কলেজ স্ট্রিটে কেলেঙ্কারি
যেখানেই আমি, সেখানেই কিছু না কিছু অঘটন। এজন্যেই বাবা আমাকে অঘটনঘটনপটীয়সী বলে ডাকতেন। গিয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিট । অঘটন ঘটাবার প্ল্যান নিয়ে যাইনি, প্ল্যান ছিল লেখালেখির৷ ভাবলাম কলকাতা যখন এলাম, কলেজ স্ট্রিট নিয়ে একটা ফিচার করাই যায়। কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করে ছবিটবি তুলে রাখি। অফিস অ্যাপ্রুভ করলে টুক করে লিখে ফেলা যাবে। রথ দেখার সাথে কলা বেচা, মানে বইটই কেনাকাটা তো হয়েই যাবে৷ সমরেশ বসুর 'চলো মন রূপনগর' বইটা ঢাকার কোত্থাও পাইনি। নিমাই ভট্টাচার্যের দুয়েকটা বইও কিনবার ছিল। যদি কলেজ স্ট্রিটে পেয়ে যাই, মন্দ কী! কলেজ স্ট্রিট ঘুরে একটু কফি হাউসের চেয়ারে পশ্চাদ্দেশ ঠেকিয়ে আসবার প্ল্যান-ট্যান করে ফেলেছি।
বইপাড়ায় গিয়ে প্রথমেই সারি সারি দোকান দেখলাম বিয়ের কার্ডের। কার্ডের ওপর রংবেরঙের নকশা আর কত কায়দাকানুনের লেখা। কার্ডের নকশা করতে ব্যস্ত কিছু তরুণ ডিজাইনার। শিল্পের মাপকাঠি যদিও টাকাপয়সা দিয়ে হয় না, তবু আমার মধ্যবিত্ত মন বলে উঠল, কার্ডগুলোর দাম নেহাত কম না। কয়েকজন কিনতে এসেছেন বিয়ের কার্ড। বিয়েটা করে ফেললেই এই নেমন্তন্ন কার্ডের কোনো দাম থাকবে না ভেবে আমার বেজায় দুঃখ হলো।
কার্ডের দোকানগুলো পেরোলেই বইয়ের রাজত্ব শুরু। খুব নিবিষ্ট মনে একটা বইয়ের দোকানের ছবি নিচ্ছিলাম। আর ভাবছিলাম এটা নিয়ে ঠিক কীভাবে লেখাটা আগানো যায়। কিন্তু ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস। পায়ের কাছে একখানা বেশ স্বাস্থ্যবান কালো কুকুর বসে ছিল। কুকুরের রং উল্লেখ করবার দরুন আমাকে বর্ণবাদী ভাববার অবকাশ নেই। যেহেতু ওর সাথে আমার একটা বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা তৈরি হবে, তাই জানাতে ইচ্ছে হলো কুকুরটির বিশদ বিবরণ।
ও বেচারার দোষ নেই। আমিই এত মগ্ন হয়ে ছবি তুলছি, খেয়াল করিনি কুকুরটাকে। ওর গায়ে পড়ে গেল আমার ডান পা। সুতরাং ওর আর তর সইল না। দিল আমার পায়ে বেশ একখানা কামড় বসিয়ে। আমি ঘটনার আকস্মিকতায় বুঝে উঠতে পারছিলাম না ঠিক কী হলো, কেন হলো। ততক্ষণে আমার পায়ে দুখানা দাঁতের ক্ষত। রক্ত পড়ছে। মা তো ভীষণ ঘাবড়ে গেল। এরপর মায়ের অনবরত বকাঝকা চলতে থাকল। আমি 'সাংবাদিকতা করতে গিয়েই জীবনটা বেঘোরে হারাব' থেকে 'যেমন বাপ তার তেমনি মেয়ে'সহ কত্ত কী! বাঙালি চিরাচরিত মায়েদের সুবিধা এই যে, সব্বারই গালাগাল দেয়ার ক্ষেত্রে একই ধরনের শব্দচয়ন, একই মুখভঙ্গি। পাঠক নিশ্চয় বুঝতেই পারছেন। কোথায় মা আমাকে সমবেদনা জানাবে, উল্টে আমি মাতৃদেবীকে আশ্বস্ত করতে থাকলাম। মায়ের ভয়টাও বুঝতে পারছিলাম বইকি! কিন্তু কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা!
মা যখন আমাকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, আমাকে ঘিরে তখন জমে গেছে একটা ছোটখাটো ভিড় ৷ ভিড়ের মধ্যে এক ভদ্রলোক আমার হাতে একটা কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, 'সরকারি হাসপাতালে ভ্যাকসিন না পেলে আমাকে ফোন দেবেন কিন্তু!' ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গিতে মনে হলো সরকারি হাসপাতালে ভ্যাক্সিন যেন না পাই, এ-ই যেন তার একান্ত কামনা। বাঙালি 'ব্যবসায়ী' হিসেবে যে দিনকে দিন নিজের নাম উজ্জ্বল করে চলেছে, তা বুঝতে পারলাম সহজেই। তা হোক, ভ্যাকসিন কিংবা বই ব্যবসা।
কলেজ স্ট্রিট থেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কাছেই। সেখানেই যাচ্ছিলাম হেঁটে আর সঙ্গে তখনও খেয়ে চলেছি মায়ের গালাগালি। আমি হাঁটবার সময়ও হাঁ করে বই দেখতে দেখতে আসছিলাম। কত যে হরেক রকমের বই। মা কটমট চোখে তাকাল আমার দিকে। এরপরের ঘটনা খুব সীমিত। কলকাতা মেডিকেল থেকে টিটেনাসের ইঞ্জেকশন দিয়ে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতাল গেলাম। সেখানে আরো তিনটে ইঞ্জেকশন। এরপর বেশ কয়েক মেয়াদে আরো তিনখানা ইঞ্জেকশন দিতে হবে শুনে বাসায় ফিরলাম।
এতগুলো ইঞ্জেকশন দেয়ার পর মাকে বলছি, একটা কথা বলি, যদি রাগ না করো।
মা বললো, বল।
আমি বললাম, ছোটোবেলায় শুনেছিলাম কুকুরে কামড়ালে ১৪ খানা ইঞ্জেকশন দিতে হয়। আমার বেলা এত কম কেন?
মা আবার ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে আমার দিকে লুক দিচ্ছিল। বলুন তো, দোষ কী দেয়া যায়? এমন নচ্ছার মেয়ে, রাগ তো একটু করবেই। ফেলুদার কৈলাসে কেলেঙ্কারি, আর আমার কলেজ স্ট্রিটে কেলেঙ্কারি।
আমার কোষ্ঠীতে লেখা আছে, 'এই জাতিকা দংশন থেকে যথাসম্ভব সাবধান থাকিবেন। ভয় আছে।' আমি জ্যোতিষ-ট্যোতিষ মানিফানি না। কোষ্ঠীতে এ-ও লেখা আছে, 'এই জাতিকা বহু পুরুষের মনোহরণকারী হইবে।' তা আর হতে পারলাম কই? দেখলেন তো, ভালোগুলো ফলে না, খারাপ ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যায়।
আক্ষেপের জায়গা হলো, কলেজ স্ট্রিটের ওপর ফিচার স্টোরি করবার মতন যথেষ্ট ইনফরমেশন কালেক্ট করতে পারিনি। ওকে, চাপ নেই। নেক্সট টাইম!