ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের ছন্দু হোটেল ট্রাক ড্রাইভারদের কাছে কেন প্রিয়!
ঘড়ির কাটায় বাজে রাত ৩টা। ট্রাক চালক সোলাইমান মিয়া আর তার সহকারী হান্নান সরকার খেতে বসেছেন। ওয়েটার সামনে দিয়ে গেল ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, গরুর মাংস, আর আলু ভর্তা। সাথে আছে সরিষার তেল দিয়ে মাখানো সালাদ।
"৩০ বছর ধরে এই রুটে ট্রাক চালাই। একদম প্রথম থেকেই ছন্দু হোটেলে ব্রেক দেই। এখানেই রাতের খানা সারি। এখানে গরুর মাংস আর আলু ভর্তার যেই স্বাদ- তা আর কোনো জায়গায় পাই নাই। দামও হাতের নাগালে। পেট ভরে খেয়ে, রেস্ট নিয়ে আবার গাড়ি চালাই," বলছিলেন সোলাইমান মিয়া।
তাদের সাথে বসে কথা হয় ছন্দু হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডের বিখ্যাত ছন্দু হোটেল। ঢাকা–চট্টগ্রাম রুটে নিয়মিত যারা যাতায়াত করেন, তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যারা ছন্দু হোটেলের নাম শোনেনি। প্রথম দিকে পরিবহন শ্রমিকদের খাওয়ার পছন্দের জায়গা ছিল ছন্দু হোটেল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছে হোটেলটি।
যেভাবে শুরু
১৯৮৪ সালে কুমিল্লার পদুয়ার বাজার বিশ্বরোডে ক্ষুদ্র পরিসরে চালু হয় ছন্দু হোটেল। আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ছন্দু মিয়া এর প্রতিষ্ঠাতা। এর আগে, শহরের ভেতরে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের বিপরীতে ইকবাল হোটেল নামে একটি হোটেল চালাতেন ছন্দু মিয়া। পরে ১৯৮৪ সালের দিকে হাইওয়েতে হোটেল নিয়ে যান। ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত খুব একটা ভালো চলতো না তাদের হোটেল। কারণ তখন ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ চলছিল। ১৯৮৬ সালের দিকে তাদের মূল ব্যবসা শুরু হয়।
ছন্দু হোটেলের বর্তমান মালিক ছন্দু মিয়ার ছেলে তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, "১৯৮৬ সালের দিকে আমাদের হোটেল শুরু হয় মাত্র তিনটা টেবিল দিয়ে। তিন টেবিলে ছয় জন করে মোট ১৮ জন বসতে পারতো। মেনু ছিল গরুর মাংস, আলুর ভর্তা, ডাল আর ভাত। এই আইটেমগুলার প্যাকেজ ছিল মাত্র ৭ টাকা করে। বছর যেতে যেতে ১০ টাকা করে দাম বাড়াই আমরা। এখন ১৮০ টাকায় গরুর হাফ প্লেট মাংস বেচি।"
ছন্দু হোটেল এই ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের প্রথম খাবার দোকান। এর আগে, যারা এই রুটে যাতায়াত করতেন, সবাইকে অনেক কষ্ট করে যাওয়া লাগতো। ছন্দু হোটেলের পর চালু হয় হাইওয়ে ইন। আর আলেখারচরে বিরতি রেস্টুরেন্ট নামেও আরেকটা খাবার হোটেল চালু হয়।
২০০৭ সাল পর্যন্ত মোটামোটি ছোট পরিসরেই ছিল ছন্দু হোটেল। ২০০৭ সালে পদুয়ার বাজারে বড় করে ছন্দু হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট চালু হয়। যার ফলে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ছন্দু হোটেলে খাওয়া সহজ হয়ে ওঠে। বর্তমানে ছন্দু হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ৫টি শাখা রয়েছে।
স্বাদ নাকি ব্র্যান্ড?
৩০ বছরেরও বেশি সময় পার হয়েছে ছন্দু হোটলের। সারাদেশের মহাসড়কের রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে মায়ামী, নূরজাহান, জমজমের মতো বড় বড় রেস্টুরেন্ট চালু হলেও, ছন্দুর জৌলুস একটুও কমেনি। ছন্দু নামটাই যেন একটি ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছন্দু হোটেলের জনপ্রিয়তার পেছনে কোনটা বেশি সাহায্য করেছে— নাম নাকি স্বাদ? প্রশ্ন করলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, "আমাদের বাবার নাম একটা ব্র্যান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস যদি খাবার ভালো না হতো, শুধু নাম দিয়ে আমরা এতদিন ধরে ব্যবসা চালাতে পারতাম না। আমাদের খাবারের স্বাদকেই আমি জনপ্রিয়তার ক্রেডিট দেব। আর আমরা অন্যান্য হাইওয়ে রেস্টুরেন্টের মতো খাবারের দাম বেশি রাখি না। আপনি যেকোনো হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে যান; দেখবেন সব খাবারের দাম দ্বিগুণ। গরু হাফ প্লেট ৩০০ টাকা রাখে। আর আমরা ১৮০ টাকা রাখি। ভর্তা, পরোটা, ভাত— সবই ১০ টাকা করে রাখি।"
ছন্দু হোটেলে প্রতিদিন প্রায় ৬০ কেজি মাংস রান্না হয়। গরুর মাংস যেহেতু তাদের স্পেশাল আইটেম, তাই এটি রান্না হয় বিশেষ উপায়ে। রান্নায় ব্যবহৃত সব মসলা নিজেরা তৈরি করেন তারা। বিশেষ কিছু গোপন মসলাও ব্যবহার করা হয়। প্রতি মণ মাংসে আট কেজি করে পেঁয়াজ দেওয়া হয়। ৬০ কেজি মাংসে দেওয়া হয় ১২ কেজি পেঁয়াজ। এছাড়াও দেওয়া হয় টক দই পোস্ত বাটা ও বিভিন্ন ধরনের বাদাম বাটা। মাংস রান্নায় একটুও পানি দেওয়া হয় না। মাংস থেকে যে পানি বের হয়, তা দিয়েই হয় রান্না। রান্না শেষে মাংসের ওপর থেকে কিছু পরিমাণে তেল আলাদা করা হয়। সেই মাংসের তেলেই পেঁয়াজ ভেজে দেওয়া হয় তেল বাগাড়। অত্যন্ত যত্নের সাথে গরুর মাংস রান্নার সব কাজ করা হয়। যার ফলে স্বাদ হয় একদম ঘরোয়া রান্নার মতো।
চুক্তির মারপ্যাঁচ
হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলো মূলত চলে বিভিন্ন বাসের সাথে চুক্তি করে। ঢাকা–চট্টগ্রাম রুটে আছে অসংখ্য কোম্পানির বাস। রেস্টুরেন্টগুলো বাস কোম্পানির সাথে এভাবে চুক্তি করে যে, বাসের যাত্রাবিরতিতে তারা নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে দাঁড়াবে। এতে করে রেস্টুরেন্টও বেশি ক্রেতা পায়, বাস কোম্পানিও লাভবান হয়।
আর হাইওয়ের রেস্টুরেন্টগুলো এমনভাবে বানানো হয়, যেন একটি থেকে আরেকটির দূরত্ব বেশি থাকে। ফলে বাসের যাত্রীরা নিজেদের পছন্দমতো রেস্টুরেন্ট বাছাই করে খেতে পারে না। বাস যেখানে থামবে, সেখানেই খেতে বাধ্য সব যাত্রী।
হাইওয়ের সকল রেস্টুরেন্ট এভাবে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। নিয়মিত ও বাধ্যতামূলকভাবে বছরের ১২ মাস তারা ক্রেতা পায়। তাই তারা লাগামহীনভাবে পণ্যের দাম হাঁকায়। সাধারণ এক প্লেট ভাতের দাম যেখানে অন্যান্য জায়গায় ১০ থেকে ২০ টাকা— সেখানে হাইওয়ে রেস্টুরেন্টে দাম রাখে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এছাড়াও প্যাকেটজাত পণ্য, যেমন— চিপস, চকলেট, জুস ইত্যাদির দামও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের চেয়ে ৫ থেকে ১০ টাকা করে বেশি রাখে। এ ব্যপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ কখনোই দেখা যায়নি।
কিন্তু ছন্দু হোটেল এ দিক দিয়ে ব্যতিক্রম। তারা কখনোই কোনো বাস কোম্পানির সাথে চুক্তি করেনি। ছন্দু হোটেলের মূল ব্যবসাটা হয় বিশ্বস্ত ক্রেতাদের দিয়ে। যারা একবার এখানে এসে খান, তারা বারবার আসেন। আর তাদের এমন অনেক ক্রেতা আছে, যারা বছরের পর বছর ধরে এখানে এসে খান।
"আমরা কোনোদিন কারো সাথে চুক্তিতে যাই নাই, যাবোও না। চুক্তিতে গেলে হয়তো আমাদের কাস্টমার তিন গুণ হতো, আর লাভ হতো ছয়গুণ। কিন্তু আমাদের বাপ এই ব্যবসা দিয়ে যায় নাই আমাদেরকে। মানুষকে ভালো খাবার খাওয়াতে বলছে সবসময়। দাম যেন সবার হাতের নাগালে থাকে আমরা এভাবেই দাম ঠিক করি। আমাদের এখানে একবার খেলে আপনি আবার আসবেন, এটা আমরা নিশ্চিত। আর হোটেলের আশেপাশে যারা থাকেন, লোকাল মানুষ– তারা নিয়মিত এখান থেকে খাবার নেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও আমরা খাবার সাপ্লাই দেই। কারণ আমাদের খাবারের দাম ও মান সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে", বলছিলেন তোফায়েল আহমেদ।
পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন
ছন্দু হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট তাদের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে একবার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর হোটেলের নোংরা পরিবেশের জন্য তাদেরকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ভোক্তা অধিকার থেকে এ জরিমানা করা হয়েছিল।
এ ব্যপারে প্রশ্ন করলে তোফায়েল আহমেদ বলেন, "আমাদের রান্নায় যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয়, তার সবই আমরা নিজেরা বানাই। যেমন- টক দই। এটা আমরা নিজেরাই বানাই। তো নিজেদের বানানো দইয়ে তো আর উৎপাদন আর মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ দেই না আমরা। ভোক্তা অধিকারের লোকরা এসে ফ্রিজে সেই দই দেখে আমাদের জরিমানা করে বসে!"
