কলকাতার বটতলা ঢাকার চকবাজারের কেতাবপট্টি
বটতলার বই মানেই আমরা জানি সস্তা, ক্ষীণকায়, অশ্লীল বা নিম্নরুচির সব বই। ড. সুকুমার সেন লিখেছেন, 'বটতলায় বই কথাটি মনের মধ্যে একাধিক ভাব জাগায়, কারো কারো মনে হবে সস্তা দামের ধর্মের বই, কারো কারো মনে হবে যাত্রার পালা বই। আবার কারো মনে হবে হরিদাস গুপ্তের মতো গোপনে পড়বার বই…আসলে সস্তা প্রেসই বটতলার প্রেস।'
কলকাতার বটতলা
এই বটতলার উদ্ভব কলকাতায়। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে শোভাবাজারের মোড়ে এক শানবাঁধানো বটগাছকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল বটতলার বেসাতি। শোভাবাজারের বটতলার উৎসমূল থেকে শুরু করে চিৎপুর রোড ও তার আশেপাশের গলিও বটতলা নামে পরিচিত ছিল।
কম খরচে, সস্তা কাগজে ছাপা হতো বটতলার বই। ফলে বইয়ের দাম পড়ত কম এবং সাধারণ পাঠকের আয়ত্তের মধ্যে ছিল বই। আর এসব বইয়ের পাঠক ছিল মূলত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত জনগোষ্ঠী। তাদের রুচি অনুযায়ী পুঁথি-পাঁচালি, পঞ্জিকা, পুরাণ, লোককাহিনী ইত্যাদি প্রকাশিত হতো।
এরমধ্যে আলাদা জায়গা করে নিয়েছিল মুসলমানি পুঁথি। যদিও এর আবির্ভাব ঘটে আরও অনেক পরে। ড. সুকুমার সেনের মতে, ১৮৪০ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত ছিল বটতলার স্বর্ণযুগ। ১৮৬৫ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত বটতলার মুসলমানি পুঁথির স্বর্ণযুগ।
চকবাজারের 'কেতাবপট্টি'ই ছিল ঢাকার বটতলা
বটতলার এই প্রভাব কলকাতার বাইরে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও বিস্তার লাভ করেছিল। ১৮৬৫ থেকে ১৯০০—এই সময়পর্বে কলকাতার বটতলার পুঁথির আদলে পূর্ববঙ্গের ঢাকার বাংলাবাজারের পার্শ্ববর্তী চকবাজারে দেখা গেল অগণিত মুসলমানি পুঁথি। ঢাকায় চকবাজারের আশপাশের এলাকাজুড়ে গড়ে উঠল 'কেতাবপট্টি'। কলকাতার চিৎপুর রোড ও তার আশপাশের এলাকার মতো ঢাকার চকবাজারের পশ্চিম দিকে কয়েকটি বইয়ের দোকান এবং তার আশপাশের কয়েকটি ছাপাখানাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় মুসলমানি পুঁথির বাণিজ্য।
চকবাজারের এই বইয়ের জগৎকে 'বাংলাদেশের বটতলা' বলে উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইউম। কলকাতার বিখ্যাত ইতিহাস লেখক শ্রীপান্থ 'বটতলা' নামে একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ের একটি অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে চকবাজারের কেতাবপট্টির ইতিহাস। তথ্যসূত্রেও তিনি আবদুল কাইউমের 'চকবাজারের কেতাবপট্টি' বইয়ের উদ্ধৃতি টেনে বলেছেন, 'এই কেতাবপট্টিই ছিল ঢাকার বটতলা'।
তবে ঢাকার বটতলা বলতে আদতে কোনো আলাদা স্থান ছিল না। উনিশ শতকে কলকাতার বটতলা আর চকবাজারের কেতাবপট্টি একইসূত্রে গাঁথা। তবে কলকাতার বটতলাকে দু-বাংলার মানুষই চিনতেন। কিন্তু চকবাজার কেতাবপট্টি সেভাবে পরিচিত নয়।
দাম কম রাখার প্রবণতাই ছিল বেশি, যাতে সাধারণের হাতে পৌঁছে যায়
কলকাতার বটতলার মতো সাহিত্যমূল্য আছে এমন সব কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ, পাঠ্য ছাড়া বাকি সবই ঢাকার বটতলা সাহিত্য।
সে হিসেবে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দীনবন্ধু মিত্রের 'নীল দর্পণ', আব্দুস সোবহানের 'হিন্দু মুসলমান' বা কালী প্রসন্ন ঘোষের 'নিশীথ চিন্তা' বটতলা নয়, এগুলোর সাহিত্যমূল্য আছে, মুদ্রিতও হয়নি সস্তাভাবে। পাঠকও নির্দিষ্ট। কিন্তু হরিহর নন্দীর 'কলির বৌ ঘর ভাঙ্গানী' বা বধিরুদ্দীনের 'গোল শুনাহর চন্দ্রমুখি' বটতলার অন্তর্গত। (ঢাকা সমগ্র ৩, পৃ. ২৩২)
বটলার বইয়ের আয়তন দশ পাতা থেকে একশো ওপরও হতো। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ত্রিশ পাতার ওপরের বইগুলো হতো পুঁথি। এই বইগুলো নৌকায় করে গ্রামাঞ্চলেও পাঠানো হতো। দাম ছয় পয়সা থেকে এক টাকা, পাঁচসিকা। দাম কম রাখার প্রবণতাই ছিল বেশি, যাতে সাধারণের হাতে পৌঁছে যায়।
বটতলার পুঁথির বিক্রি ও মুদ্রণসংখ্যা ছিল বেশি
ঢাকার আদি অধিবাসীদের মধ্যে বাংলা ভাষায় প্রচুর আরবি-উর্দু-হিন্দি-ফারসি শব্দের চর্চা ছিল। তাই এই পুঁথিগুলোতেও এসব ভাষার শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। ঢাকায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আগে সতেরো ও আঠারো শতকেও আরবি-ফারসি ও উর্দু পুঁথির ব্যাপক প্রচলন ছিল।
মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম তার 'চকবাজারের কেতাবপট্টি' বইয়ে বলেছেন, সাধারণ শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মুসলমানদের মুখের ভাষার কাছাকাছি ভাষায় রচিত হয়েছে এইসব মুসলমানি পুঁথি। আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্য এই পুঁথির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাদ্রি জেমস লং এ ভাষায় লিখিত গ্রন্থকে 'মুসলমান বাংলা' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ভাষা তো বটেই, বিষয় ও আকৃতি-প্রকৃতির দিক থেকে দুই অঞ্চলের মুসলমান পুঁথির মধ্যে কোনো তফাত ছিল না। দুদিকের পুঁথিই আরবি-ফারসির মত ডানদিক থেকে লেখা শুরু হতো। প্রায় একই আকৃতির এসব পুঁথি ছাপা হতো বেশ বড় বড় হরফে। কারণ, গ্রাম-গ্রামান্তরে তেলের বাতির অল্প আলোয় সামান্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন পাঠকের পড়তে যাতে অসুবিধা না হয়, তাই। এসব পুঁথিতে প্রথমে সাদা অথবা রঙিন কাগজের প্রচ্ছদ থাকত। চারদিকে লতাপাতা এঁকে অঙ্গসজ্জা করা হতো প্রচ্ছদপটে। মুসলমান পুঁথির দাম সবসময়ই ছিল কম, যার ফলে সাধারণ মানুষ সহজেই তা কিনতে পারত। স্বল্পমূল্যের কারণে গ্রন্থের প্রচার ও প্রসার ছিল অনেক।
পুঁথির বিষয়বস্তু
এসব পুঁথির রচয়িতা মূলত মুসলমানরা ছিলেন এবং মুসলমান লেখকরা কেবল পুঁথিতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন। অন্যকিছু তারা লিখতেন না তেমন। আর হিন্দু লেখকরা লিখেছেন মূলত কবিতা, উপন্যাস, প্রহসন। শ্রীমতি নিতম্বিনী, মোহিনীমোহন ঘোষাল প্রমুখ ছিলেন বটতলার বইয়ের (পুঁথি বাদে) রচয়িতা।
১৮৭০-এর দশকে ঢাকার একজন জনপ্রিয় বটতলার লেখক হরিহর নন্দী। তার প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে অধিকাংশই নাটক বা প্রহসন। এই প্রহসনগুলোতে সমসাময়িক সমাজের আংশিক চিত্র পাওয়া যায়। যেমন, যৌথ সমাজে ভাঙন ও তার প্রতিক্রিয়া, নারীর প্রতি মনোভাব বা তাদের অধস্তন রাখার ইচ্ছা, পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি বিরূপ ভাব ইত্যাদি। বিশেষ করে হিন্দু লেখকদের রচনায় উঠে এসেছে সমাজ সংস্কারের কথা, যে সংস্কার আসবে শিক্ষিত যুবসমাজের হাত ধরেই। অন্যদিকে পুঁথিগুলোতে স্থান পেয়েছে নারীর অধস্তনতা এবং উনিশ শতকের শিক্ষা-দীক্ষা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি ধিক্কার।
সে সময় মুসলিমদের তুলনায় হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে ছিল বলেই হয়তো তাদের (হিন্দুদের) লেখায় এমন চিন্তা ফুটে উঠেছিল। এছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় উন্মাদনারও সমালোচনা করা হয়েছে। অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ বা অধিকাংশ পুঁথিতে এ চিত্র অনুপস্থিত।
তবে সংস্কার কামনা করলেও নারীদের নমনীয় থাকার ব্যাপারে পুঁথিকারদের মতো এসব লেখকরাও জোর দিয়েছেন। গ্রামীণ বা অশিক্ষিত পরিবেশে এ ধরনের গ্রন্থ বা মনোভাব নারীর অধীনস্থতাকে নিশ্চিত করেছিল।
মুসলমান পুঁথির বিষয় নিয়ে মোহাম্মদ আব্দুল কাইউম জানিয়েছেন, সাধারণত প্রণয়কাহিনী বা ধর্ম উপদেশ ছিল পুঁথির উপজীব্য। কোনো কোনো প্রণয়কাহিনীর উৎস ফারসি বা হিন্দুস্তানি হলেও অধিকাংশ প্রণয়কাহিনী লেখকের মৌলিক সৃষ্টি। এসব বইয়ের সাহিত্যিক মূল্য না থাকলেও বইগুলোতে তৎকালীন সমাজের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা সমাজতত্ত্ববিদদের কাছে মূল্যবান তথ্যবিশেষ।
বই বিক্রি, প্রচার, প্রসারে ছিলেন তারা মনোযোগী
চকবাজারের বই-পুঁথি বিক্রির প্রধান ক্ষেত্র ছিল বাবুবাজার থেকে চকবাজার। আবার ফেরিওয়ালাদের কাছেও কিছু বই থাকত। তারা দোরে দোরে গিয়ে পৌঁছে দিত সে বই। পাশাপাশি বইয়ের দোকান ছাড়াও ছাপাখানায় এবং লেখক বা প্রকাশকের বাড়িতেও বই বিক্রয়ের ব্যবস্থা ছিল।
এছাড়া বই বিক্রির জন্য প্রচারের ওপরও অনেক গুরুত্ব দিতেন প্রকাশকরা। তাই তারা পুঁথির মধ্যে নানাভাবে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন। যেমন, মুন্সি ফয়েজউদ্দিন তার 'তালেনামা' পুঁথিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন এভাবে: 'এই সকল কেতাব যাহাদের দরকার হইবে তাহারা মোকাম ঢাকায় মোগলটুলি আমার কেতাবের দোকানে শ্রীযুক্ত হাফেজ মনিরুদ্দিন ছাহেবের নিকট কিম্বা ঠাটারিবাজার আমার বাটিতে তালাশ করিলে পাইবেন।'
আবার মুন্সি আলিমউদ্দিনের দোকানের বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন: 'এই কেতাব যাহার আবশ্যক হইবে তিনি অত্র শহরের চৌকবাজারের পশ্চিম অধিনের কেতাবের দোকানে তত্ত করিলে পাইবেন।'
এভাবে একটি বইয়েই অন্যান্য বইয়ের বিজ্ঞাপন থাকত। এছাড়া, ঢাকার পুঁথি রচয়িতাদের নিজেদের মধ্যে বিশেষ সম্প্রীতি ছিল, যার ফলে সুযোগ পেলেই গ্রন্থে একে অন্যের প্রশংসা করতেন। যেমন মোহাম্মদ ফয়েজুদ্দিন প্রসঙ্গে কবি শেখ ঘিনু বলেছেন:
মুন্সি ফয়েজুদ্দীন সাহেব ওস্তাদ আমার
পাক্কা মোসলমান মর্দ্দ অতি নেক্কার
পুঁথি ও পুঁথিকারদের সমাদর ছিল
পুঁথির বাজার ছিল অন্যান্য বইয়ের বাজারের তুলনায় রমরমা, যার কারণে এই ব্যবসায় পুঁজি ছিল এবং প্রায় পুঁথিকারদের নিজস্ব বাড়ি ছিল।
পুস্তক প্রকাশ বা বিক্রি ছাড়াও ঢাকার পুঁথিপট্টির পুঁথিকারদের নিয়ে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে উঠেছিল। সেই সাহিত্য সংগঠনে ছিলেন ফয়েজউদ্দিন, খোয়াজ ডাক্তার, মনিরউদ্দিন ডাক্তার, হায়দার জান, মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন প্রমুখ।
ঢাকার মুসলমানি পুঁথি রচয়িতারা তাদের পুঁথির পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে পেরেছিলেন। ফলে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে পুঁথির সমাদর বেড়ে গিয়েছিল। তবে এই পুঁথিকাররা সবাই যে ঢাকার আদি বাসিন্দা ছিলেন, তা নয়। অনেক পুঁথিকার ঢাকার বাইরে থেকে লিখতেন। তবে সব পুঁথি বের হতো ঢাকার চকবাজার থেকেই।
'ঢাকার কোনো স্থানকে বটতলা বলা হতো তা শুনিনি'
ঢাকার এই বটতলা-খ্যাত কেতাবপট্টি নিয়ে কথা হয় পুরান ঢাকা গবেষক ও লেখক আনিস আহমেদের সঙ্গে। আমলীগোলানিবাসী আনিস আহমেদের জন্ম এবং তার ছয় পূর্বপুরুষের বাসও এখানেই। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ভিন্ন চিত্র। তিনি জানান, 'কলকাতার বটতলা চিনি, কিন্তু ঢাকার কোনো স্থানকে বটতলা বলা হতো তা শুনিনি।'
'চকবাজারের কেতাবপট্টি বলতে কেবল চকবাজার শাহী মসজিদের পেছনটুকুই। ঢাকায় ছাপাখানা আসার আগে থেকেই এখানে বিভিন্ন মুসলমানি কেতাব, কোরআন, হাদিস, আমপারা, ইত্যাদি পাওয়া যেত। ইসলামিক বই ছাড়া সেখানে কিছুই ছাপাবে না। পুঁথি বা সমসাময়িক অন্যান্য বইগুলো পাওয়া যেত চক মোগলটুলি, ইমামগঞ্জ এসব স্থানে। কিন্তু সেটা চকবাজারের কেতাবপট্টির মধ্যে পড়ে না,' আনিস জানান।
কেতাবপট্টির কেতাবের দোকানও এখন গুটিকয়েক
একটা অঞ্চলজুড়ে, একইরকম অনেকগুলো দোকান গড়ে উঠলে তাকে পট্টি বলে। সে হিসেবে চকবাজার মসজিদ থেকে শুরু করে পাটুয়াটুলি, বাংলাবাজার পর্যন্ত পুরোটুকুই চকবাজারের কেতাবপট্টি।
মুনতাসীর মামুন তার বইয়ে এই কেতাবপট্টিকে এভাবে বর্ণণা করেছেন: 'পাটুয়াটুলী থেকে সোজা বাবুবাজার, বাবুবাজার খাল পেরিয়ে মিটফোর্ডের সামনে দিয়ে বেগমবাজারের রাস্তা ধরে চকবাজার। বাবুবাজারে ছিল কিছু মুদ্রণ যন্ত্র যেগুলোর মালিক হিন্দু সম্প্রদায়, সেখানে বই বিক্রিরও ব্যবস্থা ছিল। তারপর মিটফোর্ড মোড়ে একটি বটগাছ, যা এখন আর নেই। তারপর বেগম বাজারের কিছু মুদ্রণ যন্ত্র, চকের মসজিদ, তাকে ঘিরে গলি, সেখানেই কেতাবপট্টি।' (ঢাকা সমগ্র ৩, পৃ. ২৩২)
এই পুরো জায়গাজুড়ে ছিল বইয়ের দোকান এবং ছাপাখানা। ১৮৬৩ সালে ঢাকার ইমামগঞ্জে ছাপাখানা 'সুলভযন্ত্র' প্রতিষ্ঠিত হয়। এখান থেকেই প্রথম বেশ কয়েকটি মুসলমানি পুঁথি প্রকাশিত হয়। ১৮৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় স্থাপিত ছাপাখানার সংখ্যা ছিল মোট তিনটি।
মুসলমান মালিকানায় ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ সালে। নাম দেওয়া হয় 'মুহম্মদীযন্ত্র'। মুসলমান মালিকানার দ্বিতীয় প্রেসের নাম 'আজিজিয়া প্রেস'। ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরেক ছাপাখানা 'ইমদাদুল এসলামিয়া প্রেস'।
এসব ছাপাখানা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানি পুঁথি ছাপা হয়। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানি পুঁথি প্রকাশিত হয়েছিল আজিজিয়া প্রেস থেকে। এগুলো এখনও বেঁচে আছে, তবে কোনোটাই এখন আর পুঁথি বিক্রি করে না।
খোঁজ করে চকবাজারের একটি দোকানেই সেদিন পুঁথি পাওয়া যায়। তা-ও সেটি দুধরনের—গাজীকালু ও চম্পাবতী এবং সোনাভান পুঁথি। দোকানটির মালিক মোহাম্মাদ সিদ্দিকুর রহমান জানান, 'দেখেন না দুধরনের পুঁথিই আছে আমার কাছে। খুব কম বিক্রি হয়। সাধারণত গ্রাম থেকে মুরুব্বিরাই আসেন কিনতে।'
ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে চকে এখনও বেশকিছু ছাপাখানা এবং কেতাবের দোকান রয়ে গেছে, যেখানে এখনও পাওয়া যায় বিভিন্ন মুসলমানি কিতাব। আবার নতুন করে দোকান গড়েও উঠেছে। তবে সংখ্যায় তা দশেরও কম। বেশিরভাগই এখন জায়নামাজ, সুরমা তজবি, নারী প্রসাধনীর দোকান।
চকবাজারের চেয়ে বাংলাবাজারে পুঁথি পাওয়া যায় অল্পবিস্তর বেশি। বাংলাবাজারের হামিদিয়া লাইব্রেরীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্তমানে পুঁথি পাওয়া যায় বাংলাবাজারের সোলেমানি বুক হাউজে। তবে বেচাকেনা নেই বলে সেখানেও দেখা মেলে কেবল চার রকমের পুঁথির।
কেতাবপট্টির কেতাবের দোকানও এখন গুটিকয়েক। কেতাবপট্টির ধ্বংসাবশেষ দেখা যাবে চকবাজার শাহী মসজিদের পিছে, যাদের অধিকাংশই জানে না চকবাজারের কেতাবপট্টির গল্প, জানে না ঢাকাই মুসলিম পুঁথির সেই ইতিহাস।
পূর্ববঙ্গের জাগরণে ঢাকার বটতলার অবদান কম নয়
সময়ের সাথে সাথে পুঁথিগুলো তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। আগে তো এই পুঁথিকেই ধরা হতো ধর্মীয় বই হিসেবে। ধীরে ধীরে মানুষ শিক্ষিত হয়েছে, তাই পুঁথির জায়গাও হারিয়ে গেছে।
আর পুঁথির বাইরে বটতলার বইগুলো কী হলো? এ ব্যাপারে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদালয়ের বাংলা বিভাগের অধাপক মোহাম্মদ দানীউল হকের সঙ্গে। তিনি জানান, পূর্ববঙ্গে মুসলিম পুঁথি যেভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং জনপ্রিয় হয়েছিল, বটতলার অন্যান্য বইগুলো সে জায়গা নিতে পারেনি। এর পেছনে যেমন ধর্মীয় কারণ আছে, তেমন বাংলা সাহিত্যের অনুপ্রবেশও দায়ী।'
একদিকে উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণ, অন্যদিকে বটতলার বইগুলোর সাহিত্যের মর্যাদা না থাকায় সে বইগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। তবে ভুল বা সস্তা-চটুলধর্মী যা-ই হয়ে থাকুক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে বাংলাদেশে পাঠকশ্রেণি তৈরিতে চকবাজারের কেতাবপট্টি বা ঢাকার বটতলার কৃতিত্ব অনেক।