রাজনীতিতে সর্বনাশা ‘আমিত্ব’
"কোনো একজন ব্যক্তি দ্বারা কোনো একটি দেশ বা জাতি তৈরি হয়নি। আমরা যদি সত্যিই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় বাঁচতে চাই, তাহলে এই আমিত্বর আসক্তি এবং আত্মঘাতী উচ্চাভিলাষ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। এই আমিত্ব (আই-নেস) হলো কেবল এক ব্যক্তি বা একজন মানুষ সবকিছুই করতে পারেন এমন ভাবনা।"
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা ২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায়ে উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন।
মোট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের এ পর্যবেক্ষণের অংশে প্রধান বিচারপতি সরকারের ঔদ্ধত্য, লাগামহীন দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।
সিনহার এ পর্যবেক্ষণ পছন্দ হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, যিনি কিনা বরাবরই নিজ ও নিজের পরিবার ব্যতীত দেশের উন্নয়নে অন্যদের অবদান অস্বীকার করে এসেছেন। দেশ ও দশের জন্য যা কিছু ভালো করা হয়েছে, তার সবকিছুই করেছেন 'তিনি' ও তার 'দল'—এমনটাই দাবি করতেন তিনি (শেখ হাসিনা)।
আগস্টে রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের পরপরই বিচারপতি সিনহা হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়েন। পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরাও।
অবশেষে, ২০১৭ সালের নভেম্বরে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।
পদত্যাগ করার পর এক বিবৃতিতে বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের অনুলিপি বঙ্গভবনে আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের কাছে হস্তান্তর করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সিনহা-ই প্রথম অমুসলিম ও আদিবাসী প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনার 'আমিত্ব' মনোভাব এবং শাসন সম্পর্কে সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ করে তিনি ক্ষমতার কৃপা থেকে বঞ্চিত হন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ও অন্যান্য বিরোধী দলের বর্জনের মধ্যে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একতরফা ও সুসংগঠিত সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস পরই শেখ হাসিনা সরকার, সংবিধান লঙ্ঘন কিংবা অসদাচরণের অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে তুলে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করে— যে ক্ষমতা এর আগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত ছিল।
ষোড়শ সংশোধনীতে বলা হয় বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে থাকবে।
তবে ২০১৪ সালের নভেম্বরেই এ সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। ২০১৬ সালে তিন সদস্যবিশিষ্ট হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করে রায় দেয়।
সরকার আপিল বিভাগে আপিল করলেও আইনি লড়াইয়ে হেরে যায়। সংসদ সদস্য ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা সংশোধনী বাতিলের জন্য সর্বোচ্চ আদালতের সমালোচনা শুরু করেন তখন।
'আই-নেস', 'আই অ্যালোন'
২০১৭ সালের ১ আগস্ট আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রকাশ করেন।
রায়ে বিচারপতি সিনহা লিখেন, 'আমরা যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নগর–পরিকল্পনার দিকে তাকাই, তাহলে দেখি যেই ব্যক্তি তাদের নগরের পরিকল্পনা করেছেন, তাকেই তারা স্বীকৃতি দিয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্তির জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী মেরি টড। নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আরও অনেকে আছেন যারা এই স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং তারা চার সেনা জেনারেলকে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন।
কিন্তু আমাদের দেশে একটি রোগ আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। আর সেই রোগের নাম 'মায়োপিক পলিটিকাইজেশন' বা 'অদূরদর্শী রাজনৈতিকীকরণ'। এটা একটা ভাইরাস এবং দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংস্কৃতিকে তা এমন বিস্তৃতভাবে সংক্রমিত করেছে যে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা এমন একটি ভবিষ্যৎ দেখতে বা কল্পনা করতেও পারছেন না যে ভবিষ্যতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পুরো জাতি, কোনো একজন ব্যক্তি নন।
এই বাজে রোগের কারণে নীতিনির্ধারকেরা সবকিছু ব্যক্তিকরণ করে ফেলেছেন। তারা তাদের ক্ষুদ্র এবং সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে একটি ভুয়া ও 'মেকি গণতন্ত্র' প্রতিষ্ঠা করেছেন। আর এটা তারা লজ্জাজনকভাবে আমাদের সংবিধানের অন্যায্য সুবিধা নিয়ে করেছেন, অথচ ১৯৭১ সালে আমাদের শহীদেরা রক্ত দিয়ে এ সংবিধান লিখেছিলেন।
আমাদের অবশ্যই এই নোংরা 'আমাদের লোক' মতবাদ পরিহার করতে হবে। পরিত্যাগ করতে হবে এই আত্মঘাতী 'আমি একাই সব' দৃষ্টিভঙ্গি। দলীয় আনুগত্য বা অর্থবিত্ত নয়, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠান তৈরিতে শুধু মেধার বিবেচনাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য যিনি অসাধারণ ত্যাগ ও অসামান্য অবদান রাখছেন, তাকে অবশ্যই স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের উচিত তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা পক্ষপাতিত্বের পরিবর্তে সমাজে তাদের অবদানের দিকে মনোনিবেশ করা।
আমরা যদি এই সংকীর্ণ সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারি এবং দলীয় স্বজনপ্রীতির লোভ কাটিয়ে উঠতে না পারি, তবে এটি হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত। স্বাধীনতার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ করা 'আমরা'র ধারণাটি মৌলিক এবং এটিকে সম্মান জানাতে আমাদের সংবিধানের প্রথম শব্দ 'আমরা' শব্দটি।
হাসিনা সরকারের সমালোচনা সুপ্রিম কোর্টের
রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহা দেশের শাসন ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা নিয়ে কিছু সমালোচনামূলক পর্যবেক্ষণ করেছেন।
তিনি বলেন, 'চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স (ক্ষমতার পৃথকীকরণ/ভারসাম্যকরণ) এবং কার্যকর ওয়াচডগ মেকানিজমের (নজরদারি) অভাবে সরকার উদ্ধত ও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। এর ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি, অকার্যকর সংসদ, লাখ লাখ মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব এবং প্রশাসনে মারাত্মক অব্যবস্থাপনা দেখা দেয়'।
তিনি বলেন, প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের প্রকৃতি বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত, যা নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তাকে ক্রমেই অনিরাপদ করে তুলছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে এবং এসবের সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে একটি পঙ্গু সমাজ, যে সমাজে একজন ভালো মানুষ আর ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখেন না; অন্যদিকে খারাপ মানুষের মধ্যে আরও লোভের সঞ্চার ঘটছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাহী বিভাগ আরও অসহিষ্ণু ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আর আমলাতন্ত্র দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। কোনও চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নেই, কর্মক্ষেত্রে কোনও ওয়াচডগ মেকানিজম নেই, এইভাবে অবস্থানে থাকা লোকেরা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ক্ষমতার অবাধ অনুশীলনের দুঃসাহস দেখাচ্ছে।
২০২৪-এ নজর
প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করার পরও হাসিনা সরকারকে কোনো জোরালো সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হতে হয়নি। এটি স্পষ্টতই তার আত্মবিশ্বাসের স্তরকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তবে প্রশাসনিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছিল।
বাংলাদেশে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ থাকলেও দলীয় সরকারের অধীনে নিয়ন্ত্রিত এবং একচেটিয়াভাবে নির্বাচন করার অভিযোগ ওঠে। নির্বাচনের আগের রাতেই বিভিন্ন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরেছে— এমন অভিযোগ থাকায় অনেকেই এই নির্বাচনকে 'শেষরাতের ভোট' বলে সম্বোধন করেন।
কাল্ট কালচার প্রচার করেছেন শেখ হাসিনা। উত্তর কোরিয়ার মতো বাংলাদেশেও অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার নিহত বাবার স্মৃতি প্রচারের জন্য বঙ্গবন্ধু কর্নার স্থাপন করতে বাধ্য করেছেন। ২০২০ সালকে ঘোষণা করেছিলেন মুজিববর্ষ হিসেবে।
পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালে এলো আরেকটি নির্বাচন। তিনি আবারও সামলে নিলেন। কিন্তু জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের মাত্র ছয় মাসের মাথায় শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে। ছাত্র ও জনগণের তীব্র আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তার পতনের জন্য এখন অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে তার ঔদ্ধত্যকে।