খাবারের কার্ট, সবজি বাজার: পাহাড়ি খাবারের আকর্ষণ কেন বাড়ছে?
মিরপুর এক থেকে আনসার ক্যাম্প বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার পথে ফুটপাতের ওপর নজরে আসে ছোট একটি ফুডকার্ট। বাঁশ দিয়ে সাজানো কার্টের ওপর জ্বলজ্বল করছে 'পাহাড়ি খাবার' লেখা। টিনের দরজা দেওয়া কার্টের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মোটে দুই-কি-তিন ফুট। সামনে কাচের ওপর লেখা মুংডি, চিকেন সালাদ, ফ্রাইড চিকেন সালাদসহ কয়েক পদের খাবারের নাম। প্রতিটি খাবারের দাম কেবল ৫০ টাকা!
দাম দেখেই অনেকে কার্টের সামনে থমকে দাঁড়ান। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যুগে সমতলে বসে এত কম দামে পাহাড়ি খাবারের সন্ধান পেলে তা চেখে দেখার সুযোগ ছাড়তে না চাওয়ারই কথা। তাই সূর্য পশ্চিম পাটে পাড়ি জমালেই ভিড় জমতে শুরু করে পাহাড়ি খাবার-এর কার্টের সামনে।
বাঙালি-পাহাড়ি বন্ধুর উদ্যোগ
সমতলে বাস করলেও পাহাড়কে মনেপ্রাণে ধারণ করেন — এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তাই পাহাড়প্রেমী ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ইট-বালু-কংক্রিটের শহরের মিরপুরে চালু হয়েছে পাহাড়ি খাবারের এ কার্ট। এ উদ্যোগের পেছনে আছেন দুই বন্ধু মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ও জন চাক। জন পাহাড়েরই মানুষ। আর জাহিদুল? সমতলে বাস হলেও তার মন পড়ে থাকে পাহাড়ে।
পাহাড় এবং পাহাড়ের খাবারের প্রতি ভালোবাসা থেকেই পাহাড়ি খাবার নিয়ে কাজ শুরু করেন জাহিদুল–জন। পুরোদমে ২০২৪ সালের শুরু থেকে কাজ করে যাচ্ছেন তারা। জাহিদুল বলেন, 'আমি চাকরিসূত্রে কক্সবাজারে ছিলাম। একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করে খাবারের ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নিই।'
'আমার বন্ধু জনের কমিউনিটিতে একাধিকবার যাওয়া এবং খাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাই মনে হয়েছে, ঢাকায় পাহাড়ি খাবার নিয়ে কাজ করা যায় কি না। তাছাড়া ঢাকার ফুটপাতে পাহাড়ের খাবার আগে কেউ দেখেননি', বলেন জাহিদুল।
মুংডি, লাকসু আরও কত কী!
আচমকা সমতলে পাহাড়ি খাবার নিয়ে কাজ করা নিয়ে কিছু আশঙ্কাও জাহিদুলের মনে ছিল। একেবারে খাঁটি পাহাড়ি স্বাদ গ্রহণ করতে অনেকেরই বেগ পেতে হয়। তাই কিঞ্চিৎ পরিবর্তন এনে সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের স্বাদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন জাহিদুল।
যেমন, মুংডির কথাই ধরা যাক। মুংডি মূলত মারমাদের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার। আদত মুংডির স্যুপে ব্যবহার করা হয় মাছের শুটকি। তবে বাঙালিদের জিভের কথা মাথায় রেখে এখানে কিছুটা পরিবর্তন এনে জাহিদুল ব্যবহার করেছেন চিকেন স্যুপ।
মুংডি মূলত আতপ চাল দিয়ে তৈরি এক ধরনের নুডলস। বাটিতে সেদ্ধ মুংডি ঢেলে এর ওপর দেওয়া হয় মুরগির স্যুপ। স্বাদ বাড়াতে মুরগি, ডালের বড়া, ধনেপাতা, বেরেস্তার পাশাপাশি যোগ করা হয় কিছু মসলা। সবশেষে লেবুর রস দিয়ে পরিবেশন করা হয় গরম গরম মুংডি।
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান অঞ্চলের খাবার পাওয়া যায় পাহাড়ি খাবার-এ। মুংডির পাশাপাশি এখানে দুই ধরনের মুরগির সালাদ এবং বিশেষ পাহাড়ি স্যুপের আয়োজন রয়েছে।
সালাদের তালিকায় দেখা মিলবে ভাজা মুরগি ও সেদ্ধ মুরগির সালাদ। আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা, লেবু, জিরা, লবণের সঙ্গে ভাজা কিংবা সেদ্ধ মুরগি মিশিয়ে তৈরি এ সালাদ মারমাদের কাছে লাকসু হিসেবে পরিচিত।
দৈনিক বিক্রি কয়েক হাজার টাকা
পাহাড়ি খাবার-এর সাইকেল চলতে শুরু করে প্রতিদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে, চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। দিনে প্রায় পাঁচ হাজার টাকার বেচা-বিক্রি হয় বলে জানান জাহিদুল।
ঢাকায় থাকা পাহাড়ের মানুষ এবং সমতলের বাসিন্দা সবাই পাহাড়ি খাবার-এর গ্রাহক। রান্নার পুরো দায়িত্ব জন চাকের কাঁধে। জাহিদুলের কাজ বাজারসদাই করা আর খাবার গুছিয়ে পরিবেশন করা।
তাছাড়া সব খাবারের দাম ৫০ টাকা করে হওয়ায় প্রতিদিনের জন্য আনা খাবার প্রতিদিনই বিক্রি হয়ে যায়। 'আমাদের এখানে যা খাবেন, তা-ই ৫০ টাকা। এটা ক্রেতার জন্য একটা মনস্তাত্ত্বিক ট্রিক বলা যায়। একদিকে খাবারটাও সস্তা, আর কারও কিনে খেতেও বিশেষ সমস্যা হচ্ছে না,' বলেন জাহিদুল।
বাঙালিদের মাঝে জনপ্রিয় হচ্ছে পাহাড়ি খাবার
খাবারের ভিন্ন স্বাদ, 'ভেজালমুক্ত' খাবার আর দাম হাতের নাগালে থাকায় বাঙালিদের মাঝে এখন পাহাড়ি খাবারের জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া রাজধানীতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন দোকানের সুবাদে পাহাড় থেকে আনা তাজা শাকসবজি অনায়াসে কিনতে পারছেন ক্রেতারা।
ঢাকার ভেতর পাহাড়ি শাকসবজি পাওয়ার বড় জায়গা বাসাবো। বাসাবোর এক পাশে অবস্থিত ঢাকার মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উপাসনালয় বৌদ্ধ মন্দির। রাজধানীর অন্য জায়গার তুলনায় এ অঞ্চলে আদিবাসীদের বাস তুলনামূলক বেশি। পাহাড়ি খাবার এবং শাকসবজির আধিক্যও তাই এখানে।
বাসাবো বৌদ্ধ মন্দির থেকে সামনে এগিয়ে গেলে হাতের বাম দিকে নজরে পড়ে 'পাহাড়ি বাজার' নামক শাক-সবজি, অর্গানিক পণ্য ও শুটকির একটি দোকান। এটি 'ফুলবারেং পাহাড়ি বাজার' নামেই এলাকায় বেশি পরিচিত। দোকানের স্বত্বাধিকারী রনাল চাকমা ২০১৫ সাল থেকেই ব্যবসা করে আসছেন বাসাবো অঞ্চলে।
রনালের মতে, পাহাড়ের খাবার এবং শাকসবজি টাটকা হওয়ায় মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। তাছাড়া মানুষের স্বাস্থ্য-সচেতনতা আগের থেকে বেড়েছে। যার দরুন শাকসবজির বিক্রিও বিগত নয়-দশ বছরে ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
ঢাকা শহরের মানুষ পাহাড়ের খাবার এবং শাকসবজি গ্রহণ করবেন কি না তা নিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা রনালের মনে শুরু থেকেই ছিল। তবে তা পালটাতে বেশি সময় লাগেনি। ২–৩ বছর পর থেকেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। বিগত কয়েকবছরে ফুলবারেং পাহাড়ি বাজারের ক্রেতা বেড়েছে কয়েকগুণ।
তিন লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করা রনালের ব্যবসায়ে এখন মাসিক টার্নওভার প্রায় ছয় লাখ টাকা। নয় বছর ধরে চলতে থাকা রনালের ব্যবসায়ের এখন আদিবাসী গ্রাহকের চেয়ে বাঙালি ক্রেতার সংখ্যা বেশি।
ভিন্ন স্বাদে সন্তুষ্ট ক্রেতা
