এই দেশে এখনও ২০১৬ সাল!
২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে যদি আপনাকে বলা হয় এখন ২০১৬ সাল এবং সেটি যে আপনি বিশ্বাস করবেন না, তা শতভাগ নিশ্চিত। এমনকি বিষয়টি আপনার কাছে উদ্ভটও মনে হতে পারে। কিন্তু যদি বিষয়টি বাস্তব হয়, তাহলে?
হ্যাঁ, বিষয়টি সত্যিই। এটি কোনো গল্প নয়। পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় এখন ২০১৬ সাল! আগামী ১১ সেপ্টেম্বর ইথিওপিয়ানরা ২০১৬ সালকে বিদায় জানাবেন। সেই সাথে পালন করবেন বর্ষবরণ উৎসব। তারা যে সালকে স্বাগত জানাবেন, ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সেটি হলো ২০১৭।
আফ্রিকার দ্বিতীয় জনবহুল এই দেশটি বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে সাত বছর আট মাস পিছিয়ে। কেন দেশটি পিছিয়ে, আর কীভাবে পিছিয়ে থেকেও দেশটি বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করছে, এখন সেটিই প্রশ্ন?
এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে ইথিওপিয়ানদের শতাব্দী পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যেই।
অনন্য বর্ষপঞ্জি
সময়ের দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণ হলো- ইথিওপিয়ায় যিশু খ্রিস্টের জন্ম সাল গ্রেগরিয়ান বা 'পশ্চিমা' বর্ষপঞ্জির সময়ের চেয়ে সাত বা আট বছর পিছিয়ে হিসাব করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রোমান চার্চ ৫০০ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে তাদের বর্ষপঞ্জিতে সামঞ্জস্য আনলেও ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ পুরনো বর্ষপঞ্জিতেই থেকে যায়। বিশ্বের অন্য দেশগুলোও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার গ্রহণ করলেও ইথিওপিয়া করেনি।
রোটেট ইথিওপিয়া ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলের প্রধান নির্বাহী এশেতু গেতাশু বলেন, 'আমরা অনন্য। আমাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি আছে, নিজস্ব বর্ণমালা ও সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য আছে।'
ধারণা করা হয়ে থাকে ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডার দেড় হাজার বছরের পুরনো। এ ক্যালেন্ডারের সাথে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার কপ্টিক অর্থোডক্স চার্চের কপ্টিক ক্যালেন্ডারের বহু মিল রয়েছে।
সৌর-চন্দ্র পদ্ধতি অনুযায়ী, ইথিওপিয়ার ক্যালেন্ডারে মাসের সংখ্যা ১৩টি। প্রথম ১২টি মাস ৩০ দিনের। আর শেষ মাস অর্থাৎ ১৩তম মাসটি খুবই ছোট। মাত্র পাঁচ দিনের। তবে অধিবর্ষে মাসটি ছয়দিনের হয়ে থাকে।
দেশটিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্কুলগুলো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে পরিচালিত হয়। তাই অনেক ইথিওপিয়ানই ইচ্ছা না থাকার পরও নিজেদের বর্ষপঞ্জির পাশাপাশি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেন।
বর্তমানে জার্মানিতে অবস্থানরত ইথিওপিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিক গৈতম ডব্লিউ টেকল বলেন, 'এটি খুবই কঠিন। আমি ওই ক্যালেন্ডারের সাথে মানিয়ে নিতে পারি না। এটি চ্যালেঞ্জিং।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাকে ঘণ্টা নিয়ে, দিন নিয়ে, কখনো মাস নিয়ে এবং এমনকি কখনও বছর নিয়েও ভেবে তারপর নিশ্চিত হতে হয়।'
টেকল জানান, কিছু প্রতিষ্ঠানকে ইথিওপিয়ানদের সাথে বিশেষ করে যারা প্রত্যন্ত এলাকায় কিংবা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, তাদের সাথে যোগাযোগের সময় দুটি ক্যালেন্ডারই অনুসরণ করতে হয়।
তিনি জানান, সময়ের এ ভিন্নতার কারণে জন্ম সনদের আবেদনের মতো সহজ কাজটিতেও দুটি ক্যালেন্ডারের সময়ে সামঞ্জস্য আনার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি হতে পারে।
তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি
এ বিষয়ে জার্মান ইতিহাসবিদ ভেরেনা ক্রেবস জানান, ধরুন একটি শিশুর বয়স তিন বছর। আপনি শিশুটির জন্ম সনদের জন্য স্থানীয় সরকারের কাছে আবেদন করলেন। আবেদনের সময় আপনি ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিশুটির জন্মের সময় উল্লেখ করলেন। এরপর কর্তৃপক্ষ সঠিকভাবে ইথিওপিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শিশুটির জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকে যায়।
তিনি আরও জানান, দুই ক্যালেন্ডারের সময়ের পার্থক্যের কারণে শিশুটির বয়স সঠিক বয়সের চেয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণও হয়ে যেতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন যে যারা বিষয়টির সাথে অভ্যস্ত নন, তাদের এটি নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে।
১২ ঘণ্টার ঘড়ি
ইথিওপিয়ানদের সময়ের হিসাবটিও বিচিত্র। যেখানে বেশিরভাগ দেশে দিনের শুরুটা হিসাব করা হয় মধ্যরাত অর্থাৎ রাত ১২টা থেকে, ইথিওপিয়ায় সেটি হিসাব করা হয় সকাল থেকে। বেশিরভাগ দেশ যেখানে ২৪ ঘণ্টার ঘড়ি পদ্ধতি ব্যবহার করে, সেখানে ইথিওপিয়ানরা ব্যবহার করে ১২ ঘণ্টার ঘড়ি। এ ঘড়ি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। তবে মজার ব্যাপারটি হলো এই ঘড়িতে সময় শুরু হয় সকাল ১টা থেকে।
সকাল ১টা শুনে মনে খটকা তৈরি হতে পারে। তবে বিষয়টি হলো বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যে সময়কে সকাল ৭টা বলে বিবেচনা করে, ইথিওপিয়ানদের ঘড়ি অনুযায়ী সেটি হলো সকাল ১টা।
আলোকচিত্রী আবেল গেশাও বলেন, 'ইথিওপিয়া একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল খ্রিস্টান দেশ, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাকি বিশ্বের কথা চিন্তা করে না। পশ্চিমা বিশ্বে যেভাবে কাজ করা হয়, তা নিয়ে অনেক ইথিওপিয়ানেরই, বিশেষ করে যারা গ্রামে বাস করেন তাদের ন্যূনতম আগ্রহও নেই।
তিনি বলেন, 'তারা আপনাকে একটি সময় বলে…তারা হয়ত এটা জানেও না যে সময় গণনার আরেকটি উপায় আছে।'
ইথিওপিয়া তার সময় পদ্ধতি, ক্যালেন্ডার বা বছর গণনার পদ্ধতি পরিবর্তন না করেই নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২০২৪ বা ২০১৬ সালে পৌঁছেছে।
তবে এখন প্রশ্ন হলো- তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে দেশটির প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরাও দিন দিন বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে সংযুক্ত হচ্ছে। তাই অদূর ভবিষ্যতে ইথিওপিয়ানরা কি তাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি থেকে বেরিয়ে আসবে, নাকি তাদের আদি বর্ষপঞ্জিতেই থেকে যাবে?
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক