয়ার পর লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে লাইব্রেরিয়ানও বিরক্ত হয়ে বলতো, 'তুমি বই নিয়ে বাসায় চলে যাও'।
গ্রামে থাকায় বই কিনে পড়ার অভ্যাসটা তেমন তৈরি হয়নি। বই কিনে পড়া শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে। বই কেনার সাথে শুরু হয় নীলক্ষেত ঘিরে আড্ডাও। সময়টা তখন ৭৬ সালের শেষদিকে। নীলক্ষেতে একদিন ফুটপাতে পেয়ে গেলেন গ্যে রোক্সেনের 'হাংগার' বইটি। একাডেমিকের বাইরে ইংরেজি বইয়ের সাথে তার সখ্যতা শুরু হয় এ বই দিয়েই। কেননা মফস্বলে ইংরেজি বই তেমন পাওয়া যেত না।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে প্রথম দু বছর মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। এরপর এসে যোগ দেন ঢাকা সিটি কলেজে। কলেজের কাছেই বাসা নিয়ে নেন। ফলে নীলক্ষেত আর নিউমার্কেট এসে পড়ে হাতে কাছেই। পুরোনো বই কিনলে নীলক্ষেত আর নতুন বই কিনলে নিউমার্কেট।
কিন্তু সামান্য শিক্ষকতা দিয়ে সংসার খরচ চলতো না। তাই বাসায় ব্যাচ পড়াতেন। প্রতিদিন কলেজ শেষে বাসায় যাবার সময় একবার ঢুঁ মেরে যেতেন নীলক্ষেত, আবার ব্যাচ পড়ানো শেষে সন্ধ্যায় আরেকবার আসতেন। দোকানদাররাও চিনতেন তাকে। তার পছন্দের বই আসলে উঠিয়ে রাখতেন। 'স্যার এসে কিনবে'। দামাদামিও চলতো না।
শুধু কি বই কেনা? আড্ডাও চলতো দেদারসে। মহাদেব সাহা, অসীম সাহা, আহমেদ ছফা, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ আর তরুণদের মধ্যে রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, তসলিমা নাসরিন, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিরা থাকতেন এই আড্ডায়। তবে অন্যদের তুলনায় শামসুল আলমের আড্ডায় অংশগ্রহণ কম ছিল। যখন অন্যরা বই কিনে আড্ডা দিত, একে অপরের বই নিয়ে আলোচনা করত, শামসুল তখন নীলক্ষেতের এ মাথা থেকে ও মাথা শুঁকে বেড়াতেন বইয়ের গন্ধ। আর দেখতেন নতুন কী কী বই আসলো, কোথায় কত পুরাতন বইয়ের এডিশন এসেছে। গোটা নীলক্ষেত ছিল তার নখদর্পণে।
কবিদের সাথে আড্ডাই না কেবল, নিজেও কবিতা লিখতেন বিভিন্ন ম্যাগাজিনে। ছদ্মনাম ছিল দীপঙ্কর মাহমুদ। পরে বইও লিখেছেন একটা। 'বজ্রের ফুল, ফুলের শিশির' ছিল বইটির নাম। এখন কবিতা লেখা একদম আর হয়না। তবে কবিতা পড়া হয় টুকটাক। হাতের কাছে কবিতার বইটুকু রাখেন। শরীর স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে বই কেনাও যেমন কমে গেছে, পড়াও কমে গেছে।
কিন্তু একসময় বই কেনার জন্য টাকা উপার্জনও করতে হয়েছে। ব্যাচ পড়িয়ে পড়িয়ে স্বচ্ছলতা কিছুটা এসেছিল। কিন্তু সে স্বচ্ছলতা বাড়ি, গাড়ি বা অন্য কোনো বিলাসের পেছনে ব্যয় করতে দেননি। তিনি বলেন, 'আমার অন্য কলিগরা, বন্ধুবান্ধবরা কিনেছে বাড়ি গাড়ি, আর আমি কিনেছি বই, শুধুই বই।'
একদিকে বই বিক্রি, অন্যদিকে বই খরিদ
'যতবার কেউ নোবেল পুরস্কার পায়, দেখা যায় তার কোনো না কোনো বই আশরাফুল ভাই নিজেই বের করে দেখান।' আশরাফুল আলমকে নিয়ে এই জনশ্রুতি তার পরিচিতদের মধ্যে পাওয়া যায়। বিদেশি সাহিত্য, বিশেষত লাতিন আমেরিকান, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ, জার্মান, পোলিশ (পোল্যান্ড এর) বইগুলো তার বেশি পড়া হয়।
ক্লাস থ্রি থেকেই বই পড়েন। তবে পার্থক্য হলো, তখন গল্পের বই পড়তেন আর এখন সব পড়েন। তবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বই পড়া এবং দেখভাল করা দুটোতেই এসেছে বিদায়ের হাতছানি। প্রায় দশ হাজার বইয়ের সংগ্রহ থেকে গত দুই বছরে তিনি অর্ধেকেরও বেশি বই বিক্রি করে দিয়েছেন। এই বইগুলো পড়ারও কেউ নেই, আগেরমতো যত্ন নেওয়ারও কেউ নেই। পড়া হয়না বলে বইগুলো কিছুটা বোঝার মতোই ঠেকছে এখন। এমনকি হুট করে যদি কোনো বই পড়তে ইচ্ছে হয়, খুঁজে বের করাও মাঝে মাঝে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তাই বইগুলোকে এখন একটা সুব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে চান।
একাডেমিক কাজে অনেকেই এসে বই নিয়ে যান। তবে এমন করে অনেক বই-ই হারিয়েছে তার। তাই সহসা বই কাউকে আর দিতে চান না। আর নিজের দুর্লভ সংগ্রহের ওপর কারও নজরও লাগতে দেন না!
বই নিয়ে আশরাফুল আলম বরাবরই বেশ দখলদারী মনোভাবের ছিলেন। এখনো তাই। নিজের বয়স এবং শারীরিকভাবে এত অসুস্থতার পরও কোনো ছাড় দেননি বইয়ের ব্যাপারে। এখন আর নীলক্ষেতে আড্ডা হয়না, পল্টন, বিজয়নগর, সদরঘাট থেকে বই কেনাও হয়না। যতটা কেনা হয় তা আমাজন বা বইয়ের জাহাজের মতো অনলাইন ভিত্তিক দোকানগুলো থেকেই। আর বই পড়া তো আরও কমেছে। কিন্তু এখনো বই দেখলে বই কেনার লোভ সামলাতে পারেন না আশরাফুল আলম। এতদিনের অভ্যেস তো এত সহজেই যাবেনা। তাই পড়া হোক বা না হোক বই দেখলেই কিনে ফেলেন।
কিন্তু একইসাথে বইগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবনা চিন্তা করছেন। এত বছরের এই বিশাল সংগ্রহের ওপর মায়া পড়ে গেছে আশরাফুল আলমের। এই বিশাল লাইব্রেরি তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনে দিতে হয়েছে বহু শ্রম, বহু সময় আর সেই সঙ্গে ঢালতে হয়েছে বিপুল অর্থ।
লাইব্রেরির ৪০শতাংশ বই পড়া বাকি…
অবসর সময়ে মাকে ঘরে বসে পড়তে দেখতেন সাকু চৌধুরী। পাড়ার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে এসে মা বই পড়তেন, বেগম-উদয়নের মতো বিভিন্ন পত্রিকা- ম্যাগাজিনগুলো আসতো তার মায়ের কাছেই। অন্যদিকে বাবা জড়িত ছিলেন বাম রাজনীতির সাথে। তার হাতেও দেখতেন সবসময় বই। বাবা মায়ের মতোই ছোটো থেকে বই তিনি কাছে পেয়েছেন সবসময়।
মধ্যবিত্ত পরিবার, খুব একটা স্বচ্ছলতা ছিল না। শখ বলতে ছিল শুধুই 'বই পড়া'। বাড়িতে শৌখিন বস্তু বলতেও কেবল বই।
