মিয়ানমারের সংঘাত: গুলিতে আহত ৫ বাংলাদেশি, বান্দরবান সীমান্তে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত বিরতিহীন চলছে। টানা গুলিবর্ষণ, মর্টার শেল বিস্ফোরণের শব্দকম্পন বাড়ছে সীমান্ত এলাকাজুড়ে। বান্দরবন জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়ন, কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন থেকে শুরু করে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকায় লড়াইয়ের এমন শব্দ শোনা যাচ্ছে।
একইসঙ্গে মিয়ানমার থেকে ছোঁড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের জনপদে। সোমবার দিবাগত রাত থেকে আজ মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত সীমান্ত লাগোয়া দুটি বসত ঘরে মর্টার শেল এবং আর পাঁচটি ঘরে গুলি এসে আঘাত হেনেছে। মঙ্গলবার পুরোদিন মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে ৫ বাংলাদেশি আহত হয়েছেন।
মঙ্গলবার বিকেলে ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন ও জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন।
পরিদর্শন শেষে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, "ঘুমধুম সীমান্তের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। সীমান্ত এলাকার ২৪০ পরিবারের লোকজন ঝুঁকিতে রয়েছেন। স্থানীয় চেয়ারম্যান তাঁদের নিরাপদে সরে যেতে সহযোগিতা করছেন। ইতোমধ্যে, সীমান্তবর্তী ১৫০ পরিবার নিজ উদ্যোগে নিকট স্বজনদের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে জলপাইতলী এলাকা থেকে ৩০ পরিবারকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, দুটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। ওখানে অন্যান্যরা যেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। এটা প্রশাসনের পক্ষে অনুরোধ।
মঙ্গলবার দুপুর থেকে মাইকিং করে বলা হচ্ছে তুমব্রু, কোনা পাড়া, মাঝের পাড়া, ভাজা বনিয়া পাড়া, বাজার পাড়া, চাকমা হেডম্যান পাড়া,পশ্চিবকুল পাড়া, ঘুমধুম নয়াপাড়া, পূর্বপাড়া, মাধ্যম পাড়া এলাকার লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, "আজকে টানা ৫-৬ দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমারের ওপারে গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে আছে এলাকাবাসী।"
সীমান্ত পরিদর্শনে গিয়ে জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, সীমান্ত এলাকার নিরাপত্তার ঝুঁকি মাথায় রেখে দুটি স্কুলে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সার্বিক বিষয়ে প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসা বুলেট ও বোমার অংশে তাৎক্ষণিকভাবে হাত না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, অবিস্ফোরিত বুলেট ও বোমা বিস্ফোরণে হতাহত হতে পারেন যে কেউ, তাই সার্বিক পরিস্থিতি মাথায় রেখে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
জেলা প্রশাসক সোমবার মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেল বিস্ফোরণে নিহত হোসনে আরা বেগমের বাড়িতে যান এবং শোকাহত পরিবারের সদস্যদের সান্তনা দিয়ে ২০ হাজার টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করেন।
এসময় বান্দরবানের পুলিশ সুপার সৈকত শাহিন বলেন, জেলা প্রশাসন ও বিজিবির সাথে পুলিশও সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে। কক্সবাজারের সীমান্তবর্তী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহিন ইমরান জানিয়েছেন, মিয়ানমারে সংঘাত বেড়েছে। মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি, মর্টার শেল এসে পড়ছে সীমান্তের এপারে বসতঘরে। এর প্রেক্ষিতে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকাবাসীকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার নিদের্শনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের দরকারি নিদের্শনা দেওয়া হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে আসা গুলিতে একদিনে আহত ৫
মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলিতে মঙ্গলবার সারাদিন বাংলাদেশের ৫ নাগরিক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ঘুমধুম সীমান্তে একজন, উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন। পালংখালী ইউনিয়নের নলবনিয়া এলাকার আয়ুবুল ইসলাম, রহমতেরবিল এলাকার আনোয়ার হোসেন, পুটিবনিয়া এলাকার মোবারক হোসেন ও মো. কাল আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এর আগে মঙ্গলবার বেলা ৪টার দিকে তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহারপাড়া থেকে আশ্রয়কেন্দ্র উত্তর ঘুমধুম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় গুলিতে আহত হন মো. সৈয়দ আলম নামের একজন। তিনি তুমব্রু পশ্চিমকুল পাহারপাড়া-নিবাসী কাদের হোসেনের ছেলে।
আহত সৈয়দ আলম জানান, বাড়ি থেকে উত্তর ঘুমধুম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় মিয়ানমার থেকে ছোড়া গুলি প্রথমে একটি গাছে লেগে ছিটকে গিয়ে তার কপাল ঘেঁষে চলে যায়। এতে কপাল কেটে রক্ত ঝরতে শুরু করে। তখন তিনি স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঘুমধুম বেতবুনিয়া বাজার সংলগ্ন ছৈয়দ নুর এর বসতঘরে একটি মার্টর শেল এসে পড়েছে। এতে ভেঙে গেছে জানালা। ফাটল ধরেছে বাড়ির দেওয়ালে। একই সময় ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের বাড়িতে এসে পড়ে আরও একটি মর্টার শেল।
এসময় লাগাতার গুলি এসে পড়েছে এপারে। এতে সীমান্তের ঘুমধুমের নজরুল ইসলামের বাড়ি, রহমতবিল সংলগ্ন এডভোকেট আবদুল মান্নানের বাড়ি সহ ৫টি বাড়িতে গুলির আঘাত লেগেছে।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, "সোমবার রাত থেকে দুই পক্ষের লড়াইয়ের ভয়াবহতা বেড়ে যায়। গোলাগুলির এমন প্রচণ্ডতা আমরা আর দেখিনি। একেকটি গোলা নিক্ষেপের পর পুরো এলাকা যেন কেঁপে ওঠে। একটি রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন স্থানীয় লোকজন।"
তিনি জানান, ঘুমধুমের মধ্যমপাড়া, জলপাইতলী, মন্ডলপাড়া, নয়াপাড়া, কোনারপাড়া, পশ্চিমকুল, বেতবুনিয়া বাজার পাড়া, পাশের পালংখালী ইউনিয়নের উখিয়ার ঘাট, পূর্ব ফাঁড়ির বিল, নলবনিয়া, আঞ্জুমান পাড়া, বালুখালী, দক্ষিণ বালু খালী এলাকা গোলা বিনিময়ের শব্দে প্রকম্পিত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে অনেকেই। যাদের স্থানীয় লোকজন আটক করে বিজিবির কাছে সোপর্দ করছে।
ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমাদের ইউনিয়নে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার বাইশপারি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া থেকে ২০ পরিবার, ভাজাবনিয়া তঞ্চঙ্গ্যা পাড়া থেকে ৩০ পরিবার, তুমব্রু কোনার পাড়া থেকে ৩০ পরিবার, ঘুমধুম পূর্ব পাড়া থেকে ২০ পরিবার এবং তুমব্রু হিন্দু পাড়া থেকে ১০ পরিবার পাশবর্তী বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে।