উৎপাদনে উদ্বৃত্ত থাকলেও, বাংলাদেশ এখনো কেন চাল আমদানি করছে?
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ৩০ লাখ টন উদ্বৃত্ত হলেও– ওই বছরেই বাংলাদেশ প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি করেছে।
গতবছরে 'অ্যাসেসমেন্ট অব নন-হিউম্যান কনজাম্পশন অব রাইস ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি গবেষণা করেছে মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, ২০২২ এ সমাপ্ত অর্থবছরে ফসল সংগ্রহ থেকে শুরু করে ও সংগ্রহ পরবর্তী সময়ে হওয়া ক্ষতি/ অপচয়সহ খাদ্য-বহির্ভুত অন্যান্য কাজে প্রায় ৯৮ লাখ টন চাল ব্যবহার হয়। যা মোট উৎপাদনের ২৬ শতাংশ। আর একেই বলা হচ্ছে নন-হিউম্যান কনজাম্পশন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন। এরমধ্যে মানুষের খাদ্য বাবদ হয়েছে ২ কোটি ৫২ লাখ টন। এই হিসাবে, সেবছর উৎপাদনে উদ্বৃত্ত ছিল ১ কোটি ৩০ লাখ টন। এমনকী পশুখাদ্য উৎপাদন, বীজ, চালকলে হওয়া অপচয়, গুদামে নষ্ট হওয়া ইত্যাদিসহ ফসল সংগ্রহ ও সংগ্রহ পরবর্তী সময়ের ক্ষতি বাদ দেওয়ার পরেও– উদ্বৃত্ত ছিল ৩০ লাখ টন।
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চালের উৎপাদন আরও বেড়ে পৌঁছে যায় প্রায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে। যা দেশের প্রধান খাদ্যশস্যের উদ্বৃত্ত বাড়ানোরই সহায়ক হয়। কিন্তু, তবু বাংলাদেশকে ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছে।
তথ্যের এই অসামঞ্জস্য শুধু চালের ক্ষেত্রেই নয়, বরং আলু, মাছ ও পোলট্রির মতোন অন্যান্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে।
যেমন- হিমাগার মালিকদের সমিতি– বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন দাবি করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলুর উৎপাদন কোনোভাবেই ৮৫ লাখ টন ছাড়ায়নি। কিন্তু, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ১ কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদনের তথ্য দিয়েছে। আর বিবিএস দিয়েছে ১ কোটি ৪ হাজার টন উৎপাদনের তথ্য।
এজন্য নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের অভাবকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা, এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সমালোচনা করে তাঁরা বলছেন, সংস্থাটির দেওয়া তথ্যে প্রায়ই অসামঞ্জস্য থাকছে, যার ফলে সরকারকে বিব্রত হতে হচ্ছে।
অতিরঞ্জিত তথ্য
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য টিবিএসকে বলেন, অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চাষাবাদ ও উৎপাদনের যে তথ্য দেয়– সেটি অতিরঞ্জিত। এই সংস্থা যত হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে বা হেক্টর প্রতি যে উৎপাদনের তথ্য দেয়-- প্রকৃত অর্থে সেটি হয় না। যেকারণে সরকার বাস্তবতার মুখোমুখি হয় দেরিতে। এই তথ্য সরকারের কাছে আসে দেরিতে। ফলে আমদানির সিদ্ধান্ত নিতেও দেরি হয়। তথ্য-উপাত্ত তৈরি হতে হবে স্বাধীনভাবে। কিন্তু তা হয় না বলে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, চালের বাজার পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রকৃত তথ্য না থাকা যেমন সমস্যা, তেমনি প্রতিযোগিতাপূর্ন দ্বিতীয় স্তরের বাজার না থাকাও সমস্যা। একদিকে সময়মত তথ্য আসে না, বিধায় আমদানির সিদ্ধান্ত হয় দেরিতে। অন্যদিকে আমদানিও নিয়ন্ত্রিত হয় গুটিকয়েক বড় বড় আমদানিকারকদের মাধ্যমে। ফলে বাজার স্বাভাবিকভাবে কাজ করে না।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএস'কে বলেন, বছরের পর বছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) চাল থেকে শুরু করে কৃষি উৎপাদনের যে তথ্য প্রকাশ করছে তার মধ্যে মিল নেই। ফলে প্রকৃত চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়- সরবরাহ শৃঙ্খলে যারা আছে তারা এই সুযোগটা গ্রহণ করে।
"কার্যকরী পরিকল্পনার জন্য অবশ্যই চাহিদা ও প্রকৃত উৎপাদনের তথ্য দরকার, তা নাহলে বাজারের এই সংকট দূর করা কষ্টকর"- মন্তব্য করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও কৃষি মন্ত্রণালয় যা বলছে
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, "উৎপাদনের সঠিক পরিমাণ আমরা নিশ্চিতভাবে দিতে পারি না, তবে আমাদের প্রাক্কলন প্রকৃত পরিমাণের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে। কারণ সারাদেশের ১৪ হাজার পয়েন্ট থেকে আমাদের কাছে তথ্য আসে। কাজেই আমাদের পরিসংখ্যান ফেলে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু, বিবিএস এখনো সেই পুরনো প্রক্রিয়ায় সেম্পল নিয়ে হিসাব করে, ফলে সেটা খুব বেশি গ্রহণযোগ্য হয় না।"
তিনি বলেন, "প্রযুক্তি-নির্ভর হিসাব করতে গেলে অনেক খরচ, এতে তহবিল ব্যয় করা কষ্টসাধ্য। তবুও যথাযথ তথ্য দিতে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আরও বলেন, "চাষাবাদে হাইব্রিড ও উফশী জাতের ধানের ব্যবহার বাড়ায় দেশজুড়ে চালের উৎপাদন ভালো হচ্ছে। প্রতিবছর আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ না বাড়লেও– উৎপাদন কিন্তু বাড়ছে।"
তথ্যের অসামঞ্জস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুস শহীদ টিবিএসকে বলেন, "বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া উৎপাদন ও চাহিদার তথ্য নিয়ে আমার আরও জানতে হবে। কাদের তথ্যে কি বলা হয়েছে, কোন প্রেক্ষিতে সেগুলো বলা হয়েছে, তা না বুঝে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।"
তবে উৎপাদনের কোনো ঘাটতি নেই বলে মনে করেন কৃষিমন্ত্রী। তিনি বলেন, "যথেষ্ট ধান চাষ ও উৎপাদন হচ্ছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে কোনো কোনো সময় কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন হয় না। প্রয়োজনের আলোকে দেশের মানুষের স্বার্থে সরকার বিশেষ সুবিধায় চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কিন্তু, বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের ওপর চাপ রয়েছে। এজন্য প্রতি সপ্তাহে কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চালসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের আমদানি ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে মনিটরিং সভা করবে। যাতে যখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার হয়, তা নেওয়া যায়।"
চাষযোগ্য জমি কমার মধ্যেই উৎপাদন বাড়ছে
বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৭.১৮ লাখ হেক্টর জমিতে ৩ কোটি ৭৬ লাখ টন চালের উৎপাদন হয়। কিন্তু, বিস্ময়করভাবে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৮০ হাজার হেক্টর কমা সত্ত্বেও– দুই বছরে পরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে।
@উৎপাদন ও আবাদি জমির পরিমাণ যেভাবে হিসাব করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
দেশে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ প্রতিবছর কমলেও– গত পাঁচ বছর নরসিংদি জেলায় বোরো ধান আবাদের জমি সম্প্রসারিত হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৩৯২ হেক্টর। একইসময়ে, বোরো মৌসুমে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে ১৩ হাজার ২৮৬ টন।
এটি শুধু বোরো মৌসুমের একটি জেলার হিসাব– যেখানে চাষের জমি ও উৎপাদন দুটোই বেড়েছে। সামগ্রিক উৎপাদনের হিসাব আসে জমির পরিমাণ থেকে।
তাই জমির হিসাবটা কীভাবে করা হয়- জানতে চাওয়া হয়েছিল নরসিংদি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আজিজুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, "প্রতিটি ইউনিয়নে তিনজন করে ব্লক সুপারভাইজার রয়েছেন। যারা চাষ করা জমি চোখে দেখে এবং তার সাথে পুরনো সময়ের তথ্যের তুলনা করে নতুন জমির হিসাব নির্ধারণ করেন।"
খাদ্যশস্যের হিসাবের জন্য প্রতিটি ইউনিয়ন তিনটি ব্লকে বিভক্ত। ফসল কাটার সময়– প্রতিটি ব্লকে তিন ধরনের জমি বাছাই করা হয় ফলনের দিক বিবেচনায়। উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন উৎপাদনের জমিগুলোর উৎপাদনকে গড় করে ব্লকের উৎপাদনশীলতার হিসাব করা হয়।