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে বই কিনতে যেতেন। এরপর একটু বড় হলে নিজেই টাকা জমিয়ে কিনতেন বই। প্রতিদিন কলেজে না ঢুকলেও নীলক্ষেতে ঢুকতেন ঠিকই। বাড়িতে বই পড়া নিয়ে উৎসাহ দেওয়া হলেও, বইয়ের খরচ যোগাড় করতে বেগ পেতে হতো অনেক। তাই টিফিনের টাকা, খরচের টাকা থেকে জমিয়ে জমিয়ে কিনতেন বই। যেমন, চৌরঙ্গী বইটি কেনার সময় এক সপ্তাহ নাকি স্কুলে যাননি সাকু।
বইয়ের প্রতি তার এই লোভ একদম ছোটোবেলা থেকেই। তখন ১৯৯০ সাল। সোভিয়েত থেকে বই আসা বন্ধ হয়ে গেছে। তাই রুশ বইগুলো সব অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে টিএসসির শিবমন্দিরে। মূল বইয়ের গায়ে লিখে রাখা হয়েছে বইয়ের অর্ধেক দাম। অর্ধেক দামে বই বিক্রি হলেও, সাকু চৌধুরীর কাছে সব মিলিয়ে একশো টাকাও নেই। সে লক্ষ্য করলো, প্রতিটি বইয়ের গায়ে পেন্সিল দিয়ে দাম লেখা রয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় এলো দুষ্টু বুদ্ধি। এক মিনিট ভাবলেন; যদি বইগুলোর দাম রাবার দিয়ে মুছে কমিয়ে লেখা যায়, তবে অনেকগুলো বই-ই তিনি কিনতে পারবেন।
সে অনুযায়ী কাজও সেরে ফেললো সাকু। বইয়ে লেখা দাম মুছে তাতে বসিয়ে দিলো নতুন দাম। বই বিক্রেতা তো মাথায় হাত, বইগুলোর দাম এত কম কেন?
কিন্তু কী আর করা। দাম যেহেতু লেখা, সুতরাং এই দামেই দিতে হবে। এভাবে ১৫-২০টার মতো বই নিজের ঝোলায় ঢুকিয়ে নিলেন সাকু চৌধুরী।
পরের দিন সেখানে গিয়ে সাকু দেখেন, বইয়ের ওপর দামগুলো সব কলমেই লিখে রাখা। বুঝলেন, চোরকে ধরতে না পারলেও, চুরিবিদ্যা ধরা পড়েছে ঠিকই। তাতে কি! নিজের যা যা পছন্দের ছিল, সবই তো আছে সেই ঝোলায়।
রুশ বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা জন্মেছিল বাবার বদৌলতে। তখন তো ঢাকায় সোভিয়েত বইয়ের যুগ। ফলে বামপন্থী পার্টি অফিসগুলোতেও আসতো অনেক ধরনের রুশ বই। বাবা বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেই বইগুলো পড়ার সুযোগ হতো সাকুর। বাসাতেও ছিল রুশ বইয়ের বিশাল সংগ্রহ।
সে বইয়ের ভাণ্ডার আজ প্রায় সাড়ে তিন বা চার হাজার ছুঁইছুঁই। বই পড়ার নেশা এবং কেনার নেশা কোনোটাকেই বাদ দিতে পারেননি। তবে আগে বইয়ের পৃষ্ঠা, প্রচ্ছদ এসব নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, কিনতে পারলেই হতো তার। এখন এদিকে কোনো ছাড় দেন না। একদম অরিজিনাল বই চাই তার। নতুন বই আগুনে সেঁকে নিয়ে, তাতে ওষুধ দিয়ে প্রতিটি বই পলি করে আলমারিতে তুলে রাখেন তিনি। আবার প্রতি মাসে একবার পরিস্কার করে নেন তাকগুলো। বইয়ের যত্নে হেলাফেলা করেন না কখনোই।
পড়ার চেয়ে বই কেনা যেন বেড়ে গেছে বহুগুণ…
বাসায় যেহেতু বইচর্চার বিষয়টি তেমন ছিল না, তাই বই কিনতে কিছুটা বেগ পেতেই হতো মেহেদীকে। স্কুলে যাওয়া আসার টাকা জমিয়ে, জন্মদিন বা ঈদে বাবা মায়ের কাছে বই আবদার করতেন তিনি।
