খোঁজ নেই ২ মেয়রের, রাজধানীতে মশা আতঙ্ক, বাড়ছে ডেঙ্গু
সম্প্রতি রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে ঢাকার দুই মেয়র নিখোঁজ থাকায় দুই সিটি কর্পোরেশনের বিশেষ মশা নিধন অভিযান বর্তমানে থেমে আছে।
এছাড়াও, লার্ভিসাইড স্প্রে এবং ফগিংসহ সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত মশা বিরোধী ব্যবস্থাগুলোও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে রাজধানীতে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে।
সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার আগেই ৩ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। আর ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম দেশে থাকলেও তিনি আছেন আত্মগোপনে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশক নিধনের নামে সিটি কর্পোরেশনে ব্যাপক দুর্নীতি হয়। এই পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সাথে সাথে মশক নিয়ন্ত্রণে একটি আধুনিক পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। সিটি কর্পোরেশন যে কাজ করছে তাতে খুব একটা মশা কমছে না।
এ বছরের শুরু থেকে শনিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের, যাদের মধ্যে ৫২ জনই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের। প্রায় ৭০% মৃত্যুই ঘটেছে ঢাকায়। আর আক্রান্তের প্রায় ৪২% রোগীই ভর্তি হয়েছেন রাজধানীতে।
এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত সর্বোচ্চ সংখ্যায় উঠেছিল জুলাইয়ে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১,৬৬৯ জন। কিন্তু চলমান আগস্ট মাসের ১৭ দিনেই এই সংখ্যা পেরিয়ে দাঁড়িয়েছে ২,৮৯৭ জনে। আর এ ১৭ দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের— যা এ বছরের যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি।
শনিবারে (১৭ আগস্ট) রাজধানীর গুলশান-১ এর ১২ নং রোড থেকে ১৫ নং রোডে সকালে মশার ওষুধ ছিটানো (লার্ভিসাইড) এবং বিকালে ফগিং এর দায়িত্বে আছেন মশক কর্মী লিয়াকত। তবে তিনি শনিবারে তার নির্ধারিত এলাকায় কাজে যাননি। এমনকি গত ৪-৫ দিন ধরে তার নির্ধারিত এলাকায় কোনো মশন নিধন কার্যক্রম চলেনি।
লিয়াকত দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত চারদিন ধরে বিকালে ফগিং করা বন্ধ রয়েছে। সকালে লার্ভিসাইডিং মাঝে মাঝে করা হয় তবে গলির ভিতরে যাওয়া হয় না। এতদিন সমস্যা চলছিল তাই কার্যক্রম ঠিকভাবে চালানো সম্ভব হয়নি।"
গুলশান-১ এর ১৩ নং রোডের বাসিন্দা হাসিবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "গত এক মাসে মনে হয় আমাদের এলাকায় ২ দিনও মশার ওষুধ ছেটানো হয়নি। গত এক সপ্তাহে সকালে কিংবা বিকালে কোনো সময়েই কেউ আসেনি মশার ওষুধ দিতে। এই কয়েক দিনে মশার উৎপাতও বেড়েছে কয়েক গুণ। ভবনের আশপাশে বেশ কয়েকটি ভবনে কনস্ট্রাকশন চলমান, কিন্তু সেখানে ওষুধ দেওয়া জরুরি।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা আবু নাইম টিবিএসকে বলেন, "মেয়র দেশে ছেড়ে পালানোর পরে মশা মারার কার্যক্রম চোখে পড়েনি। মনে হচ্ছে, মেয়র পালিয়ে আমাদের জন্য মশা পাঠিয়ে দিয়েছেন। গত ১৫ দিনে কোনো মশক কর্মীকেই দেখিনি ফগিং করতে কিংবা সকালে লার্ভিসাইড করতে।"
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আন্দোলনের সময় আমাদের ৭২ নং ওয়ার্ডের মশক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি সব পুড়িয়ে ফেলা হয়, তাই ওই ওয়ার্ডে কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। বাকি এলাকাগুলোতে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ফজলে শামসুল কবির বলেন, "এই মুহূর্তে আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারছি না।"
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরু-আল-কয়েস টিবিএসকে বলেন, "আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ নেই। সবকিছু ঠিকমতোই চলছে। আমাদের ৫৪টি ওয়ার্ডে প্রায় ১,১০০ মশক কর্মী কাজ করেন। বরং এখন কাউন্সিলরগণ না থাকায় আগে যেসব মশক কর্মীরা কাজে আসতেন না, এখন তারাও কাজে আসছেন।"
তিনি বলেন, "ঢাকা উত্তর গত ১৪ আগস্ট ২৯ জন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে যাদের মধ্যে ১৬ জন ঢাকা উত্তরের রোগী, বাকিরা ঢাকার বাহিরের।"
দুই সিটি কর্পোরেশন মশক নিধন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে বলা হলেও শনিবার সরেজমিনে গুলশান, মহাখালী, শেওড়াপাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নিউমার্কেট ঘুরে কোনো মশক কর্মীকে মাঠে পাওয়া যায়নি। এমনকি, শিডিউলে যেসব মশক কর্মীর থাকার কথা, তারা ওইসব এলাকায় সকালে লার্ভিসাইট এবং বিকালে ফগিং করেননি।
শুধু এসব এলাকাতেই নয়— রাজধানীর বাংলামোটর, পল্টন, জুরাইন, পুরান ঢাকা, মগবাজার, গুলশান-২, রামপুরা, কারওয়ানবাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব এলাকাতেও নিয়মিত নয় মশক কর্মীরা।
কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "গত বছরের তুলনায় এবারে ডেঙ্গু রোগী কম থাকলেও যতো রোগী ও মৃত্যু হচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। ডেঙ্গু রোগী কমার ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশনের কোনো অবদান নেই। এজন্য গত বছরের একই সেরোটাইপ এবং আবহাওয়ার কারণে প্রাদুর্ভাব কম।"
তিনি বলেন, "ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এখন নতুন সরকারকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হাঁটতে হবে এবং এ খাতকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে।"