সমতলে পাহাড়ি খাবার জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ হিসেবে জাহিদুল স্বাদের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। পাহাড়ের রান্নার পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় মানুষের পছন্দের তালিকায় এটি উঠে এসেছে বলে মনে করেন তিনি। তাছাড়া এ ধরনের খাবার ঢাকায় বহুল প্রচলিতও নয়।
সাধারণত ঢাকার ভেতর যে-সব জায়গায়, বিশেষত রেস্তোরাঁয় পাহাড়ি খাবার পাওয়া যায়, সেগুলোতে দামও কিছুটা তুলনামূলক বেশি। তাই পাহাড়ি খাবার কার্টের খাবারের দাম কিছুটা কম হওয়ায় মানুষ এখানে ভিড় জমান বলে ধারণা জাহিদুলের।
জাহিদুল-জনের দোকানে আসা অধিকাংশ মানুষই তাদের বাঁধা খরিদ্দার; জাহিদুলও হাসিমুখে সবার আগে ভাব বিনিময় করে তারপর খাবার পরিবেশন করেন।
এমনই একজন গ্রাহক দীপ্ত মুংডি খেতে এসেছেন। 'এখানকার মুংডিতে একটা পাহাড়ি স্বাদ আছে। খেয়ে বেশ মজা পেয়েছি। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এখানকার খাবার বাজেট-ফ্রেন্ডলি। বর্তমানে বাজারের যা অবস্থা, সেখানে ৫০ টাকায় পাহাড়ি খাবার পাওয়া অনেক বড় ব্যাপার,' বলেন তিনি।
ধোঁয়া ওঠা গরম গরম মুংডির স্যুপ খেতে খেতে মিরপুর থেকে আসা রায়হান জানান, তিনি পাহাড়ে অনেকবার গিয়েছেন। 'এখানকার খাবারে আমি পাহাড়ের ফ্লেভার খুঁজে পেয়েছি। এখন থেকে মাঝে মাঝেই আসব খেতে।'
তাজা শাকসবজি
রনাল চাকমা বলেন, 'এখন মানুষের অভ্যস্ততা বেড়েছে। মানুষ এটুকু বুঝতে পারছে যে, কোনো বীজ খেলে সেটা শরীরের জন্য ভালোই হয়। তাছাড়া সমতলের পণ্য থেকে পাহাড়ের জিনিসের স্বাদ ভালো এবং অর্গানিক হয়। কীটনাশক ব্যবহার হয় না, তাই এসবে স্বাস্থ্যঝুঁকিও কম।'
ঋতু অনুযায়ী বাহারি রকমের শাক-সবজি পাওয়া যায় ফুলবারেং পাহাড়ি বাজারে। এখানে মেলে বাঁশকোড়ল, ছোট বেগুন, পাহাড়ি ধানি মরিচ, শিম, পাহাড়ি আলু, কাঁচা তেঁতুলসহ বিভিন্ন সবজি। তাছাড়া শুটকির একটা বড় বাজারও এখানে আছে। ছুরি শুটকি, লইট্যা শুটকি, হাঙ্গর শুটকি, রূপচাঁদা, মলা-কাচকি, চিংড়ির শুটকির সন্ধান পাওয়া যাবে এখানে।
রনাল চাকমা ছাড়াও বাসাবো অঞ্চলে পাহাড়ি খাবার নিয়ে ব্যবসায় চালিয়ে যাচ্ছেন সোনালি চাকমা। কেমিক্যালমুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল নিয়ে বিগত ছয় বছর ধরে ব্যবসায় করছেন তিনি। তার প্রতিষ্ঠানের নাম জুম বাজার।
সোনালি বলেন, 'আমাদের পাহাড়ের শাকসবজিতে কোনো কীটনাশক দেওয়া হয় না। খেতে সুস্বাদু এবং টাটকা হয়। জুমের অর্গানিক শাক-সবজি, ফলমূল নিয়ে কাজ করি আমি।'
প্রতি শুক্রবার সকাল ছয়টা থেকে দোকান চালু করেন সোনালি। খাগড়াছড়ি, দীঘিনালা থেকে পণ্য নিয়ে আসেন তিনি। সোনালির দোকানেরও বেশিরভাগ গ্রাহক বাঙালি।
জুম বাজার-এর বেগুন, কলা, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, মিষ্টি আলু, হাইস্যা এগুলো বাঙালিদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। তাছাড়া আগাজা ফুল, শিমুল ফুল, লাল বিন্নি চাল, কালোজিরা চালও পাওয়া যায় এখানে। সবগুলোর দাম সাধ্যের মধ্যেই।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি খাবারের জনপ্রিয়তা বাড়ছে সমতলে। বিক্রেতাদের মত, খাবার স্বাস্থ্যকর হওয়ার কারণেই চাহিদা বাড়ছে সমতলে। শখের বশে তো বটেই, ভেজালমুক্ত তাজা শাকসবজি হওয়ায় মানুষের কাছে কদর বাড়ছে এসব খাবারের।