উৎপাদনশীলতার এই তথ্যকে জমির পরিমাণের সঙ্গে মিলিয়ে ব্লকের উৎপাদনের তথ্য বের করা হয়।
অথচ, জমির হিসেব নিছকই চোখের দেখা। যদিও সেই হিসাব করার সময় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও বিবিএস যুক্ত থাকে। তিনটি ব্লকের তথ্য গড় করে প্রথমে ইউনিয়ন, এরপর উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় পর্যায়ের তথ্য নিরুপণ করা হয়। পরে বিভাগীর পর্যায়ে তথ্যের সমন্বয়ে জাতীয় পর্যায়ের উৎপাদনের হিসাব করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং কৃষি মন্ত্রণালয় যে তথ্য প্রকাশ করে তা থেকে আলাদা করে নতুন একটি হিসাব করে বিবিএস। এই হিসাব করার সময় অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- স্পারসোর আলাদা আলাদা তথ্য মিলিয়ে সমন্বয় করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সবগুলো মন্ত্রণালয় ও সংস্থার তথ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে বিবিএস চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করে। তবে কোনো কারণে একটি এলাকায় যদি উৎপাদনের তথ্যে একাধিক সংস্থার হিসাবে ৫ হাজারের বেশি পার্থক্য হয় (জমি বা উৎপাদনের তথ্যে) তাহলে সে অঞ্চলটি পুনরায় যাচাই করা হয়।
চালের দাম কমাতে শুল্ক ও কর কমিয়েছে সরকার
গতবছরের শুরুর দিকে যখন বাজারে চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়, সেসময় তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রতি দাম কমানোর নির্দেশনা দেন। তখন মজুদকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানও চালায় তাঁর মন্ত্রণালয়।
এবছরেও জানুয়ারির শুরুতে আমনের ভরা মৌসুমের মধ্যেই হঠাৎ করে চালের দাম প্রতি কেজিতে ৫ থেকে ৬ টাকা করে বাড়ায় সরকার চাল আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এরপর গত ৮ ফেব্রুয়ারি চালসহ তিনটি নিত্যপণ্য– ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুর আমদানির ওপর থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক কমিয়েছে সরকার।
বর্তমানে চাল আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাটসহ প্রায় ৬৩ শতাংশ কর দিতে হয়। নতুন আদেশে মোট ট্যাক্স ইনসিডেন্স (টিটিআই) কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন টিবিএস'কে বলেন, "এবছর সরকারি-বেসরকারি দুই পর্যায়েই চাল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ের আমদানির ওপর আমরা কোনো সীমা বেধে দেব না। তবে শুধুমাত্র যারা আমদানি করতে চান এবং অনুমতি নিয়ে আগে যাদের যথাযথভাবে আমদানি করার নজির আছে তাঁদের প্রাধান্য দেব।"
ইসমাইল হোসেন বলেন, দেশে চালের ঘাটতি নেই। মিলার ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে প্রচুর চাল রয়েছে। সরকারের কাছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন মজুদ রয়েছে। কিন্তু, ব্যবসায়ীরা বাজারে সরবরাহ বাড়াচ্ছে না।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই বা ব্রি)-র মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির টিবিএসকে বলেন, "গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের লম্বা ও জটিল সাপ্লাই চেইনের কারণে প্রতি কেজি চালে ৮ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত লাভ করছে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা। কখনো কখনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি পরিমাণ প্রফিট মার্জিন ধরছে।"
চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসীভাবে ধান কিনে মজুত করার প্রবণতাকেও দায়ী করেন এই কর্মকর্তা।
টিসিবির বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি চিকন চাল কিনতে হলে ভোক্তাকে মানভেদে ৭৫ টাকা পর্যন্ত, মাঝারি চিকন চাল ৫৬-৬৫ টাকা এবং মোটা চাল কিনতে হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকা কেজি দরে।