কলেজে থাকাকালীন প্রায়সময় কোচিং বাদ দিয়ে রাজশাহী নিউ মার্কেটের ভিতরে এক কোণায় বসে বই গিলতেন মেহেদী। একবার সোফির জগত বইটা নিয়ে পড়ছেন সে কোণায় বসে বসে, একজন এসে বলল, 'এখানে বসে বই পড়ো কেন, এখানে তো বসে বসে প্রেম করে সবাই।'
আরেকবার শীর্ষেন্দুর পার্থিব বইটি কিনে রাস্তা দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। নতুন বইটা পড়ার প্রতি এতই তীব্র লোভ হচ্ছিল যে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই বই পড়া শুরু করে দিয়েছিলেন। হুট করে একজন আগন্তুক এসে বললেন, 'পার্থিব? এটা শেষ হলে দূরবীন আর মানবজমিনটাও পড়বে। খুব ভালো লাগবে।' এই দুটো ঘটনা আজও মনে হলে অবাক লাগে মেহেদীর।
তখন থেকেই সমগ্র বা পুরো রচনাবলী কেনার একটা প্রবণতা চলে এসেছে তার মধ্যে। দেরি করে হলেও, তিনি টাকা জমিয়ে ঠিকই পুরো সমগ্র কিনে ফেলতেন। প্রথম টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন মানিক রচনাবলী। বিশ্বভারতীর ১৮ খণ্ড রবীন্দ্র রচনাবলী পুরোটাই তার আছে। বাংলা সাহিত্যিকদের প্রায় ভালোরকম অখণ্ড সংগ্রহ পাওয়া যাবে তার কাছে।
বর্তমানে এই কেনাকাটার হার যেন বেড়ে গেছে বহুগুণ। দেখা যায়, নিজের কোনো বই কিনতে ইচ্ছে হলে সেটা মেয়েকে উপহার দেওয়ার নাম করে কিনে ফেলেন। যেমন একবার তিন বছর বয়সী মেয়েকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন পুরো টিনটিন সমগ্র। আসলে তো মেয়ে না, নিজের জন্যই কিনেছেন তিনি সমগ্রটা! ছোটোবেলায় ইচ্ছে থাকলেও টাকার অভাবে কিনতে পারেননি। তাই মেয়েকে এই উপহার। আবার প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীকে উপহার দিয়েছিলেন বই। তিনি চান, আগের মতো একে অপরকে বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজটা আবার ফিরে আসুক।
এখন তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। বই কেনেন ঠিকই, তবে তা বই জমানোর জন্যই। আগে বই হাতে নিয়ে পড়তে যতটা ভালো লাগতো, এখন ঘরে এসে আলমারি ভর্তি বইগুলোর দিকে তাকাতেই বেশি ভালো লাগে। বইয়ের পাতা থেকে সরে গিয়ে সুখ এখন বইয়ের আলমারিতেই স্থান পেয়েছে।
নিজ লাইব্রেরীর ৩০-৬০ শতাংশ বই হয়তো তার পড়া আছে। বাকি সব অধরাই রয়ে গেছে।
জাপানিজ ভাষায় না পড়ে বই জমানোর এই অভ্যাসকে বলা হয় সুনডোকু (Tsundoku)। সুনডোকুতে আক্রান্ত মানুষ বই কিনতে কিনতে একপর্যায়ে বই জমানোর দিকেই আগ্রহ খুঁজে পান। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু তাদের বাড়িতে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ দেখে বড় হয়, তাদের মধ্যেও আপনাআপনি বই পড়ার প্রবণতা চলে আসে। এই লেখায় তেমন কয়েকজনই ছিলেন, যারা তাদের বাবা মায়ের থেকে বই পড়া আয়ত্ত করেছেন। এখন হয়তো নিজেরা বই পড়া কমিয়ে দিয়েছেন। তবে বই সংগ্রহ আর থামাননি...