মায়ের মনের শঙ্কাই সত্যি হলো! ফোনেই গুলির শব্দ পেলেন মা
সকাল থেকেই মায়ের মন ছটফট করছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে মায়ের অস্থিরতা আরো বাড়তে থাকে। জীবিকার টানে শহরে অবস্থান করা সন্তানের হঠাৎ অমঙ্গল চিন্তায় মায়ের মন আর মানছিল না। তাই ছেলেকে সাবধান করতে ফোন করেন গ্রামের বাড়িতে থাকা মা মোমেনা বেগম (৫৫)।
ফোন করেই বিচলিত মা জানতে চান, 'বাবা তুমি এখন কোথায়?' মায়ের কন্ঠে উদ্বেগ বুঝতে পেরে ছেলে মিথ্যে করে জানায়, 'মা আছি, বাসায় আছি, তুমি কোনো চিন্তা করো না।' মোমেনা বেগম ছেলের কথায় বিশ্বাস করে তাকে সতর্ক করে বলেন, 'বাবা আজ তুমি কোথাও বের হবা না, আমার মন কু ডাক ডাকে, তোমার বড় বিপদ হবে।'
'আমি কোথাও বের হবো না মা' ছেলের এমন মিথ্যা আশ্বাস ছিল মোমেনা বেগমের সাথে তার নাড়ি-ছেঁড়া ধন, বুকের মানিক জাকির হোসেনের শেষ কথা। ঠিক তখনই ফোনের অপর পাশে থাকা উদ্বিগ্ন মা গুলির শব্দ শুনতে পান। সেই গুলির শব্দ শুনে মায়ের বুক ধক্ করে ওঠে। মুহূর্তেই ফোনের অপর প্রাান্তের কণ্ঠ থেমে যায়। মা বুঝে ফেলেন সব। জাকিরও আর কোনো সাড়া দিতে পারেননি।
কথাগুলো বলছিলেন, গাজীপুর শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরের অজপাড়া গাঁয়ের সন্তানহারা মা মোমেন বেগম।
পরিবারের স্বজনেরা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গাজীপুর থেকে উত্তরায় বায়ারদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে গত (১৯ জুলাই) শুক্রবার বেলা আড়াইটার সময় রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় গুলিতে আহত হন মোমেনা বেগমের বড় ছেলে জাকির হোসেন (৩৬)। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১৪ ঘন্টা পর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
জাকির হোসেন গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের চরদুর্লভখা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মো: আব্দুস সামাদের বড় ছেলে।
এই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন জাকির। তাকে হারিয়ে পরিবারের সামনে এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যত। সন্তান হারিয়ে বাবা-মা পাগলপ্রায়। জাকিরের দুই ছেলে আব্দুর রহমান (৬) ও বায়েজিদ (২)। স্বামী হারিয়ে দুটি অবুঝ শিশু নিয়ে দিশেহারা জাকির হোসেনের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম (২৯)। এ পরিবারের শোকে আশপাশের মানুষও শোকাতুর হয়ে পড়েছে।
নিহত জাকির হোসেনের পিতা আব্দুস সামাদ (৬৫) জানান, বাড়ির ভিটাসহ মাত্র দেড় বিঘা জমি ও একমাত্র উপার্জনক্ষম জাকির হোসেনই সম্বল ছিল তাদের। অভাবের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে জাকির ছিল সবার বড়। জাকিরের উপার্জন দিয়েই টেনেটুনে চলছিল তার সংসার। পিতার কষ্ট লাঘব করতে এসএসসি পাশের পর আর লেখাপড়া করতে পারেনি জাকির। সংসারের বোঝা কাঁধে নিতে ২০০৩ সালে গাজীপুর সদরের ভাওয়াল মির্জাপুর এলাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরিশ্রম, সততা দিয়ে জাকির কয়েক বছর আগে সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান।
তিনি শোকাতুর অবস্থায় আরো জানান, ৬ মাস আগে জাকির এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে ছোট পরিসরে 'কাজী ভিআইপি গার্মেন্টস, নামে একটি পোশাক তৈরির কারখানা গড়ে তুলেন। গত শুক্রবার দুপুরে কারখানার জন্য গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকা থেকে জরুরি কিছু মালামাল কিনেন জাকির। পরে ফেরার পথে উত্তরা থেকে একজন বায়ার ফোন করে কিছু নমুনা দেখতে চাইলে– তিনি তার সাথে দেখা করতে উত্তরা রওয়ানা হন।
পথিমধ্যে রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর এলাকায় গিয়ে জাকির গাড়ি থেকে নেমে অন্য গাড়িতে উঠার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় তার মায়ের ফোন আসে। মায়ের সাথে ফোনে কথা বলার সময় সেখানে পুলিশ ও আন্দোলকারীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলাকালে দুটি গুলি এসে তার বুকে ও পেটে লাগলে জাকির মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
আশেপাশের মানুষ তাকে উদ্ধার করে উত্তরার বাংলাদেশ আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে আশঙ্কাজনক অবস্থা দেখে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। খবর পেয়ে স্বজনরা তাকে দ্রুত সেখানে নিয়ে গেলে– চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় ১৪ ঘণ্টা পর শনিবার ভোর চারটার সময় তার মৃত্যু হয়। পরে গত রোববার রাত দশটার সময় জানাযা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অল্পবয়সেই স্বামীকে হারানোর দুর্ভাগ্যে দিশেহারা স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম। ছেলেদের নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন, কীভাবে বাচ্চাদের বড় করে তুলবেন, ভবিষ্যৎ কী হবে– এসব চিন্তায় কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না তিনিও।জান্নাতুন নাঈম জানান, 'গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সকালের খাবার খেয়ে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যান উনি। সারাদিন অফিসে থাকবেন বলে জানিয়েছিলেন। সারাদিন আর তার সাথে কোনো যোগাযোগ হয়নি। বিকেল পাঁচটার দিকে ওঁর অফিসের কয়েকজন লোক বাসায় আসেন। তাদের কাছে তার কথা জিজ্ঞাসা করলে তারা প্রথমে কোনো জবাব দেননি। পরে তারা জানান, আমার স্বামী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।' খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে গেলেও স্বামীকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। এখন ছয় বছর ও দুই বছর বয়সী দুটি ছেলেকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাবেন তার কোনো কূলকিনারা ভেবে পাচ্ছেন না।
ওই কারখানার কর্মকর্তা কামরুল জানান, জাকির গার্মেন্টস কারখানার কাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। একসময় তিনি এসব কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। নিজের ছোট কারখানার প্রয়োজনে উত্তরায় গিয়ে জীবন দিতে হলো জাকিরকে।
কাজী ভিআইপি গার্মেন্টসের কর্মী কামরুল ইসলাম বলেন, জাকির গত শুক্রবার কারখানার জন্য ফেব্রিক্স কিনতে কোনাবাড়ী গিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর ঢাকার একজন বায়ার তাকে ফোন করে পূর্বের অর্ডারের কিছু মালামাল ডেলিভারি নিতে চান। মালামাল ডেলিভারি করতে তিনি কোনাবাড়ী থেকে উত্তরার দিকে রওনা হন। আব্দুল্লাহপুর প্রবেশ করতেই তার পিঠে গুলি লাগে। এতে জাকির মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে পথচারীরা তাকে প্রথমে কাছের একটি হাসপাতালে ও পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন তার অবস্থার অবনতি ঘটে। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে তাকে শুক্রবার রাত ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে সেখানে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শনিবার দিবাগত রাত দুইটায় তাকে অস্ত্রোপাচারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। অস্ত্রোপাচার চলা অবস্থায় রোববার ভোর চারটার দিকে তার মৃত্যু হয়।
গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম লুৎফর রহমান বলেন, 'গাজীপুর থেকে উত্তরা বায়ারদের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে সময় জাকির হোসেন গুলিতে আহত হয়ে মারা যাওয়ার কথা শুনেছি। তার গ্রামের বাড়ীতে লাশ দাফন করা হয়েছে। সরকারী অনুদান দেয়ার বিষয়ে কোন নির্দেশনা পেলে ভবিষ্যতে ব্যবস্থা নেয়া হবে।'