৮ ব্যাংক থেকে ৫০ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে
একই জমি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখে ৫০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার দায়ে অন্তত ২০টি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী হাসানুর রশিদ রিপন।
ব্যবসা ও আমদানির নামে নেওয়া এসব ঋণ এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো অভিযোগ করেছে, কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ঋণ পরিশোধ করা হয়নি।
হাসানুরের আর্থিক লেনদেন নিয়ে তদন্ত করার পরে ব্যাংকগুলো তার এ জালিয়াতির কথা টের পায়। অভিযোগ ওঠে, তিনি এসব ঋণ নেওয়ার জন্যে একই জমি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছেন। আসল ও সুদ মিলিয়ে এ অর্থের পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি টাকার বেশি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাসানুর একটি জমি অন্তত ৪টি ব্যাংকের কাছে এবং আরেকটি জমি ৩টি ব্যাংকে বন্ধক রেখেছেন।
ঋণের টাকা সমন্বয় করতে এখন এক ব্যাংক ওই জমি বিক্রি করতে গেলে আরেক ব্যাংক এসে আপত্তি তুলছে।
ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ ছাড়া এভাবে একই জমি বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ পাওয়া সহজ নয়।
এক জমি একাধিক ব্যাংকের কাছে বন্ধক
২০১৫ সালে পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১৫ কোটি টাকা ঋণ নেন মেসার্স বেঙ্গল ট্রেডিংসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হাসানুর রশিদ রিপন। এ ঋণের বিপরীতে চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন মোড় এলাকার (বায়েজিদ মৌজা) ৩৬ শতক এবং সীতাকুণ্ড এলাকার (উত্তর সলিমপুর মৌজা) ১৯ শতক জমি বন্ধক রাখেন তিনি।
পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের শর্ত থাকলেও হাসানুর শোধ করেননি এক টাকাও। সুদ-আসল মিলিয়ে পদ্মা ব্যাংকের তার কাছে পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
এ টাকা উদ্ধারে ২০১৮ সালে চেক ডিজঅনার ও ২০২০ সালে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে পদ্মা ব্যাংক।
হাসানুরের বন্ধকি সম্পত্তি নিলাম করতে গেলে আইএফআইসি ব্যাংক সীতাকুণ্ডের ওই ১৯ শতক জমি আগে থেকেই তাদের কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে উল্লেখ করে আপত্তি উত্থাপন করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাসানুর এ জমিটি পদ্মা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখার কয়েক মাস আগে আইএফআইসি ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকের কাছে বন্ধক রেখেছিলেন। এছাড়াও, হাসানুর তার স্ত্রী সৈয়দ ফাতেমা নার্গিসকে ২০১২ সালের মে মাসে একই জমি উপহার দিয়েছিলেন। এমনকি চার মাসের মধ্যে স্ত্রীর নামে নামজারি খতিয়ানও তৈরি করে নেন তিনি।
পদ্মা ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী শফিউল আজম বলেন, 'এ ঋণগ্রহীতা [হাসানুর] ব্যাংকের বিরুদ্ধে আর্থিক জালিয়াতি করেছে। ফলে আমরা অর্থঋণ ও চেকের মামলার পাশাপাশি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছি।'
অন্য ব্যাংকের সঙ্গেও প্রতারণা
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হাসানুর ঢাকা ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখা থেকে জামানত হিসাবে সীতাকুণ্ডের ১৯ শতক জমি ব্যবহার করে এক কোটি টাকা ধার নেন। সুদাসলে এখন এ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই কোটি ৬১ লাখ টাকায়।
ঢাকা ব্যাংকের নিউমার্কেট শাখার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ম্যানেজার মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, হাসানুর ২০১৬ সালে ঋণ নবায়ন করেন। কিন্তু বন্ধককৃত সম্পত্তির জন্য খাজনার দাখিলা চাইলে তা দিতে গড়িমসি শুরু করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় ভূমি অফিসে ঢাকা ব্যাংক তদন্ত করে জানতে পারে, ২০১৫ সালে ঢাকা ব্যাংকে বন্ধক রাখার তিন বছর আগে ২০১২ সালে জমিটি স্ত্রীকে হেবা করে দেন হাসানুর।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, ওই একই জমি আগে-পরে আরও কয়েকটি ব্যাংকে বন্ধক রেখে ঋণ নিয়েছেন হাসানুর।
এ খেলাপির বিরুদ্ধে অর্থঋণ ও চেক ডিজঅনারসহ প্রতারণার অভিযোগে ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে ঢাকা ব্যাংক।
অর্থঋণ আদালত ও ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮ সালে আইএফআইসি ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নেয় কোয়ালিটি প্রোডাক্টস। ঋণের বেনিফিশিয়ারি, গ্যারান্টার ও মর্টগেজর হাসানুর রশিদ হলেও প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বধিকারী হিসেবে নাম আছে তার মামা শামসুল আলমের।
ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা হয়েছে হাসানুরের উত্তর সলিমপুর এলাকার সেই ১৯ শতক ও বায়েজিদ এলাকার ১৮ শতক জমি।
