শতভাগের চেয়েও বেশি মুনাফা বেড়েছে সরকারি জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানের
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শ্রম রপ্তানিকারক একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বিওইএসএল) মুনাফা অর্জনে বড় সাফল্য দেখিয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ৪৩ কোটি ১৭ লাখ টাকা। যা আগের অর্থবছরের চেয়েও দ্বিগুণের বেশি (১১৪ শতাংশ)।
বিওইএসএলের সূত্র মতে, ২০২৩ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির রাজস্ব ৬৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা বেড়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১২৮ শতাংশ। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো দক্ষিণ কোরিয়ায় রেকর্ড সংখ্যক শ্রমিক নিয়োগ।
বিওইএসএলের এখন বড় বাজার দক্ষিণ কোরিয়া। গত অর্থবছরে প্রায় ছয় হাজার ৭৪৯ জন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে দেশটি। পরিষেবা ফি হিসেবে প্রত্যেক অভিবাসী কর্মীকে বিওইএসএলকে দিতে হয়েছে ৩৪ হাজার টাকা।
তবে যথেষ্ট মুনাফা বাড়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানটি শ্রম রপ্তানি দক্ষতায় বেসরকারি রিক্রুটারদের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছে। ২০২৩ অর্থবছরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে সব মিলিয়ে ১১ লাখ ৩৭ হাজার কর্মী, তারমধ্যে বিওইএসএল পাঠিয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ২৯৪ জন কর্মী, যা সর্বমোটের ১.৩ শতাংশ।
বৈদেশিক কর্মসংস্থানের জন্য অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন ফি নেওয়ার পরও বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসন খাতে বিওইএসএলের ভূমিকা তুলনামূলক কমই বলা চলে।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি মাত্র এক লাখ ৪৫ হাজার শ্রমিককে বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুবিধা দিতে পেরেছে। যেখানে বেসরকারি সংস্থাগুলো একই সময়ে প্রায় দেড় কোটি শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়েছে।
বিওইএসএলের মহাব্যবস্থাপক এবিএম আব্দুল হালিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আমাদের প্রথম লক্ষ্য থাকে স্কিলড (দক্ষ) ও সেমি স্কিলড (আধা দক্ষ) কর্মী পাঠানোয়। আর বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে লেস স্কিলড (কম দক্ষ) কর্মী পাঠায়। আমাদের প্রধান লক্ষ্য এটা নয়।'
তিনি আরও যোগ করেন, '২ হাজার এজেন্সি মিলে ১০ লাখ কর্মী পাঠাচ্ছে। সে তুলনায় এককভাবে হিসেব করলে বিওইএসএলের পাঠানো কর্মী সংখ্যা কম নয়। তবে আমরা যে সংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছি তাতে সন্তুষ্ট নই। আরো বেশি শ্রমিক পাঠানোর জন্য সব রকমের চেষ্টাই চলছে।'
বিওইএসএল কেন পিছিয়ে
অভিবাসনের জন্য তুলনামূলক কম খরচ, সুশৃঙ্খল, নিরাপদ ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিদেশি নিয়োগদাতাদের কাছে আস্থা হতে পারায় অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং স্টেকহোল্ডাররা বিওইএসএলের প্রশংসা করেছেন। তারপরও সীমিত সক্ষমতা, অকার্যকর বিপণন কৌশল, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা সহ আরো কিছু কারণে বিওইএসএলের নতুন নতুন চাকরির সুযোগ অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিওইএসএলের তুলনায় বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর এগিয়ে থাকার আরেকটি কারণ হলো ভিসা বাণিজ্য।
ভিসা বাণিজ্য হলো মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে বিদেশি নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে ভিসা সংগ্রহ করা এবং বাংলাদেশের মতো উৎস দেশগুলোর রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে সেগুলো বিক্রি করা। এটি আইনত অবৈধ হলেও ব্যাপক পরিসরে, অহরহই হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে অভিবাসনপ্রত্যাশী কর্মীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থও হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
বিওইএসএল এ ধরনের অনুশীলন থেকে দূরে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, দক্ষ শ্রমিকদের অভিবাসনের জন্য তারা নতুন গন্তব্য, নতুন বাজারের সন্ধান করছেন।
প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক এবিএম আব্দুল হালিম বলেন,'আমরা আমাদের শ্রমিক পাঠানোর পরিধি বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনের শ্রম শাখার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছি। আমরা শীঘ্রই মধ্যপ্রাচ্যেও কর্মী পাঠানোর আশা করছি।'
এ অর্থবছরে বিজনেস প্রমোশন ইনিশিয়েটিভের আওতায় প্রতিষ্ঠানটি ইউরোপীয় বাজারও উন্মুক্ত করেছে এবং কিছু সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিককে ক্রোয়েশিয়ায়, আর তৈরি পোশাক খাতের কর্মীকে রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়াতে পাঠিয়েছে।
এছাড়া কুয়েতেও ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট এবং বিএসসি ডিগ্রিধারী ৬৬১ জন নার্স, মালয়েশিয়ায় ম্যানফ্যাকচারিং ও প্ল্যান্টেশনের জন্য ৮৮৫ জনকে,আর ফিজিতে ৭২ জন দক্ষ কর্মী পাঠানো হয়েছে। রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে ৩২ জন জাহাজ নির্মাণ কর্মী।
এছাড়াও বিওইএসএল অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনাই দারুসসালাম, লেবানন এবং বিশ্বের অন্যান্য সম্ভাব্য গন্তব্যে নতুন চাকরির সুযোগ চালু করার চেষ্টা করছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) সাবেক পরিচালক (প্রশিক্ষণ) এবং সৌদি আরবের রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাসের লেবার কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, 'বিওইএসএলের বিদেশে কর্মী নিয়োগের সীমিত সম্প্রসারণের পেছনে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটির সতর্ক দৃষ্টিভঙ্গি। তারা বিদেশে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে মান নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে। এই রক্ষণশীল কৌশল জনশক্তি রপ্তানি বাড়ার সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করে।'
তিনি যোগ করেন, এ প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূলত এখনো দক্ষিণ কোরিয়া আর জর্ডান। সেই যে একবার সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, এরপর থেকে সেভাবেই চলছে। অথচ তারা যদি পরিকল্পনা করে এগোনোর চেষ্টা করে, তাহলে সম্ভাবনাময় অনেক নতুন বাজার খুলে যেতে পারে। বিওইএলএসকে সহায়তার জন্য দূতাবাস রয়েছে। এদের কাজে লাগিয়ে তারা সামনে এগোতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডানে সফল যাত্রা
বিওইএসএল'র প্রধান শ্রম বাজার দক্ষিণ কোরিয়া ও জর্ডান। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি তৈরি পোশাক খাতে জর্ডানে সর্বাধিক সংখ্যক কর্মী পাঠিয়েছে, সরকারি চুক্তির অধীনে। এ সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠিয়েছে ২৮ হাজার কর্মী, যাদের বেশিরভাগই ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে।
২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি এক তৈরি পোশাক কারখানায় মেশিন অপারেটর পাঠানোর মাধ্যমে জর্ডানে তাদের কর্মী সরবরাহ শুরু করে। বর্তমানে জর্ডানের ৪২টি গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান বিওইএসএলের মাধ্যমে মাসিক ২৫ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে পোশাক শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছে। বিদেশি নিয়োগদাতারা বিমান ভাড়া বহন করলে বর্তমানে একজন জর্ডানগামী শ্রমিকের অভিবাসন খরচ পড়ে মাত্র ১৫ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২৬ হাজার ৮০০ টাকা।
বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, এ শ্রম বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিওইএসএলের।
বিওইএসএলের পরিধি বাড়াতে জনশক্তি ও প্রচারণা জরুরি
বেসরকারি সংস্থাগুলো বিদেশি নিয়োগদাতাদের কাছ থেকে আরো বেশি শ্রমিকের কাজের সুযোগ পাওয়ার জন্য গন্তব্য দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালিয়ে থাকে। কিন্তু বিওইএসএল এ ধরনের কোনো কার্যক্রম নেই। এমনকি গন্তব্য দেশগুলোতে বিওইএসএলের কোনো প্রতিনিধিও নেই।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, 'আমাদের অবশ্যই বিওইএসএলের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে প্রতিষ্ঠানটি আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।'
এবিএম আবদুল হালিম বলেছেন, জর্ডানের মতো সম্ভাব্য গন্তব্য দেশগুলোতে প্রতিনিধি নিয়োগ এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে বিওইএসএল তার পরিসর বাড়ানোর জন্য কাজ করছে।
তিনি আরও যোগ করেন, অভিবাসী কর্মীদের আরো ভালো পরিষেবা দেওয়ার জন্য বিওইএসএল চার বিভাগীয় পর্যায়েও নিজস্ব অফিস ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করছে।