টেকনাফে ব্যবসায়ীকে অপহরণ, দেড় লাখ টাকা পণে মিয়ানমার থেকে উদ্ধার
'ব্যবসার সূত্র ধরেই সাইফুলের সঙ্গে পরিচয়। বোনের বিয়ের নাম করে নিয়ে যায় টেকনাফ। সেখানে মারধর করে ১০ হাজার টাকা আদায়ের পর, আরও টাকার জন্য হাতবদল করা হয় দুই দফায়। রোহিঙ্গা পাচারকারীরা মাছের বোটে করে নিয়ে যায় মিয়ানমার। সেখানে মুক্তিপণের জন্য করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। পরে পুলিশের মাধ্যমে আমার পরিবার দেড় লাখ টাকা পণ দিলে মুক্তি পেয়েছি।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে কথাগুলো বলছিলেন টেকনাফ থেকে অপহৃত চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. তারেক হোসেন (২১)।
গত ২৩ মে চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফ গিয়ে অপহৃত হন চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. তারেক হোসেন (২১)। সেখান থেকে ২৫ মে রোহিঙ্গা মানব পাচারকারীরা তারেক হোসেনকে নিয়ে যায় মিয়ানমারে। টানা ছয়দিনের চেষ্টায় গত সোমবার (৫ মে) ব্যবসায়ী তারেক হোসেনকে মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরিয়ে আনে পুলিশ।
মো. তারেক হোসেন নগরের ইপিজেড থানা এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কসমেটিকস এর ব্যবসা তার। সেই সূত্রে টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। একসময় সেই সম্পর্ক রূপ নেয় বন্ধুত্বে। ২৩ মে নিজের বোনের বিয়ের নাম করে ফাঁদে ফেলে তারেককে টেকনাফে নিয়ে যায় সাইফুল। সেখানে মারধর করে আদায় করা হয় ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ। আরও টাকার জন্য স্থানীয় এক নারী দালালের হাতে সোপর্দ করা হয় তারেককে। সেখান থেকে আরও এক হাত বদলে তারেকের ঠাঁই হয় মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মানব পাচারকারী দলের বন্দিশালায়।
অপহরণ ও নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তারেক বলেন, 'টেকনাফ যাওয়ার পর বুঝতে পারি আমি কোনো বিয়েতে আসিনি বরং ফাঁদে পড়েছি। সেখানে সাইফুল ও আবছার নামে দুই ব্যক্তি সুপারি বাগানে নিয়ে গিয়ে দফায় দফায় মারধর করে। প্রচণ্ড মারধরের মুখে নগদ একাউন্টের মাধ্যমে পরিবার থেকে আদায় করা হয় ১০ হাজার টাকা। পরে এক দিন এক রাত বন্দি থাকার পর তুলে দেওয়া হয় রোহিঙ্গাদের মাছের বোটে।'
'পরপর তিনটা বোট পাল্টে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারে। সেখানে আবারো শুরু হয় নির্যাতন, আমার পরিবারের কাছে ফোন করে প্রথমে পাঁচ লাখ, পরে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এসময় বারবার হুমকি দেওয়া হতো টাকা না পেলে মেরে ফেলার। পরে পুলিশের মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা দিয়ে মিলেছে মুক্তি', বলেন তারেক।
ইপিজেড থানার ওসি আব্দুল করিম বলেন, 'গত ২৫ মে এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবার ইপিজেড থানায় মামলা দায়ের করে। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় কক্সবাজার জেলার টেকনাফে এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সুকৌশলে তাকে দিয়ে যোগাযোগের মাধ্যমে মিয়ানমার থেকে অপহৃত ভিকটিমকে সোমবার বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করি।'
টেকনাফ থেকে তিন হাত ঘুরে মিয়ানমারে যাওয়া ও তাকে উদ্ধারের বর্ণনা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে শুনিয়েছেন এই অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া উপপরিদর্শক (এসআই) সাজ্জাদ হোসেন।
