নিজেদের মুদ্রা চালু করতে প্রচুর কাঠখড় পোড়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, আওরঙ্গজেবও পারেননি ঠেকাতে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারতবর্ষে ব্যবসা শুরু করে, তখন এ উপমহাদেশ বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এসব রাজা, মহারাজা, সুলতানদের নিজস্ব আলাদা মুদ্রা থাকত। কিন্তু ভারতবর্ষে শক্ত খুঁটি গাড়ার পর কোম্পানি নিজেরাই ধাতব মুদ্রা তথা কয়েন তৈরি করে দেশীয় এসব মুদ্রার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে থাকে।
রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ও রানি মেরির নামে সুরাটে মুদ্রা তৈরি করতে শুরু করে কোম্পানি — ইচ্ছে মোগল মুদ্রাকে হটিয়ে বাজারে নিজেদের মুদ্রা প্রতিষ্ঠা করা। তখন বেশিরভাগ মানুষ ছিলেন অশিক্ষিত, মুদ্রার গায়ে কার নাম লেখা আছে সেটা নিয়ে তারা মাথা ঘামাতেন না।
এ খবর গেল দিল্লীশ্বর আওরঙ্গজেবের কানে। তিনি রেগে আগুন। হুকুম হলো, সুরাটে বাস করা সব ইংরেজকে ধরে আনো। সেনাপতিকে বললেন বোম্বের দুর্গ আক্রমণ করতে।
১৬৭২ সাল থেকেই বোম্বেতে নিজেদের টাঁকশাল পরিচালনা করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তখন থেকেই ইউরোপীয় শৈলীতে ধাতব মুদ্রা তৈরির চেষ্টা করেছে তারা। তবে ইংরেজ মুদ্রার দুটো অসুবিধা ছিল।
প্রথমত, এ মুদ্রা মোগল বাদশাহদের নাখোশ করেছিল। এ শাসকেরা ইংরেজ মুদ্রাগুলোকে মসনদ আর ইসলামের প্রতি অবমাননাকর বিবেচনা করতেন।
দ্বিতীয়ত, সুরাট থেকে ঢাকা — সাধারণ মানুষের কাছে মোগল মুদ্রাই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ছিল। মোগলদের সঙ্গে ভারতবর্ষের অনেক রাজার সদ্ভাব ছিল না। কিন্তু সেকালে মোগল মুদ্রা এতই প্রচলিত আর জনপ্রিয় ছিল যে, এসব রাজারাও নিজেদের মতো করে খানিকটা বদলে নিয়ে মোগল মুদ্রাই তৈরি করতেন।
১৭১৭ সালে মোগল বাদশাহ ফররুখসিয়ারে নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বোম্বেতে তাদের নিজস্ব টাঁকশাল পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। একশ বছরের কম সময়ের মধ্যে এ টাঁকশাল প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং তার প্রেক্ষিতে ১৮৩৫ সালে কয়েনেজ অ্যাক্ট তৈরি করা হয়।
ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডের অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়াম-এর সহকারী কিপার শৈলেন্দ্র ভান্ডারি বলেন, ভারতবর্ষে আগমনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেবল একটাই লক্ষ্য ছিল: বাণিজ্যের মাধ্যমে সর্বোচ্চ আয়।
তিনি মনে করেন, কোম্পানির রাজনীতি পরিচালনার সক্ষমতা বা মুদ্রা তৈরির ইচ্ছা কোনোটিই ছিল না, মুদ্রানীতি তৈরি করা তো আরও পরের বিষয়। 'লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের যা দরকার ছিল, তা হলো সর্বব্যাপী গৃহীত একটি মুদ্রা,' বলেন ভান্ডারি।
রিজার্ভ ব্যাংক অভ ইন্ডিয়া-এর ইতিহাসবিদ বাজিল শেখের মতে, কোম্পানির নিজস্ব ধাতব মুদ্রা তৈরির উদ্দেশ্যের পেছনে আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে মোগল সম্রাটদের ব্রাসেজ দেওয়া এড়ানো। ধাতুকে মুদ্রায় পরিণত করার জন্য মোগল সম্রাটদেরকে তখন ব্রাসেজ নামক এ সম্মানী দিতে হতো।
