ভারতের সফল মহাকাশ মিশনের অখ্যাত নায়কেরা ‘মেধা পাচার’ বন্ধের যে শিক্ষা দিলেন
সত্য নাদেলার মতোন উদ্যোক্তার চেয়ে ইসরোর চেয়ারম্যান শ্রীধারা সোমনাথের মতো নায়কদেরই বেশি দরকার ভারতের।
অনেকেই জানতে চাইবেন, কেন?
অবজ্ঞা বা অসম্মান করছি না। হায়দরাবাদে জন্মানো মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী নাদেলা একজন বুদ্ধিদীপ্ত ও চৌকস ব্যক্তি– খ্যাতি ও বিত্তের চূড়ায়। অথচ তার চেয়ে স্বল্প-পরিচিতির সোমনাথের নেতৃত্বে ভারত চাঁদে অবতরণের ঐতিহাসিক সাফল্য পেয়েছে। তাকেই ভারতীয়দের রোল মডেল হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। সোমনাথ এমন একটি গুণী বিজ্ঞানী প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিদেশে পাড়ি জমাননি। দেশে থেকেই তারা বহুকিছু অর্জন করেছেন, বরং আরও বেশি প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে।
সোমনাথ কখনোই (আইপিএল)- এর ক্রিকেট টিম কেনার মতো বিত্তশালী হবেন না, ফরচুন বা ফোর্বসের তালিকায় ঠাঁই-ও পাবেন না। হয়তো তাকে কোনোদিন হোয়াইট হাউসে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানানো হবে না। সত্য নাদেলার মতো ভারতীয় বংশদ্ভুত আমেরিকানরা যা আয় করেন, সোমনাথের আয় সে তুলনায় সামান্য। কিন্তু, চন্দ্রাভিযানে সত্য নাদেলার বার্ষিক বেতনের চেয়ে মাত্র ৩০ শতাংশ বেশি ব্যয় করে ভারতকে চাঁদে পৌঁছে দেন তিনি।
মাত্র ৭৪ মিলিয়ন ডলারের বাজেটে, ভারতের চাঁদের মাটি ছোঁয়ার প্রকল্পটি ছিল নজিরবিহীন মিতব্যয়ের দৃষ্টান্ত। সাম্প্রতিক সময়ের বার্বি, ওপেনহাইমার, অ্যাভেঞ্জার্স: ইন্ড গেম, বা অ্যাভাটার: দ্য ওয়ে অব ওয়াটার- এর মতো হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোর নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও সস্তা। মহাকাশ নিয়ে কল্পকাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্র ইন্টারস্টেলারের বাজেটও ছিল এ প্রকল্পের প্রায় দ্বিগুণ।
এ মিশনের ব্যয় ছিল রাশিয়ার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযান প্রকল্পেরও অর্ধেক (উল্লেখ্য, গত ২১ আগস্ট চাঁদে অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হয় রুশ চন্দ্রযান)। নাসার ভাইপার রোভার মিশনের জন্য যে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে, ভারতীয় মিশনের খরচ ছিল তার এক-চতুর্থাংশেরও কম।
মহাকাশ কর্মসূচিতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির মাত্র ০.০৪ শতাংশ ব্যয় করে ভারত। বিশ্বের সেরা অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র করে ০.২৮ শতাংশ এবং রাশিয়া করে ০.১৫ শতাংশ।
গণমাধ্যমে নিজের ঢোল নিজেই পেটানোর এ যুগেও– ভারতের এ বিজ্ঞানীরা বিনম্র ও আত্মপ্রচার-বিমুখ। এর আগে ২০২০ সালের জুনে ভারতের চন্দ্রযান-২ মিশন অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়, এসময় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে আলিঙ্গন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন তৎকালীন মিশন প্রধান। গণমাধ্যমের সামনে তাদের আবেগের প্রদর্শনের নমুনা এতটুকুই।
ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র একজন সাবেক পরিচালক সুরেন্দ্র পাল বলেন, 'একবার গরুর গাড়িতে করে আমাদের একটি কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট পরিবহন করতে হয়েছিল। এতে আমাদের খরচ হয় মাত্র ১৫০ রুপি।'
ইসরোর সাবেক প্রধান মাধাবন নায়ার আমাকে (বারখা দাতকে) বলেন, 'আমরা শুধু অপরিহার্য জিনিসের পেছনে ব্যয় করেছি। ভারত বা বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক বেশি পরিশ্রম করেছেন।'
চন্দ্রাভিযান সফল করার জন্য সবাইকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু, সেজন্য কর্মীদের দেওয়ার মতো বাড়তি অর্থ ছিল না ইসরোর। মিশনের একজন বিজ্ঞানী ভেঙ্কেটশ্বর শর্মা জানান, 'প্রতিদিন সন্ধ্যায় সবাইকে বিনামূল্যে মাসালা দোসা ও কফি দিয়ে আমরা তাদের উদ্দীপ্ত করেছি। সামান্য এটুকু পেয়েই সবাই দারুণ খুশি, আরও বেশিক্ষণ কাজ করতে সানন্দে রাজি হয়ে যান।
ইসরোর কর্মজীবনে ভালোবাসার জীবনসঙ্গীও পেয়েছেন শর্মা। বিয়ে করেছেন প্রকল্পের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী এক নারীকে।
জাতীয় গৌরবের জন্য এই মিশন কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা হয়তো অ-ভারতীয়দের পক্ষে অনুধাবন করা কঠিন। অতীতে ভারতের মহাকাশ উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের বিদ্রুপ তারই প্রমাণ। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো প্রসিদ্ধ গণমাধ্যমেও একবার বর্ণবিদ্বেষমূলক একটি কার্টুন প্রকাশ করা হয়েছিল। এতে দেখা যায়, 'এলিট স্পেস ক্লাব' এর দরজায় করাঘাত করছেন গরুর দড়ি হাতে এক কৃষক।
বিবিসির একজন উপস্থাপক একবার প্রশ্ন করেন, যে দেশ দারিদ্র্য, বৈষম্য কবলিত, যেখানে সবার টয়লেট সুবিধা নেই – তাদের মহাকাশ অভিযানের প্রয়াস আদৌ যুক্তিসঙ্গত কিনা? এখন থেকে ভারতকে এ ধরনের অবজ্ঞা, পরিহাস আর কেউ করতে পারবে না।
ভারতের অভিজাত ব্যবস্থার ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে ইসরোর টিম। মতান্তরে, এপর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ছিল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অভ টেকনোলজি (আইআইটি)। আনুষ্ঠানিক ভাষ্য অনুযায়ী, আইআইটির ক্যাম্পাসগুলো সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত 'উৎকর্ষ অর্জনের কেন্দ্র'- যেখানে ভর্তি হওয়ার শর্তও বেশ কঠিন। কিন্তু, চাঁদে অবতরণের মিশনে কাজ করা বিজ্ঞানী, প্রকৌশলীদের বেশিরভাগই অন্যান্য স্বল্প-পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্নাতক। যেসব প্রতিষ্ঠান আবার অবস্থিত ভারতের বিভিন্ন ছোট শহর, মফস্বলে। অনেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। যেমন একজনের বাবা ছিলেন নিরাপত্তা রক্ষী, আরেকজনের মা অস্থায়ী দোকানে বেচতেন চা।
ইসরোর সাফল্য ভারত থেকে 'মেধা পাচার' নিয়ে বিতর্ককে নতুন করে উস্কে দিয়েছে। আইআইটির তিন-ভাগের এক ভাগ গ্রাজুয়েটই বিদেশে পাড়ি জমান। বেশিরভাগই যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিদেশের মাটিকেই করেন কর্মস্থল ও স্থায়ী ঠিকানা। জনগণের অর্থে শিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য তাদের অবদান কতটুকু?
অথচ যারা দেশে রয়ে গেছেন, ভারতবাসী আজ তাদের অভূতপূর্ব সাফল্য উদযাপন করছেন। এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের আড়ালে ভারতের সরকারি বিজ্ঞানীদের আরও ভালো সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা ভুলে গেলে চলবে না। এটা করা একান্তই দরকারি।
মাধাবন নায়ার আমাকে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থার কর্মীরা যা আয় করেন, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেতনভাতা পান ইসরোর বিজ্ঞানীরা। এই ধরনের বৈষম্যের সমাধান নাহলে 'মেধা পাচার' হতেই থাকবে।
একদিন চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে স্বদেশের পতাকা উড়বে, এই স্বপ্ন দেখতে দেখতে যে দেশের বিজ্ঞানীরা বাইসাইকেলে করে রকেটের যন্ত্রাংশ বহন করেছেন, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য এটি অসম্ভবকে সম্ভব করার মুহূর্ত। এই মিশনের উজ্জ্বল তারকারা বিশেষ সম্মান ও স্বীকৃতির যোগ্য দাবিদার।
লেখক: বারখা দাত ভারত ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কার জয়ী একজন টেলিভিশন সাংবাদিক, উপস্থাপক ও লেখক। সাংবাদিকতায় রয়েছেন দুই দশকের বেশি সময়। তিনি মোজো-স্টোরি নামক একটি মাল্টিমিডিয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেরও প্রতিষ্ঠাতা।