সাজ্জাদ বলেন, 'টেকনাফের বাসিন্দা সাইফুল মূলত আদম বেপারি। কৌশলে ব্যবসায়ী তারেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। গত ২৩ মে সাইফুলের কথিত বোনের বিয়েতে অংশ নিতে টেকনাফ যায় তারেক। সেখানে সাইফুল ও আবছার তারেককে আটকে ফেলে। ১০ হাজার টাকা পাওয়ার পর তারেককে ছেড়ে দেয়ার কথা থাকলেও উল্টো বিক্রি করে দেওয়া হয় এক নারীর কাছে। হামিদা বেগম নামের ওই নারীর হাতে আরও একবার বিক্রি হন ব্যবসায়ী তারেক। এ দফায় রোহিঙ্গা পাচারকারীরা তাকে কিনে নেয়। পরে ট্রলার যোগে অপহৃতকে নিয়ে যাওয়া হয় মিয়ানমারের ছামিলা নামক স্থানে।'
'মামলাটি হাতে পেয়েই আমরা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যেসব নাম্বার থেকে তারেকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছিলো, এসবের অধিকাংশই ছিলো রংপুর, পঞ্চগড়সহ দেশের উত্তরাঞ্চলে রেজিস্ট্রেশনকৃত। ফলে আমরা বুঝতে পারি ঘটনাটিতে রোহিঙ্গা কানেকশন রয়েছে। ফলে প্রথম দফায় টেকনাফ গিয়েও আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই', বলেন এসআই সাজ্জাদ হোসেন।
চার-পাঁচদিন পর পুলিশ টেকনাফ থানাধীন হারবাং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের এক নারীর বিষয়ে জানতে পারে, যিনি আদম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় তাকে গ্রেপ্তারের পর জানা যায়, তারেককে ইতোমধ্যেই মিয়ানমার পাচার করে দেওয়া হয়েছে।
এসআই সাজ্জাদ বলেন, 'টেকনাফে এভাবে প্রতিদিন মানুষ বিক্রি হয়। তারেকের ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে হাতে আসে অসংখ্য ঘটনার তথ্য। যেখানে ভিকটিমদের মারধর করে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।'
'জিজ্ঞাসাবাদে হামিদা এই অপহরণ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। পরে তার মাধ্যমেই তারেককে ফিরে পেতে প্রস্তাব পাঠানো হয় রোহিঙ্গা অপহরণকারীদের কাছে। একপর্যায়ে দেড় লাখ টাকায় তারেককে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় তারা। আমরা কয়েক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করি। পরে ৫ মে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে নামিয়ে দেওয়া হয় ব্যবসায়ী তারেককে', বলেন এসআই সাজ্জাদ।
এই অপহরণ কাণ্ডের সঙ্গে রোহিঙ্গা সম্পৃক্ততার বিষয়ে ইপিজেড থানার ওসি আব্দুল করিম বলেন, 'এখন পর্যন্ত যেসব পরিচয় পেয়েছি, তাতে অপরাধীদের বাংলাদেশি পরিচয় আছে। মিয়ানমারে পাচারকারীরা ছিলো রোহিঙ্গা, বাকিটা অধিকতর তদন্তে জানা যাবে।'
কক্সবাজারের টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থানে অপহরণের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। গত ৬ মাসে কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে অন্তত ৬৫ জনকে। এতে এলাকাজুড়ে বাড়ছে অপহরণ আতঙ্ক। অনেকেই ধারদেনা করে মুক্তি পেলেও তাদের দীর্ঘ ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, 'বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো ইমিগ্রেশন সিস্টেম নেই। তাই একজন বাংলাদেশি নাগরিককে কিভাবে মিয়ানমার নিয়ে যাওয়া হলো বা ফিরিয়ে আনা হলো তা আমাদের জানা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে অপহরণের অভিযোগ করেন, কিন্তু পরে দেখা যায় নিজেদের মধ্যে দেনা-পাওনা নিয়ে বিরোধের জেরে এসব ঘটনা ঘটছে।'