ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকিতে আছে ৬০০ তৈরি পোশাক কারখানা
আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে বেতন, বোনাস ও ছুটি সংক্রান্ত ইস্যুতে দেশের অর্ধ সহস্রেরও বেশি তৈরি পোশাকের কারখানায় অসন্তোষ দেখা দিতে পারে বলে শিল্প পুলিশের গোয়েন্দা নথিতে উঠে এসেছে।
এরমধ্যে বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর ৩৮২টি কারখানা, বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর ৯২টি কারখানা এবং বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে ৪০টি কারখানা রয়েছে।
দেশজুড়ে শিল্প পুলিশের ৬টি ইউনিটের মাঠ পর্যায়ের দৈনিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ তালিকা করা হয়েছে, যার একটি কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর হাতে এসেছে।
ওই তালিকা অনুযায়ী, অসন্তোষের ঝুঁকিতে থাকা কারখানাগুলোর মধ্য ৯২টি কারখানা শিল্প পুলিশ জোন-১ এর অধীনে ঢাকা ও আশুলিয়া এলাকায় অবস্থিত। এছাড়া শিল্প পুলিশ জোন-২ এর অধীনে গাজীপুর এলাকায় অবস্থিত ৩৪২টি, শিল্প পুলিশ জোন-৩ এর অধীনে চট্টগ্রাম এলাকায় অবস্থিত ৬৮টি, শিল্প পুলিশ জোন-৪ এর অধীনে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ৫৭টি এবং শিল্প পুলিশ জোন-৫ এর অধীনে ময়মনসিংহ এলাকায় অবস্থিত ১৪টি কারখানা।
তবে শিল্প পুলিশ জোন-৬ এর অধীনে থাকা খুলনা এলাকার কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরির কোনো ঝুঁকি নেই বলে প্রতিবেদনের তথ্য বলছে।
এ বিষয়ে বিকেএমইএ'র একজন পরিচালক জানিয়েছেন, অধিকাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্পগুলো তাদের শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ নিয়ে বেশ চাপে আছে।
তিনি বলেন, "এখন আমাদেরকে একই মাসে জুন, জুলাইয়ের বেতন এবং ঈদ বোনাস তিনটিই পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু করোনার কারণে ব্যবসায় মারাত্মক ধ্বস নামায় সেই মার্চের শুরু থেকেই আমরা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।"
তিনি আরও বলেন, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই তাদের খরচ কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন কমিয়েছে, কোথাও কোথাও ইনক্রিমেন্ট এবং প্রমোশনও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বিজিএমইএ'র জ্যেষ্ঠ অতিরিক্ত সচিব মনসুর খালেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের কাছে মাঠ পর্যায়ের একটি মনিটরিং রিপোর্ট রয়েছে যাতে দেখা যায়, বেতন, ঈদ বোনাস এবং ছুটি সংক্রান্ত ইস্যুতে ১১৭টি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ তৈরির ঝুঁকি রয়েছে।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে ওই কারখানাগুলো আমাদের সার্ভেইল্যান্স টিমের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। এটা আমাদের রুটিন ওয়ার্ক যা আমরা প্রতি বছরই করি।"
তিনি আরও বলেন, "বিষয়টির সমাধানে আমরা ওই কারখানা মালিকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি এবং আমরা আশা করছি ঈদের ছুটির আগেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।"
বিজিএমইএ'র এই কর্মকর্তা দাবি করেন, তাদের অধীনে থাকা ১,৯২৬ টি কারখানার মধ্যে ১,৮৫৪ টি কারখানায় শ্রমিকদের বেতন ইতোমধ্যেই পরিশোধ করেছেন তারা।
শিল্প পুলিশের বুধবারের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৭৫৬টি কারখানা এখনো তাদের কর্মীদের জুন মাসের বেতন পরিশোধ করেনি। এর মধ্যে বিজিএমইএ'র অধীনে কারখানা আছে ২৭৯টি, বিকেএমইএ'র অধীনে আছে ৩৯১টি এবং বিটিএমএ এর অধীনে আছে ৮৬টি কারখানা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সচিব মনসুর আহমেদ বলেন, "সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিটিএমএ ইতোমধ্যেই সকল সদস্যের নির্দেশনা দিয়েছে। আশাকরছি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আমরা শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে পারবো।"
এ বিষয়ে বিজিএমইএ'র সহ-সভাপতি আরশাদ জামাল দিপু বলেন, "সমস্যাগ্রস্ত যে কারখানাগুলো আছে সেগুলোর সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি এবং প্রতিবছরই এটা করি।"
তিনি বলেন, "বিজিএমইএ সবসময়ই কারখানা মালিক এবং ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। যদি কোনো কারণে তারা অর্থ যোগাড় না করতে পারে তবে অ্যাসোসিয়েশন তাদেরকে টাকা ধার দেয় যা এক বছরের মধ্যে ফেরত দিতে হয়। এটার রিকোভারি রেট খুবই কম।"
গত ২২ জুন এক বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান কারখানা মালিকদের অনুরোধ জানান, ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে ঈদ বোনাস এবং ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে চলতি মাসের বেতনের অর্ধেক শ্রমিকদের পরিশোধের জন্য।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এবং উৎপাদন চলমান রাখতে কোনো শ্রমিককে যেন ছাঁটাই না করা হয় সে বিষয়েও শিল্প মালিকদের পরামর্শ দেন প্রতিমন্ত্রী।
বিকেএমইএ'র সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আর্থিক সংকটে পড়ায় তাদের সংগঠনের অধীনে থাকা বেশকিছু কারখানা কর্মীদের জুন মাসের বেতন এখনো পরিশোধ করতে পারেনি।
তিনি জানান, সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছে তাতে প্রায় অর্ধেক কারখানাই সুযোগ পায়নি।
তিনি বলেন, "আমি মনে করি ওই কারখানাগুলোর সামর্থ্য রয়েছে। তারা হয়তো জুলাই মাসের বেতন পুরোটা বা অর্ধেক পরিশোধ করবে। তবে সংগঠন হিসেবে এজন্য আমরা তাদের চাপ দেইনি। আমরা আমাদের সংগঠনের সদস্যদের বলেছি, শ্রমিক আইন এবং মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের ভিত্তিতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য।"
বিকেএমইএ'র এই নেতা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যখন এ ধরণের কথা বলা হয় তখন শ্রমিকদের মধ্যে আরেক মাসের বেতনের বিষয়ে আশা তৈরি হয় যার ফলে শ্রমিক অসন্তোষের মুখোমুখি হওয়ার একটা ঝুঁকি তৈরি হয় মালিকদের মধ্যে।
তবে শ্রমিক আইনে আগের মাস শেষ হওয়ার পর সাত কর্মদিবসের মধ্যেই মালিকদেরকে কর্মীদের বেতন পরিশোধের জন্য বলা আছে।