বই নয়, বাদ্যযন্ত্রের ঢাকার কলেজ স্ট্রিট কোথায়?
কেউ কেউ বলেন, জাদুর শহর ঢাকা। আমি বলি, ঢাকা গল্পের শহর। কত না লেখা গল্প যে জমে আছে এই শহরতলীর অলিগলিজুড়ে। বৃষ্টি নামলে গলিজুড়ে জলের ধারা। রেইনকোট গলিয়ে খুব সাবধানে স্কুলপড়ুয়া ছেলেটিকে নিয়ে বাসায় ফিরছেন বাবা। গলিতে ঢুকতেই কেডসটাকে বৃষ্টির জলে ভিজিয়ে ছেলেটার কী আহ্লাদমাখা আনন্দ…
আবার এই গলির মুখেই বাসার পানে চেয়ে হাত নাড়তে নাড়তে অফিসে যান মা। কারো কারো গোপন প্রণয়ের স্মৃতিজুড়ে এমন নাম না জানা গলি। মোড়ের মাথায় এসব প্রেম গড়ে, আবার ফুরিয়েও যায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মতনই একলা অলিগলিরা কত ঘটনার নীরব সাক্ষী! নাগরিক যন্ত্রণা আর ট্রাফিক জ্যামের হিসেবনিকেশে আমরা বাসা বদলাই। তবু সেসব অলিগলির স্মৃতি থেকে যায় মনের অলিগলিজুড়ে। ঢাকার কলেজ স্ট্রিট এমনই এক গলি।
না, কলকাতার কলেজস্ট্রিট নয়। আজকে বলব, ঢাকার কলেজ স্ট্রিটের গল্প। আমাদের বইয়ের ঘরদোর অবশ্য কলেজস্ট্রিটে না, সেখানা নীলক্ষেতে। আমাদের কলেজ স্ট্রিটজুড়ে সুরের বসবাস।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসটাকে ছাড়িয়ে বইয়ের গন্ধমাখা নীলক্ষেত মোড় পেরোতেই নিউমার্কেট আর নুরজাহান প্লাজার এলাকা। কেনাকাটা আর ক্রেতাবিক্রেতার ভিড়ভাট্টা এই রাস্তার দুপাশটাতেই। মিরপুরের দিকে মুখ করে হাঁটতে শুরু করলে নুরজাহান প্লাজার একদম বিপরীতে ঢাকা কলেজ। দু'পা এগোতেই ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। তা অনেক তো হাঁটলাম। এবারে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত'র থেকে একটু কোট করা যাক,
'দাঁড়াও, পথিক-বর জন্ম যদি তববঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!'
অবাক হলে চলবে কেন? দাঁড়ান কিছুক্ষণ, একটু জিরিয়ে নিন। মিরপুর-নিউমার্কেট রুটে কখনো না কখনো যদি আপনার যাওয়া আসা করা হয়ে থাকে, তবে সাইন্স ল্যাবের ট্রাফিক জ্যাম আপনার চিরচেনা। হ্যাঁ, আমরা এখন ওখানটাতেই জিরোচ্ছি। এবারে চোখ মেলে বায়ে তাকালেই দেখবেন, গলির মোড়ে লেখা 'কলেজ স্ট্রিট'। একটু আগেই বলেছি, কলেজ স্ট্রিটে সুরের বসবাস। এখন সে সুর খুঁজে নেবার পালা। আপনাদের আর কত ধোঁয়াশায় রাখা যায়? সুরের ব্যাপারটা এবারে খোলসা করা যাক।
কলেজ স্ট্রিটের গলির সামনেটাতে ঢাকা শহরের সুরময় কোলাহল। আমি একেবারেই ট্রাফিক জ্যামের কথা বলছি না। আমি বলছি গিটার, হারমোনিয়াম, তবলা, ইউকেলেলে, একতারা, দোতারা কিংবা সেতারের কথা। এসব বাদ্যযন্ত্রর ঘরদোর ঢাকার কলেজ স্ট্রিটের মোড়। কলেজ স্ট্রিটে পাবেন সুর তোলার এমন সব সরঞ্জামের সারি সারি দোকান।
গল্পের খোঁজে একদিন ঢাকার কলেজ স্ট্রিট গেলাম। আশ্চর্যের কথা এই যে, শুধু গল্প পেলাম না। গল্পের সাথে খুঁজে পেলাম সুর। বেসুরো মানুষদেরও তো সুর নিয়ে লিখতে, জানতে, আলাপ করতে ইচ্ছে হয়। তাই অনেকটা কৌতুহল থেকেই সুরের ঘরদোরে টুকটাক উঁকিঝুঁকি দেওয়া।
