২০২৩ সালে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ ১৬% কমেছে
বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা ও বৈদেশিক বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতাসহ বেশকিছু কারণে নির্বাচনকালীন বছর ২০২৩ সালে দেশের নেট ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ১৬ শতাংশ কমেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সাল শেষে দেশে নেট এফডিআই হয়েছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২২ সালে যা ছিল ৩.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই প্রবাহ ৪৭৫ মিলিয়ন ডলার কমেছে।
বাংলাদেশের এফডিআই প্রবাহ কেন কমেছে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন আগের তুলনায় কিছুটা খারাপ। নতুন বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে এটি বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
"সেইসঙ্গে আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট (লেনদেনের ভারসাম্য) খুব ভালো অবস্থায় না থাকাও একটি কারণ। এছাড়া, বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশেই এফডিআই প্রবাহ কমেছে," বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে সবচেয়ে বেশি ৬১৪ মিলিয়ন বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। এছাড়া নেদারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কোরিয়া, নরওয়ে, সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো থেকে ভালো অঙ্কের বিনিয়োগ পেয়েছে বাংলাদেশ।
২০২৩ সালের নেট এফডিআই প্রবাহের ৭৩ শতাংশ বা ২.২১ বিলিয়ন ডলার ছিল রিইনভেস্টেড আর্নিংস। অর্থাৎ, পুরনো বিদেশি বিনিয়োগ থেকে যে রিটার্ন বা ফেরত পাওয়া গেছে, সেটিকে আবার বিনিয়োগ করা থেকেই দেশের মূল এফডিআই প্রবাহ হয়েছে। এছাড়া, ৭০৫ মিলিয়ন ডলার এফডিআই এসেছে ইকুয়াল ক্যাপিটালের মাধ্যমে, যেটি গত ৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
রিইনভেস্টমেন্ট আর্নিং কেন এফডিআইয়ের মেজর অংশ— এমন প্রশ্নের উত্তরে আহসান এইচ মনসুর বলেন, "আমাদের দেশে বিনিয়োগের রিটার্ন খুবই ভালো। তাই, অনেকেই ইনভেস্টমেন্ট থেকে যে আয়টা করেন সেটা আবার বিনিয়োগ করেন।"
"তবে, অনেক ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীরা তাদের আর্নিং ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিনিষেধসহ নানান প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাধ্য হয়ে আর্নিংকে আবার ইনভেস্টমেন্ট করেন," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ৫৯১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এসেছে টেক্সটাইল এবং ওয়্যারিং খাতে। এছাড়া ব্যাংকিং, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পেট্রলিয়াম ও খাদ্যের মতো খাতগুলোতে ভালো বিনিয়োগ এসেছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয় টিবিএসকে বলেন, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে এফডিআই কমে যাওয়ার ব্যাপারটি অবাক করার মতো কিছু নয়।
তিনি বলেন, এফডিআই প্রবাহ কমে যাওয়ার পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে— প্রথমত, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্বাচনী বছরে নতুন বিনিয়োগ করতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আঙ্কটাড)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী এফডিআই প্রবাহ ১২ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে; এখানে বাংলাদেশও ব্যতিক্রম ছিল না।
তৃতীয়ত, দেশের অস্থিতিশীল ফরেক্স (বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার) পরিস্থিতির কারণেও বিনিয়োগকারীরা কিছুটা থেমে ছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কীভাবে এফডিআই প্রবাহ বাড়ানো যায় জানতে চাইলে এই ব্যাংকার বলেন, "নির্বাচন শেষ হয়েছে; আগামী পাঁচ বছরের জন্য রাস্তা পরিষ্কার। ফলে বিনিয়োগকারীরাও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অধিগ্রহণসহ নতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে।"
"কিন্তু এই সুযোগগুলোকে ব্যবহার করতে হলে, আমাদের দেশে ব্যবসা করার পদ্ধতিকে আরও সহজ করতে হবে। যেমন— ব্যবসা শুরু থেকে লজিস্টিক, কাস্টমস এবং ট্যাক্সেশনের মতো বিষয়গুলো সহজ করতে হবে। এছাড়া, লাভ বা লভ্যাংশ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা, পাশাপাশি ইক্যুইটি বিক্রয়ের প্রক্রিয়াও নতুন বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে," বলেন তিনি।
নাসের এজাজ বিজয় আরও জানান, পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি উন্নত হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এফডিআইয়ের পরিমাণ বাড়বে; বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হবেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই অর্ধ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজারে পরিণত হয়েছে। ২০৩১ সালে দেশের নমিনাল জিডিপি ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানোর সম্ভাবনা রয়েছে; তখন বাংলাদেশ বিশ্বের ৯ম বৃহত্তম ভোক্তা অর্থনীতিতে পরিণত হবে।