১৫ বছরেরও বেশি সময়ে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির পাওনা দাাঁড়িয়েছে নয় কোটি টাকার বেশি। ঋণ শোধ না করায় হাসানুরের বিরুদ্ধে বন্ধক রাখা সম্পত্তি স্ত্রীকে হেবা করা এবং অন্যান্য ব্যাংকে বন্ধক দেওয়ায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে ব্যাংকটি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আইএফআইসি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের দায়ের করা প্রতারণার মামলায় গত ১৩ এপ্রিল হাসানুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ১৫ মে অন্তবর্তী জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে যান তিনি।'
টিবিএস-এর তদন্তে আরও জানা গেছে, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ওয়াসা শাখা থেকে ২০১৫ সালে এক কোটি ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নেয় হাসানুর রশিদের বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ। ওই ঋণ পেতেও বন্ধক রাখা হয় সীতাকুণ্ডের সলিমপুরের সেই ১৯ শতক জমি।
ঋণের টাকা ফেরত না পেয়ে হাসানুরের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে অর্থঋণ মামলা দায়ের করে শাহজালাল ব্যাংকও। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকটির বর্তমান পাওনা সাড়ে তিন কোটি টাকা।
তিন ব্যাংকে বন্ধক আরেক জমি
জমি বন্ধক নিয়ে হাসানুরের প্রতারণা শুধু সলিমপুরের সেই জমিতেই সীমাবদ্ধ নয়, অক্সিজেন মোড়ের ৩৬ শতকের আরেকটি জমি নিয়েও একই প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পদ্মা ব্যাংকে বন্ধক রাখা অক্সিজেন মোড়ের ৩৬ শতক জমির মধ্যে আগে থেকেই ১৮ শতক আইএফআইসিতে এবং ১৮ শতক ইসলামী ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণের টাকা বের করে নিয়েছিলেন হাসানুর।
ইসলামী ব্যাংকের দেওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১২ সালে জুবলী রোড শাখা থেকে জিআই [গ্যালভানাইজড লোহা] পাইপ ও সুতা আমদানির জন্য হাসানুরের মালিকানাধীন হাসান এন্টারপ্রাইজ ঋণ নেয়। এক বছরের মধ্যে এ ঋণ পরিশোধের কথা থাকলেও এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শোধ করা হয়নি।
হাসানুরের কাছে ইসলামী ব্যাংকের এখন পাওয়া চার কোটি ১৪ লাখ টাকা। ঋণ আদায়ে হাসানুরের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অর্থঋণ ও চেক ডিজঅনার মামলা করেছে ইসলামী ব্যাংক।
এ মামলা পরিচালনা করতে গিয়েই ইসলামী ব্যাংক জানতে পারে, তাদের কাঝে বন্ধক রাখা অক্সিজেন মোড়ের ওই ১৮ শতক জমি পরে পদ্মা ব্যাংকেও বন্ধক দিয়েছেন হাসানুর। এ ঘটনায় ইসলামী ব্যাংক পরে একটি ফৌজদারি মামলা দায়ের করেছে।
২০১৫ সালে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের নাসিরাবাদ শাখা থেকে ঋণ নেয় হাসানুর রশিদের বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ। এ ঋণ আদায়ে অর্থঋণ ও এনআই [নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস] অ্যাক্টে মামলা দায়েরে করেছে ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির কাছে সাউথ বাংলার বর্তমান পাওনা চার কোটি ৬২ লাখ টাকা।
হাসানুরের সর্বশেষ 'শিকার' এক্সিম ব্যাংক দোহাজারী শাখা। ২০১৬ সালে নগরীর শুলকবহর এলাকার চারতলা বাড়ি বন্ধক দিয়ে ব্যাংকটির দোহাজারী শাখা থেকে ঋণ নেয় হাসানুরের বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ।
তবে ব্যাংকে বন্ধক রাখার আগে সেই বাড়ি স্ত্রীকে হেবা করে দেওয়ার তথ্য এসেছে ব্যাংকের কাছে। হাসানুরের কাছে এখন ব্যাংকটির পাওনা দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৬০ লাখ টাকা, যা উদ্ধারে ইতোমধ্যে অর্থঋণ ও এনআই অ্যাক্টে মামলা করা হয়েছে।
এছাড়া, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা বেঙ্গল এন্টারপ্রাইজ থেকে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ মামলা করেছে।
আদালত ও ব্যাংকের তথ্যমতে, হাসানুর রশিদের বিরুদ্ধে ঋণ খেলাপি, চেক ডিজনার ও প্রতারণার অভিযোগে আট ব্যাংকের কমপক্ষে ২০টি মামলা চলমান আছে। এসব মামলায় হাসানুর রশিদের স্ত্রী সৈয়দা ফাতেমা নার্গিসকেও বিবাদি করা হয়েছে।
নেই কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবসা
ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ট্রেডিং ও পণ্য আমদানির নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও হাসানুর রশিদের উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবসা ছিল না।
মাঝখানে কিছুদিন নগরীর চাক্তাই এলাকায় সুতার কারখানা গড়ে ব্যবসা করেন তিনি। ২০১৪–১৫ সালে তুরস্ক থেকে কিছু ঘি ও সানফ্লাওয়ার অয়েল আমদানি করেন।
তবে অভিজ্ঞতা ছাড়াই হঠাৎ ঘি ও সানফ্লাওয়ার অয়েল আমদানিতে লোকসান গুনতে হয় তাকে। এতে অর্থসংকটে পড়ে বন্ধ হয়ে যায় সুতার কারখানাও।
প্রতারণার মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে হাসানুর রশিদের ব্যক্তিগত মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
তিনি এ প্রতিবেদককে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য বিভিন্ন তারিখের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পরে আর কথা বলেননি।
ব্যাংকের তথ্যে তার যে ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে, সেখানে তার সঙ্গে যুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া যায়নি।