মিউজিক প্লাস
কলেজ স্ট্রিটের গলির একদম বা হাতে 'মিউজিক প্লাস' নামের দোকানে ঢুকতেই চোখ পড়লো বাঁশিতে। শচীন দেববর্মনের 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই' এর সেই 'পোড়া বাঁশি'। মিউজিক প্লাসের বাদ্যযন্ত্রের সমাহার চোখ ধাঁধানো বললে একেবারেই বাড়িয়ে বলা হবে না। শুধু দেশি বাদ্যযন্ত্র যে রয়েছে এমনটা নয়; ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং আমেরিকা থেকে আনা বাদ্যযন্ত্র মিলবে মিউজিক প্লাসে। গিটার, হারমোনিয়াম, অ্যাকুয়েস্টিক ড্রামস, ম্যান্ডোলিন, কী বোর্ড। সত্যিই কালেকশন মন ভালো করে দেবার মতনই। এই দেখুন, মিউজিক প্লাসের বিশেষত্বটাই তো এখনো বলা হয়ে উঠলো না। শুধু নতুন বাদ্যযন্ত্র নয়, পুরোনো বাদ্যযন্ত্রেরও বসবাস এই দোকানটিতে। কেউ চাইলে এখানে নতুন বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি কেনাবেচা করতে পারেন পুরোনো বাদ্যযন্ত্রও। এছাড়া আছে সার্ভিসিং এর ব্যবস্থা।
মিউজিক প্লাসের সত্ত্বাধিকারী রতন রায়। দারুণ কালেকশনের এই দোকান মালিক আলাপ করলেন আন্তরিকভাবেই। তিনি জানালেন, ৩০ বছরের বাদ্যযন্ত্রের পারিবারিক ব্যবসা তার। শুধু সুর তোলার যন্ত্র কেনাবেচাতেই কিন্তু সীমাবদ্ধ নেই; রতন রায় এ সমস্ত মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতেও জানেন। শুধু জানেনই না, শেখানও বটে।
সুরের সমঝদার রতন রায়ের সুরের প্রতি ভালোবাসার ব্যাপারটা ধরা পড়তে দেরি হলো না। ২০০৭ সালের দিকে কলেজ স্ট্রিটে মিউজিক প্লাস গড়ে তোলেন তিনি। এখন মিউজিক প্লাসের মোট দুখানা শোরুম এই কলেজ স্ট্রিটে। একটি দোকান কলেজ স্ট্রিটের বা'দিকে, সেটি তো বললামই। একই মালিকের আরও একখানা দোকান রয়েছে গলির ভেতরের দিকে— যেটি আরও বড় দোকান।
আজাদ ট্রেডার্স
মিউজিক প্লাস থেকে বের হয়ে ঢুকলাম আজাদ ট্রেডার্সে। এই দোকানটিতে গিটার আর ইউকেলেলের ভিড়টাই বেশি, অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র কিছুটা কম। এসব গিটারেরে কিছু অংশ আসে ফ্রান্স এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে। এই দোকানটির মালিক আবুল কালাম আজাদও কিন্তু ইন্সট্রুমেন্ট শেখানোতে ওস্তাদ। তবে আর বলছি কী? এখানেও রয়েছে বাদ্যযন্ত্র শেখবার ব্যবস্থা।
আজাদ ট্রের্ডাসের ম্যানেজার আবু বকর সিদ্দিকীর সাথে কথা বলে জানা গেল, দোকানটির মালিকদের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা ৪০ বছরের। কলেজ স্ট্রিটে এটিই একমাত্র মুসলিম মালিকানাধীন বাদ্যযন্ত্রের দোকানও বটে। এই দোকানটিতে দেড়লাখ টাকা মূল্যের গিটার অব্দি রয়েছে। তবে এ সমস্ত গিটার ডিসপ্লেতে রাখা থাকে না। ৬০ হাজার সমমূল্যের গিটারগুলো ক্রেতাদের জন্যে ডিসপ্লেতে রাখা থাকে। এছাড়া রয়েছে ইউকেলেলে।
২০১৫ সালের পর থেকে ইউকেলেলের চাহিদা আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করে। দেখতে ছোটোখাটো, অবয়বটা গিটারের মতনই। তবে ইউকেলেলে নামক যন্ত্রটার সুর খানিকটা মিষ্টি, গিটারের মতন রাশভারি নয়। ছোটোখাটো মিষ্টি বাদ্যযন্ত্র। এর এই ছোট আকারের জন্যে জনপ্রিয়তা পেয়ে গেল দ্রুতই। বইতে সুবিধা। আবার শেখাটাও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের থেকে তুলনামূলক সোজা।
আজাদ ট্রেডার্স বিভিন্ন সাইজের বিভিন্ন ডিজাইনের ইউকেলেলে বিক্রি করে। তবে যেসব ইউকেলেলেতে বিভিন্ন রঙের ব্যবহারে রঙিন নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়, থিম অনুযায়ী সেগুলোর চাহিদা যেন একটু বেশি— এমনটাই জানালেন দেকানের ম্যানেজার। শুনে মনে হলো, 'প্রথমে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী' কথাটি একেকবারে ফেলনা নয়। সত্যিই। ইউকেলেলে যন্ত্রটা দেখলেই মন যেন বলে ওঠে, কিনে ফ্যাল!
এই দোকানের একখানা অসুবিধের দিক এই যে, এদের কোনো অনলাইন সেকশন নেই। সুতরাং, সংগীত অনুরাগীকে কিছু কিনতে হলে হাজির হতে হবে সশরীরে।
সিভিক মিউজিক পয়েন্ট, মিউজিক জোন
২০১৫ সাল থেকে কলেজ স্ট্রিটে ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়ার বাদ্যযন্ত্রের দোকান সিভিজ মিউজিক পয়েন্ট এবং মিউজিক জোন। এই দোকানের সব কর্মচারীই বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে পারদর্শী। দোকানটিতে সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র দেখা গেল কম বেশি, অর্থাৎ কোনো বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের আলাদা দোকান একেবারেই নয়।
এই দোকানের মালিকের সাথে সাক্ষাতে জানতে পারলাম, তাদের বেচাকেনার ক্ষেত্রে অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইন পেইজ একটা বড়ো ভূমিকা রাখে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের কাছ থেকে সংগীতপ্রেমী কাস্টমাররা কিনে থাকেন বাদ্যযন্ত্র।
এসব দোকানে ক্রেতাদের আনাগোনা লেগে থাকলেও দোকানের মালিকপক্ষ কথা বলতে দিতে চান না কাস্টমারদের সাথে। সবটুকু মনোযোগ তারাই চান, তবু অনেক কষ্টে কথা বলা গেল একজন ক্রেতার সাথে। এই ক্রেতা জানালেন, তিনি তার বন্ধুর পরামর্শে কলেজ স্ট্রিট থেকে ইউকেলেলে কিনতে এসেছেন। তবে এখনই কিনবেন না। বেশ কয়েকটা দোকান ঘুরে দামদর করে তারপর কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আরেকজন ক্রেতা সোহাগ। এক দোকান থেকে বের হয়ে আরেক দোকানে ঢোকবার মুখে কথা হলো এই ক্রেতার সাথে। তার মফস্বলে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা। তিনি কলেজ স্ট্রিট থেকে পাইকারিভাবে বাদ্যযন্ত্র কিনে নিয়ে নিজের এলাকায় বিক্রি করেন। এছাড়া পুরোনো বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচাও করেন। তিনি মনে করেন, দরদামে ও বাদ্যযন্ত্র যাচাই বাছাইয়ে দক্ষ এমন কাউকে সাথে নিয়ে এ ধরনের বাদ্যযন্ত্র কিনতে আসা উচিত।
কেন বেছে নেওয়া হলো কলেজ স্ট্রিট?
কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় সারি সারি বাদ্যযন্ত্রের দোকান যেন ফুরোতে চায় না। তবলার জন্যে বিখ্যাত সুরনিকেতন থেকে শুরু করে সুরশ্রী, আদি সুরশ্রী, অ্যাকুস্টিকা, মেলোডি অ্যান্ড কোং, টিউন ক্যাসেল, মিউজিক জোন, রিপন মিউজিকসহ কত না দোকান। আর তার মধ্যে সেজেগুজে বসে আছে দেশি-বিদেশি সুর তোলার যন্ত্র। কিন্তু আশেপাশে সংগীত কলেজ তো নেই। তবে কেন কলেজ স্ট্রিট?
কলেজ স্ট্রিটের আশেপাশেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে ঢাকা কলেজ, ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুল। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যে কলেজ স্ট্রিট মোড় বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচার একটা ভালো কেন্দ্র বলে মনে করে অধিকাংশ স্বত্বাধিকারী। জানা গেল এমনটাই। তাই আজ থেকে নয়, প্রায় ২৫/৩০ বছর আগে থেকেই এই জায়গাকে বেছে নিয়েছিলেন বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের এই পরিকল্পনা কিন্তু একেবারেই বিফলে যায়নি।
কলকাতা শহরের যে রাস্তার ধারে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে সংস্কৃত কলেজ, সেই ১.৫ কিলোমিটার রাস্তাটিরই নাম দেওয়া হলো কলেজ স্ট্রিট। তেমনিভাবে, ঢাকার কলেজ স্ট্রিটও নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই। কলেজস্ট্রিট নামের রহস্য উদ্ধার করতে পেরে আলাদা স্বস্তিবোধ করলাম। এই রাস্তায় একইসাথে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আনাগোনা ভাবতেই অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে উঠলো।
সন্ধ্যে নামতেই পাখিরা যেমন করে ঘরে ফেরে, তেমনি বাসায় ফিরতে দেখা যায় অফিস ফিরতি মানুষদের। কলেজ স্ট্রিট মোড়ে এমন সব মধ্যবয়স্ক মানুষদের চায়ের আড্ডায় চোখ পড়লো। সারাদিন কাজের ক্লান্তির সাথে ছুটির স্বস্তিবোধ সবটাই চায়ের চুমুকে মিলেমিশে একাকার বলে মনে হলো বটে। ছাত্র-ছাত্রীরা তখন আবার ক্লাস শেষে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছে সদ্য। তাই সন্ধ্যেবেলাটায় কলেজ স্ট্রিটে ব্যস্ততা বাড়ে। রাত গাঢ় হলে কোলাহল কমে। বাদ্যযন্ত্রের দোকানগুলো সাড়ে ৯ টা বাজলে সেদিনকার মতন করে তল্পিতল্পা গোটাতে শুরু করে। নিস্তব্ধতা নামে কলেজ স্ট্রিটজুড়ে। পরদিন আবারও কোলাহলে মুখর হয় এই তল্লাট।
ঢাকা শহরে ইলেকট্রিক তারের ভিড়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে নীল আকাশটুকু দেখতে পাওয়া যায় না। তবু শহরের মানুষ কী আকাশ খোঁজে না? নাগরিক অভিশাপে কবিতারা পালাতে চাইলেও অনেক কবির বাস এই ঢাকা শহরের বুকে। কলেজ স্ট্রিটকে শহরতলির মানুষ চেনে সাইন্স ল্যাব মোড়ের ট্রাফিক জ্যামের জন্যে। সেজন্যে তাদেরকে দুষতে পারি না। ক্লাস, পরীক্ষার সময় এই ট্রাফিক জ্যাম সমস্তকিছু ওলটপালট করে দেয়। মানসিক চাপে তখন সুরশ্রী কিংবা সুরনিকেতনের দিকে চোখ পড়ে না। চোখে ভাবালুতা জমাট বাধতে পারে না। তবু তো অবসর সবারই থাকে। এমনই কোনো অবসর বুঝে দু'দণ্ড শান্তির খোঁজে একদিন আপনিও জ্যামের বিরক্তিকে ছুঁড়ে ফেলে নেমে যেতে পারেন কলেজ স্ট্রিট মোড়ে। শান্তি যদি নাইবা পেলেন, অলিগলির সরলসোজা গল্প খুঁজতে দোষ কোথায়?