আওয়ামী লীগের পতনে দুদকেও হাওয়া বদল; রাঘব-বোয়ালে চোখ
গত ১৫ বছর ধরেই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী আমলাদের দুর্নীতি নিয়ে নীরব ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ছোট দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত 'চুনোপুঁটি' নিয়ে ব্যস্ত ছিল স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বশাসিত সংস্থাটি।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রভাবশালীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানটি।
গত কয়েক সপ্তাহে ৭১ জন মন্ত্রী-এমপিসহ অন্তত ৮২ জন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্যসহ আরও অন্তত দুই শতাধিক মানুষের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে।
পর্যায়ক্রমে এ তালিকা আরও দীর্ঘ হবে বলে জানিয়েছেন দুদক কর্মকর্তারা।
সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে 'ওপরের সিগন্যালের' অপেক্ষায় থাকতে হতো দুদককে।
এছাড়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বাধীন ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যর্থতা, সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করা, অভিযোগে প্রভাবশালীর নাম থাকলেও মুখ দেখে ছেড়ে দেওয়া, দুর্নীতি করেও বড় বড় আমলাকে ছাড় দেওয়া, প্রশাসনের বড়কর্তাদের অলিখিত দায়মুক্তিসহ নানা অভিযোগ ছিল কমিশনের বিরুদ্ধে।
দুদকসূত্রে জানা যায়, ১৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ৩৫ জন সাবেক মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সাবেক এ মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন আসাদুজ্জামান খান কামাল, আ হ ম মুস্তফা কামাল, শাহজাহান খান, জিল্লুল হাকিম, টিপু মুনশি, নসরুল হামিদ বিপু, আনিসুল হক, দীপু মনি, তাজুল ইসলাম, জুনাইদ আহমেদ পলক, জাহিদ মালেক, মহিবুল হাসান চৌধুরী, হাসানুল হক ইনু এবং হাছান মাহমুদ।
এছাড়া অনুসন্ধানের তালিকায় রয়েছেন অন্তত ৩৮ জন সাবেক সংসদ সদস্য। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন অসীম কুমার উকিল, সাইফুজ্জামান শেখর, ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু, কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, শেখ আফিল উদ্দিন, কাজী নাবিল আহমেদ, এনামুল হক, সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার এবং শাহ আলম তালুকদার।
এসব মন্ত্রী ও এমপিদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা বিদেশে পাচার, সোনা চোরাচালানসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যদের নামেও অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মইদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও দুদক এতদিন কাজ করেনি। ফাইলগুলো ফেলে রেখেছিল। স্বৈরাচার পতনের পর তারা এখন মামলা করছে।
'এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তারা এতদিন স্বৈরাচারী ব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এখন যেহেতু নিরপেক্ষ সরকার, তারা প্রভাব খাটাচ্ছে না।'
দুদকে অভিযোগ জমা পড়লে যাচাই-বাছাই কমিটি অনুসন্ধানের সুপারিশ করে থাকে। তবে প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে সংস্থাটি অনেকটাই পাশ কাটিয়ে যেত।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, গত বছর মোট ১৫ হাজার ৪৩৭টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৮৪৫টি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়। আর চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে পাঁচ হাজার ৩০০টি অভিযোগের মধ্যে মাত্র ৩৬৩টি অনুসন্ধানের জন্য গৃহীত হয়।
অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে হাজারের বেশি ছোট-বড় অভিযোগ জমা পড়লেও অনুসন্ধানের অনুমতি মিলে গড়ে ৫০-৬০টি, যার অধিকাংশই ছোট দুর্নীতি।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বড় দুর্নীতিগুলো অনুসন্ধানের জন্য প্রাধান্য পাচ্ছে।
দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'অভিযোগ অনেক আসে। কিন্তু যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে অনুসন্ধানের জন্য মাত্র ৪-৫ শতাংশ ফাইল পাঠানো হয়। তবে আগস্টে এসে অনুসন্ধানের হার অনেক বেড়েছে।
'দুদক স্বাধীন বলা হলেও ওপরেরর মহলের সিগন্যাল ছাড়া প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা যেত না। এজন্য এত মন্ত্রী-এমপি বা আমলারা দুর্নীতি করেও পার পেয়ে গেছেন।'
সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ অবশ্য হাসিনার পতনের আগে দুদকের তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে তাও একটি জাতীয় দৈনিকে তার অপ্রকাশিত সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুটি অংশের প্রতিবেদন ছাপানোর পর নড়েচড়ে বসেছিল দুদক। সংস্থাটি বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সম্পদের হদিস পেয়েছে।
এছাড়া ডিএমপির সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ সম্প্রতি দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় এসেছেন।
সাবেক ডিবি প্রধানের বিরুদ্ধে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় নামে-বেনামে অন্তত ১৮টি সম্পত্তির (জমি ও ভবন) মালিকানার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও কিশোরগঞ্জের আলোচিত 'প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট' নামক বিলাসবহুল প্রমোদাগারের মালিকানার অভিযোগও রয়েছে।
পাশাপাশি সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধেও বিপুল পরিমাণ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
অবৈধ সম্পদ, অর্থ পাচার ও ক্রয়-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও তার দুই ভাই হারিস আহমেদ, তোফায়েল আহমেদ জোসেফের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার এবং দেশে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগে এনএসআইয়ের সাবেক ডিজি টিএম জোবায়েরের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করছে দুদক।
মন্ত্রী, এমপি ও আমলাদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী তিন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা, ব্যবসায়ী ও সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে আর্থিক খাতে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির মাধ্যমে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম মাসুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান চলছে।
আর ব্যবসায়ী চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ও পদ্মা ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।
যদিও এ বিষয়ে সংস্থাটির সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, দুদক একটি নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আগে বা পরে বলে কিছু নয়, অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে সবকিছু নিয়ম মেনেই করা হয়। গোয়েন্দা অনুসন্ধান চলছিল তাদের বিষয়ে। এখন প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর আগেও ওয়ান-ইলেভেনের সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দুদক।
তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন সরকার দলীয়রা দুদকের তদন্ত থেকে রেহাই পান। যদিও বিরোধী দলীয় ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত ছিল।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডির (সিজিএস) চেয়ারম্যান মঞ্জুর এ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'আমরা সবসময় আশা করেছিলাম দুদক একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রায় ২২ হাজার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, কিন্তু ১৮ হাজার অভিযোগ বাতিল করা হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, '২০২৩ সালে ১৯৫টি মামলার মধ্যে মাত্র ২৫০ জন সরকারি দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এটা কীভাবে সম্ভব? ১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে এমন তথ্য দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ।'
ভবিষ্যতে দুদক কীভাবে এগোবে?
বিশ্লেষকরা এখন বলছেন, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে দুদক তার বর্তমান প্রবণতা এবং গতি বজায় রাখতে পারে কি না তা দেখার বিষয়।
মঞ্জুর এ চৌধুরী বলেন, দুর্নীতি প্রাথমিকভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা সংঘটিত হয়, যারা দুদকেও নিযুক্ত ছিলেন। 'দুদকের সংস্কার দরকার এবং আমলাদের পরিবর্তে সুশীল সমাজের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দুদক সেল স্থাপন করা উচিত,' বলেন তিনি।
'দুদকের বর্তমান পদ্ধতিতেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এ সরকার নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের টার্গেট করছে, এবং বিএনপি [যদি ক্ষমতায় আসে] সম্ভবত একই কাজ করবে। দুদক এখনও স্বাধীনভাবে কাজ করছে না,' বলেন তিনি।