মেধাপাচার: বিদেশে ভালো সুযোগ থাকায় বুয়েটের মেধাবী প্রকৌশলীদের হারাচ্ছে বাংলাদেশ
কানাডার তেল উৎপাদনকারী প্রদেশ অ্যালবার্টার এক প্রাণবন্ত নগরী ক্যালগেরি। বাংলাদেশের প্রায় এক হাজারের বেশি গ্রাজুয়েট ইঞ্জিনিয়ার থাকছেন এখানেই।
এদের মধ্যে প্রায় ২৫০ জনই বাংলাদেশের শীর্ষ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট থেকে পাস করা। জন্মভূমি থেকে সুদূর প্রবাসে এই প্রকৌশলীরা নিজেরা মিলেই গড়ে তুলেছেন দৃঢ় এক বাংলাদেশি সমাজ। এভাবে সহপাঠী, অ্যালামনাই ও অন্যান্য বাংলাদেশিদের সাথে মিলেমিশে দূর প্রবাসেই খুঁজে পান দেশ ছেড়ে থাকার সান্ত্বনা, দরকারের সময় সাহায্য-সহযোগিতা।
উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে অভিবাসনের বৃহত্তর যে প্রবণতা– তারই একটি প্রতিচ্ছবি ক্যালগেরি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা আমেরিকা বাংলাদেশের অনেক তরুণের কাছেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। বিদেশে ভালো চাকরির সুযোগ খোঁজা এসব মেধাবী ইঞ্জিয়ারদের উল্লেখযোগ্য একটি সংখ্যা সম্ভবত দেশটিতে কর্মসূত্রে বাস করছেন।
মেধাবী তরুণদের এভাবে দেশত্যাগের ঘটনা একটি প্রশ্নেরই জন্ম দেয়, সেটা হলো: করদাতাদের অর্থে ভর্তুকিতে পড়াশোনার সুবিধা পাওয়া এসব দক্ষ পেশাজীবীরা স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই কেন দূরদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন?
কী আছে প্রবাস জীবনে?
মেধাবী এই ইঞ্জিনিয়াররা কেন বিদেশে নতুন দিগন্তের সন্ধান করেন? সেটা কি শুধুই আরো ভালো ক্যারিয়ার, উন্নত জীবনযাপনের জন্য, নাকি এসব বিষয় একসাথে কাজ করছে?
নাম না প্রকাশের শর্তে বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একজন স্নাতক বলেছেন, 'গবেষণা ও উচ্চতর শিক্ষার জন্য বাংলাদেশে সুযোগ খুবই সীমিত। চাকরির সুযোগও একইরকম সীমিত, বেতন কম আবার সামাজিক নিরাপত্তারও অভাব রয়েছে।' এই ইঞ্জিনিয়ার প্রথমে ডেনমার্কে পাড়ি জমান, পরে সেখান থেকে এসে থিতু হয়েছেন কানাডার ক্যালগেরিতে।
বুয়েট থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর বাংলাদেশের শীর্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাসে একটি ব্যবস্থাপক পদে চাকরি পাওয়া সত্ত্বেও তিনি দেশছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই চাকরিটি সম্ভাবনাময় হলেও কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত নেন, তা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 'দুর্নীতি না করে বাংলাদেশে শুধু বেতনের ওপর নির্ভর করে পরিবার চালানো কঠিন।'
বুয়েটের ৫০ শতাংশের বেশি গ্রাজুয়েট চাকরি করেন বিদেশে
বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২৩ সাল পর্যন্ত বুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন ৫০ হাজারের বেশি। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এদের ৫০ থেকে ৬০ শতাংশই বর্তমানে বিদেশে কর্মরত রয়েছেন।
বুয়েটের শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা একমত যে, স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করাদের মধ্যে দেশত্যাগের ঘটনা বাড়ছে। প্রতি বছর কী পরিমাণ গ্রাজুয়েট দেশত্যাগ করছেন– তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও – এই প্রবণতা অস্বীকারের উপায় আর নেই।
বুয়েট অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মাহতাবউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মূলত, দেশের সেরা প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশুনা করে, যে মার্যাদা প্রত্যাশা করে, গ্রাজুয়েটরা সেটা না পাওয়ায় বিদেশে চলে যাচ্ছে। দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে পুলিশ বা অ্যাডমিন ক্যাডাররা যে সুযোগ সুবিধা বা সম্মান পায়, একজন প্রকৌশলী সেটা পায় না। দেশ তাদেরকে মূল্যায়ন করে না, বিধায় দেশসেরা এই মেধাবীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।'
তিনি আরো বলেন, 'বিদেশি কোম্পানিতে কাজ করে তাঁরা দক্ষতার পরিচয় দিলেও– দেশ এই মেধাবীদের কাজে লাগাতে পারছে না।'
বুয়েটের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে বসুন্ধরা গ্রুপের হেড স্ট্র্যাটেজি, প্ল্যানিং অ্যান্ড পিআর বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন ইঞ্জিনিয়ার মো. জাকারিয়া জালাল। তিনি বলেন, 'উন্নত জীবনের আশায় তারা বিদেশ চলে যাচ্ছে। তাদের ধরে রাখার মতো ভালো কর্মসংস্থানও দেশে তৈরী করা সম্ভব হয়নি।'
সহপাঠীদের কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, '২০০২ সালের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আমার বেশিরভাগ ব্যাচমেটই এখন বিদেশে কর্মরত। এই বিভাগের পড়াশুনা অনুযায়ী, যে চাকুরি দরকার, সেটা এখনো তৈরী হয়নি। দেশের শিল্পখাত বড় হলেও তাদেরকে অ্যাকোমোডেট করার মতো জব তৈরী হয়নি।'
বুয়েট গ্রাজুয়েটদের পরিস্থিতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'উচ্চশিক্ষার জন্য বুয়েটের গ্রাজুয়েটরা বিদেশে যায়। কিন্তু উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পর তাদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকুরির পরিবেশও তৈরী করা সম্ভব হয় না। বিদেশে একটি চাকুরিতে যে পরিমাণ স্যালারি ড্র করে, আর উন্নত জীবনমানের সুবিধা পায়– দেশে হয়তো সেটা সম্ভবও না। বিদেশে সামাজিক নিরাপত্তাও বাংলাদেশের চেয়ে অনেক উন্নত। এসব বিভিন্ন কারণে অনেকের দেশে ফেরার আগ্রহ থাকলেও আসে না।'
বুয়েট গ্রাজুয়েটদের পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয়
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীর জন্য সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। তবে এবিষয়ে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে– বুয়েটের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তারা সমন্বিত তথ্য দিতে পারেননি।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের একজন কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, বিগত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। বুয়েটে চার বছরের স্নাতক (অনার্স) সম্পন্ন করার পরে শিক্ষার্থীরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করতে প্রভিশনাল সার্টিফিকেট নেয়।
শিক্ষক, সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতা বাড়ছে। প্রতি সেশনে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়, তার প্রায় অর্ধেকই বিদেশে চলে যাচ্ছে।
বর্তমানে বুয়েটে ৬টি অনুষদের অধীনে ১৮টি বিভাগ ও ৪টি ইন্সটিটিউট রয়েছে। বর্তমানে আসন সংখ্যা প্রায় ১,৩০০।
দেশত্যাগের প্রধান কারণ হিসেবে দেশে ভালো চাকরির সুযোগ না থাকা, প্রকৌশলীদের বেতন অপর্যাপ্ত হওয়া এবং উন্নত জীবনযাত্রার প্রতি গ্রাজুয়েটদের আগ্রহের কথা বলেছেন তাঁরা।
প্রতিটি সেশনের কী পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে চাকুরি করছে, তার একটি সাম্প্রতিক উদহারণ পাওয়া যায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বুয়েট অ্যালামনাই প্রকাশিত এক বিশেষ নিউজ লেটারে।
ওই নিউজ লেটারে ১৯৮৭ ব্যাচের গ্রাজুয়েটদের একটা প্রফেশনাল সামারি দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় ৪৮৮ জন গ্রাজুয়েটদের মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি এখন বিদেশে চাকুরি করছে। অবশিষ্টরা দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করছে।
বাংলাদেশে কর্মরত বুয়েটের একজন সাবেক শিক্ষার্থী বলেছেন, ঐতিহাসিকভাবে বুয়েট গ্রাজুয়েটরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যায়। সেখানে পড়াশোনা শেষ করার পর উচ্চ বেতনের চাকরি পাওয়ায়– আর দেশে আসে না।
বিগত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও – করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে দেশের শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে। যার প্রভাব পড়েছে প্রকৌশলীদের চাকরির বাজারে। এর সাথে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বাড়তে পারে।
বড় অংশ বিদেশ চলে গেলেও বুয়েট গ্রাজুয়েটদের অনেকে সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অ্যাডমিন, পুলিশ কিংবা পররাষ্ট্র ক্যাডারেও যোগ দিচ্ছেন। এছাড়াও সরকারের বিশেষায়িত কিছু প্রতিষ্ঠানেও প্রকৌশলী হিসেবে তাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
এর বাইরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রাজুয়েটরা বেসরকারিখাতে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।