তিনি আরও বলেন, "অন্য যেকোনো রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের কিচেনের পরিবেশ বেশি পরিষ্কার। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, রেস্টুরেন্টের কিচেনের ওপরে বড় করে লেখা থাকে 'ভিতরে প্রবেশ নিষেধ'। কিন্তু আমাদের ওপেন কিচেন। আপনি কেন, যে কেউ চাইলে রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করাসহ যেকোনো কিছু নিজের চোখে দেখে বিচার করতে পারবেন।"
কিচেনে ঢুকে দেখা গেল, যা বলেছেন খুব একটা ভুল বলেননি। ঝকঝকে টাইলসের ফ্লোর। রান্না চলছে পুরোদমে। প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি পেঁয়াজ লাগে ছন্দু হোটেলের একেকটি ব্রাঞ্চে। পেঁয়াজ কাটার জন্য তারা বানিয়েছেন স্বয়ংক্রিয় এক মেশিন। পেঁয়াজ ছিলে মেশিনে দিলেই কুচি হয়ে বেরিয়ে আসে। এতে করে যেমন সময় বাঁচে, তেমনি থাকে পরিচ্ছন্নতা।
বর্তমান অবস্থা থেকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ছন্দু হোটেলের বর্তমানে পাঁচটি শাখা আছে। পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড, টমসম ব্রিজ, ক্যান্টনমেন্ট, লাকসাম রোড ও চট্টগ্রাম রোডে শাখাগুলো অবস্থিত। চট্টগ্রাম রোডের শাখাটির নাম আগে ছিল ছন্দু– ২ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। বর্তমানে এর নাম বিন রাজ্জাক হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। হোটেলের প্রথম মালিক ছন্দু মিয়ার ভালো নাম ছিল আব্দুর রাজ্জাক। তার নামেই চট্টগ্রাম রোডের শাখাটির নতুন নামকরণ করা হয়।
ছন্দু হোটেলের যে প্রথম শাখা পদুয়ার বাজারে, তার সামনে ফ্লাইওভার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে সেই শাখায় ব্যবসায় একটু ভাটা পড়েছিল। এখন সেই শাখার সামনে ফ্লাইওভার তৈরি হয়ে যাওয়ার ফলে সরাসরি বাস, গাড়ি বা ট্রাক দাঁড়াতে পারে না, ঘুরে আসতে হয়। এর সমাধান করার জন্যই চট্টগ্রাম রোডে ছন্দু- ২ খোলা হয়েছিল ২০১৩ সালের দিকে।
ছন্দু হোটেলের বাকি সব শাখা গত দুই বছরের মধ্যে খোলা হয়েছে। সব জায়গায়ই তাদের নিজস্ব গুণগত মান বজায় রাখার চেষ্টা করছে তারা। তাদের রেস্টুরেন্টে শুধু গরুর মাংস আর আলুর ভর্তাই নয়, অন্যান্য সব আইটেমই পাওয়া যায়। সুস্বাদু সেসব আইটেমের দামও হাতের নাগালে। প্রতি বেলায়ই পাওয়া যায় প্রায় পাঁচ- ছয় পদের মাছ, ছোট মাছ, নানান আইটেমের ভর্তা–ভাজি ও ডেজার্ট।
তোফায়েল আহমেদ জানান, "ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন মানুষকে পার্টনার হিসেবে নিয়ে আমি কয়েকটা শাখা খুলেছি। সবগুলাতেই আমার নিয়ন্ত্রণ আছে। রান্না থেকে শুরু করে পরিবেশনা— সবই আমার নির্দেশনাতেই করা হয়। যার ফলে ছন্দুর খাঁটি কোয়ালিটি সব জায়গাতেই কাস্টমাররা পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।"
সামনে আর কোনো শাখা খোলার পরিকল্পনা নেই ছন্দু হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টের। পাঁচটি শাখাকেই তারা আরো উন্নত ও আরো আধুনিক করতে চান। দেশের হাইওয়ে রেস্টুরেন্টগুলো তাদের মতো যাত্রীদের জন্য সুবিধাজনক হয়ে উঠবে, এটিই চান তারা। হাইওয়ের সকল রেস্টুরেন্টের রোল মডের হয়ে উঠতে চায় ছন্দু হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট।