আন্তর্জাতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে দ্বিতীয় পাসপোর্ট নিচ্ছে মার্কিনীরা
আর্থিক ঝুঁকি থেকে বাঁচতে ধনী মার্কিনী পরিবারগুলো আগের চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় দ্বিতীয় নাগরিকত্ব ও জাতীয় নিবাসের আবেদন করছে বলে জানিয়েছে একটি নেতৃস্থানীয় আইনি সংস্থা।
যদি নিজ দেশ ছেড়ে পালাতে হয়, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরা এসব 'পাসপোর্ট পোর্টফোলিও'—দ্বিতীয় নাগরিকত্ব, কেউ কেউ তৃতীয় ও চতুর্থ নাগরিকত্বও নিয়ে রাখছে—বানাচ্ছে।
আইনি সংস্থা হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স বলেছে, বিকল্প নিবাস বা বাড়তি নাগরিকত্ব নিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মার্কিনীরা এখন অন্য সব দেশের নাগরিকদের ছাড়িয়ে গেছে।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের বেসরকারি গ্রাহকদের গ্রুপ হেড ডমিনিক ভোলেক বলেন, 'আমি ধনী হলে যেকোনো ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধেই সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে চাইব। …নাগরিকত্ব ও নিবাসে বৈচিত্র্য আনার সামর্থ্য থাকলে একটামাত্র দেশের নাগরিকত্ব ও নিবাস নিয়ে থাকার কোনো অর্থ নেই।'
সম্প্রতি যেসব হাই-প্রোফাইল ধনী মার্কিনী দ্বিতীয় দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আছেন বিলিয়নেয়ার প্রযুক্তি বিনিয়োগকারী পিটার থিয়েল ও গুগলের সাবেক সিইও এরিক শ্মিড। পিটার থিয়েল নিউজিল্যান্ড ও এরিক শ্মিড সাইপ্রাসের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছেন।
ধনীরা অবশ্য দলে দলে মার্কিন নাগরিকত্ব বিসর্জন দিচ্ছেন না। প্রতি বছর তুলনামূলক অতি অল্পসংখ্যক মার্কিনী মূলত কর দেওয়ার বাধ্যবাধকতার জন্য তাদের মার্কিন নাগরিকত্ব বিসর্জন দেন।
তবে অনেক ধনী মার্কিনী এখন মার্কিন নাগরিকত্ব বজায় রেখেই দ্বিতীয় কোনো ভিসা বা নাগরিকত্ব নিচ্ছেন।
হেনলির তথ্যানুসারে, বাড়তি নাগরিকত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে মার্কিনীদের পছন্দের শীর্ষে আছে পরতুগাল, মাল্টা, গ্রিস ও ইতালি।
পর্তুগালের 'গোল্ডেন ভিসা' কর্মসূচি আবাসন ও নাগরিকত্বের পথ খুলে দেয়, তাই এটি দারুণ জনপ্রিয়। সেইসঙ্গে গোল্ডেন ভিসার কল্যাণে ইউরোপে বিনা ভিসায় ভ্রমণ করা যায়। তবে পর্তুগালের গোল্ডেন ভিসার জন্য ফান্ড বা বেসরকারি ইকুইটিতে ৫ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করতে হয়।
রিয়েল এস্টেট খাতে ৩ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করলে মাল্টা গোল্ডেন ভিসা দিয়ে থাকে। ভোলেক জানান, মাল্টার এই ভিসা মার্কিনীদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তিনি বলেন, 'মাল্টার নাগরিকত্ব নিয়ে ইউরোপিয়ান নাগরিক হয়ে যাওয়া যায়, পাওয়া যায় ইউরোপজুড়ে স্থায়ী হওয়ার অধিকার। কাজেই আপনি চাইলে জার্মানিতেও থাকতে পারেন। আর আপনার সন্তান ফ্রান্সে পড়াশোনা করতে পারবে। সেইসঙ্গে সমগ্র ইউরোপে কাজ ও পড়াশোনা করার অধিকার পাবেন আপনি।'
মার্কিনীদের বাড়তি নাগরিকত্ব নেওয়ার পেছনে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে। বিকল্প পাসপোর্ট থাকলে মার্কিনীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কম এমন সব দেশে ভ্রমণ সহজ হয়।
হেনলির প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন, ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি নাগরিকদের হুট করেই বিভিন্ন দেশে বৈরী চোখে দেখা হচ্ছে। তাই তাদের জন্য বাড়তি পাসপোর্ট বেশ সুবিধাজনক। বৈশ্বিক অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে। এ সময়ে বাড়তি কোনো দেশের, বিশেষ করে নিরপেক্ষ দেশের পাসপোর্ট থাকলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।
আরেকটি কারণ হচ্ছে ব্যবসায়িক ভ্রমণ। অনেক দেশেই অ-মার্কিনী পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ তুলনামূলক নিরাপদ ও কম সন্দেহজনক হতে পারে। মার্কিন ব্যবসায়ী নেতারা কিছু দেশে প্রতিরোধের মুখে পড়তে পারেন। এমনকি তাদের 'জিম্মি বা অপহরণও করা হতে পারে' বলে আশঙ্কা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে হেনলির প্রতিবেদনে।
দ্বিতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে নতুন দেশে আন্তঃসীমান্ত আর্থিক লেনদেন বা চুক্তির কাজ আরও সহজ হতে পারে।
এছাড়া কিছু ধনী মার্কিনী স্রেফ সম্ভাব্য অবসরের জন্য দ্বিতীয় একটি নিবাস রাখতে চান, যাতে বিদেশে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি থাকা যাতে। অন্যরা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির জন্য বাড়তি দেশের পাসপোর্ট নিচ্ছেন।
ভোলেক বলেন, 'শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সব দেশেই আমরা সবাই এক অনিশ্চিত সময় পার করছি। কে জানে কখন কী ঘটে যায়।'
হেনলি বলছে, সারা বিশ্বেই ২০২৪ সালে মিলিয়নেয়ারদের অভিবাসন নতুন রেকর্ড গড়তে পারে। সরকারের হাতে সম্পদ জব্দ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়ে আরও বেশিসংখ্যক ধনী নিজ দেশ ছেড়ে বাইরের দেশে চলে যেতে পারে।
হেনলির তথ্যানুসারে, চলতি বছর ১ লাখ ২৮ হাজার মিলিয়নেয়ার নতুন দেশে চলে যেতে পারেন। ২০১৯ ও ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১ লাখ ২০ হাজার ও ৫১ হাজার।
অন্যান্য দেশ ছেড়ে পাড়ি জমানোর জন্য মিলিয়নেয়ারদের পছন্দের গন্তব্য হিসেবে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ২ হাজার ২০০ জন মিলিয়নেয়ার পাড়ি জমান। ২০২৪ সালে এ সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০-তে ঠেকতে পারে বলে জানিয়েছে হেনলি।
দেশ থেকে মিলিয়নেয়ার বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে চীন। গত বছর চীনের ১৩ হাজার ৫০০ মিলিয়নেয়ার দেশ ছেড়েছেন।
ভোলেক বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রে মতো সম্পদ গড়ার সুযোগ বিশ্বের আর কোথাও নেই।'