ভান্ডারি জানান, মুদ্রা তৈরির অধিকার নিয়ে তখন যুদ্ধও হয়েছিল। তার মতে, মোগল সম্রাটদের অনেকে — নিদেনপক্ষে আওরেঙ্গজেব পর্যন্ত — ইংরেজ কোম্পানির ভারতবর্ষে বসে মুদ্রা তৈরির বিষয়টি ভালোভাবে নেননি।
আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লীর মসনদ ও শাসনব্যবস্থা টালমাটাল হয়ে পড়ে। এ সুযোগে উপমহাপদেশে আরও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্ত ঘাঁটি গেড়ে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
ক্ষয়িষ্ণু মোগল সাম্রাজ্য মুদ্রার ওপর এর একছত্র আধিপত্য হারাতে থাকে। বাজিল শেখ জানান, ১৭১৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে কোনো আদর্শমান ধাতব মুদ্রা ছিল না।
তবে প্রথম দিকে ইংরেজদের নিজস্ব মুদ্রা তৈরির রাজনৈতিক প্রভাব ছিল না, যদিও মোগলমুদ্রা তৈরির সম্পূর্ণ সক্ষমতা ও স্বাধীনতা লাভ করে কোম্পানি।
ফলে ভারতবর্ষের ধাতব মুদ্রার প্রভাববলয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মোগল সাম্রাজ্য সমান ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে, বলেন শৈলেন্দ্র ভান্ডারি।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িশ্যার দেওয়ানি দান করেন দ্বিতীয় শাহ আলম। ফলে কোম্পানির রাজস্ব আহরণের ক্ষমতা পায়।
শেখ বলেন, 'রাজস্ব আহরণ শুরু করার পর বাজারে বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা থাকার অসুবিধা বুঝতে পারে কোম্পানি। বিভিন্ন কয়েনের জন্য বিনিময়হার বেশি ছিল। তাই তারা কোনোপ্রকার ঝক্কি ছাড়া রাজস্ব সংগ্রহের জন্য উপযুক্ত একটি কয়েনের কথা ভাবতে শুরু করে।'
১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাদশাহ শাহ আলমের নামে মুদ্রা তৈরি করে। অবশ্য তার অনেক আগেই বাদশাহ পরলোক গমন করেছিলেন।
১৭৬৫ সালের পর থেকেই কোম্পানি একটি আদর্শ ধাতবমুদ্রা তৈরির চেষ্টা শুরু করে। এক পর্যায়ে ভারতবর্ষ জুড়ে মোট পাঁচ ধরনের কয়েন টিকে থাকে। ১৭৯৩ সালের পর এ সংখ্যা তিনে নেমে আসে।
১৯ শতকে মারাঠাদের পরাভূত করার পর ভারতবর্ষের বেশিরভাগ স্থানে নিজস্ব কয়েন তৈরির আইনি ক্ষমতা অর্জন করে কোম্পানি।
ফলে ১৮৩৫ সালের ইউনিফর্ম কয়েনেজ অ্যাক্ট চালু হয়। চতুর্থ উইলিয়ামের মুখখচিত ধাতব মুদ্রা উপমহাদেশের বিভিন্ন টাঁকশালে তৈরি করতে থাকে ইংরেজরা।
তবে মুদ্রার এমন হঠাৎ বড় পরিবর্তনে সাধারণ মানুষের ওপর খুব একটা প্রভাব পড়েনি। কারণ ভারতবর্ষের মানুষ তখনকার দিনে ভিন্ন ভিন্ন রাজা-বাদশার শাসন ও তাদের মুদ্রায় অভ্যস্ত ছিল।
শিল্প বিপ্লবের কল্যাণে যন্ত্রচালিত টাঁকশাল ও রেলপথও ভারতবর্ষে পৌঁছায়। আর সেগুলোর দরুন ইস্ট ইন্ডিজ কোম্পানিও স্থানীয় বাজারে এর কয়েন ছড়িয়ে দিতে পারল খুব সহজে।
এরপর ইংরেজ রাজপরিবারের অধীনে ভারতবর্ষের শাসনভার এলে ব্রিটিশ কয়েনের ভিত আরও শক্ত হয় এখানে। পেপার কারেন্সি অ্যাক্ট (১৮৬১), ইউনিফর্ম কয়েনেজ অ্যাক্ট (১৯০৬) ইত্যাদি আইন তৈরি করা হয় ব্রিটিশ মুদ্রাকে ভারতবর্ষে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণের জন্য।