শিবলী-কমিশন যেভাবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা কেড়ে নেয়
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সদ্য বিদায়ী চেয়্যারমান শিবলী রুবাইয়েত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশনের হস্তক্ষেপের কারণে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার কারসাজিসহ নানা অনিয়ম হলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসইসি)।
স্টক এক্সচেঞ্জের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দাবি, মূলত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি- এর হস্তক্ষেপের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ তার ম্যান্ডেড অনুযায়ী পুঁজিবাজার ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
লিস্টিং রুলস অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে স্বচ্ছতা আনতে স্টক এক্সচেঞ্জকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০২০ সালের মে মাসে শিবলী রুবাইয়েত-উল ইসলাম দায়িত্ব নেওয়ার পর বহু অনিয়ম হলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ।
সদ্য বিদায়ী শিবলী নেতৃত্বাধীন কমিশনের হস্তক্ষেপের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ অনেকটাই ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। প্রাইমারি রেগুলেটর হলেও এখন ৫,০০০ টাকা জরিমানা করা ছাড়া কার্যত কোনো ক্ষমতা নেই স্টক এক্সচেঞ্জের।
ডিএসইর সাবেক এক ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্টক এক্সচেঞ্জের। তবে বিগত কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হস্তপেক্ষেপের কারণে ডিএসই তার নিজ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।"
কমিশনের স্বেচ্চাচারিতার কারণে স্টক এক্সচেঞ্জ যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। পুঁজিবাজারের শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে স্টক এক্সচেঞ্জের আরও ক্ষমতায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
আবার স্টক এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে কমিশনের আস্থাভাজন লোকজন বসিয়ে মূলধন উত্তোলন করা কোম্পানিতে প্রাইভেট প্লেসমেন্টে শেয়ার কারসাজির সুযোগও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ কর্মকর্তাদের। আইপিও রিভিউ কমিটি, মার্কেট অপারেশন্স ও ইনভেসটিগেশন বিভাগ থেকে যোগ্য লোকদের সরিয়ে দিয়ে পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
স্টক এক্সচেঞ্জ বিএসইসির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠান, যা ডি-মিউচ্যুয়াইজেন স্কিম অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
এই স্কিম অনুযায়ী, ২৫০ জন ট্রেকহোল্ডার বা ব্রোকারেজ হাউস, স্টক এক্সচেঞ্জের প্রাইমারি শেয়ারহোল্ডার। তাদের মালিকানায় রয়েছে ৪০ শতাংশ শেয়ার।
ইতোমধ্যে ২৫ শতাংশ কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করা হয়েছে আর ৩৫ শতাংশ প্রাথমিক গণপ্রস্তাবেরর (আইপিও) মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীর কাছে বিক্রি করা হবে।
পুঁজিবাজার সঠিকভাবে পরিচালনায় কমিশন বিভিন্ন নীতি বা আইন প্রণয়ন করে, যা বাস্তবায়ন করে স্টক এক্সচেঞ্জ।
লিস্টিং রুলস অনুযায়ী, তিন বছর উৎপাদনে না থাকলে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ডি-লিস্ট করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ।
ইনভেস্টমেন্ট ডিসিশান প্রভাবিত হয় এমন তথ্য প্রকাশ না করা, তিনবছর লিস্টিং ফি না দেওয়া ও পাঁচ বছর লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ হওয়া কোম্পানির শেয়ার ট্রেডিং হল্ট, সাসপেন্ড বা ডি-লিস্টি করার ক্ষমতা রয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জের।
পাশাপাশি কোনো কোম্পানির শেয়ার ম্যানুপুলেশন হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসাবে ডি-লিস্ট বা ট্রেড সাসপেন্ড করার ক্ষমতাও স্টক এক্সচেঞ্জের রয়েছে।
তবে বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, শেয়ার কারসাজি, লভ্যাংশ দিতে না পারা কিংবা উৎপাদন বন্ধ থাকলেও গত পাঁচ বছরে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ।
উদহারণস্বরূপ— ১৮ বছরের বেশি উৎপাদনে নেই তালিকাভুক্ত কোম্পানি মেঘনা পিইটি ইন্ডাস্ট্রিস। উৎপাদন না থাকায় বছরের পর বছর কোনো লভ্যাংশও দিতে পারছে না কোম্পানিটি। জেড ক্যাটাগরিভুক্ত কোম্পানিটির শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি স্টক এক্সচেঞ্জ।
কমিশনের এক পরিদর্শনে ২০০৪ সাল থেকে কোম্পানিটির উৎপাদন বন্ধ থাকার প্রমাণও মিলেছে।
একইভাবে ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে উৎপাদনে নেই শ্যামপুর সুগার মিলস। তারপরও গতবছরের ৫ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারি মালিকানাধীন চিনি কলটির শেয়ার দাম বেড়েছে ১৬৬ শতাংশ।
সাম্প্রতিক সময়ে দূর্বল বা লোকসানী কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি স্টক এক্সচেঞ্জ। দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কেবল কারণ দর্শানো চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সংস্থাটি।
যেভাবে স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা খর্ব
তিন বছরের বেশি উৎপাদনে না থাকায় ২০১৮ সালে রহিমা ফুড কর্পোরেশন ও মডার্ন ডাইং কোম্পানির শেয়ার লেনদেন স্থগিত করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ।
শিবলী কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর কমিশন এক নির্দেশনায় ওই কোম্পানি দুটিকে আবারও মূল মার্কেটে ফিরিয়ে আনে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কোম্পানি দুটির লেনদেন চালু হয়।
লিস্টিং রুলস অনুযায়ী, শেয়ার লেনদেন সাসপেন্ড করা হলেও স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে ব্যাখা চায় কমিশন।
এরপর বিভিন্ন সময় লিখিত কিংবা মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ করছেন ডিএসইর কর্মকর্তারা।
পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে আসা কোম্পানির বিষয়ে ডিএসইর রিভিউ টিম নেতিবাচক মতামত দিলেও গায়ে মাখেনি কমিশন। উল্টো আইপিও অনুমোদন দিয়েছে, যাদের বেশির ভাগের অবস্থাই এখন ভালো না।
কমিশনের স্বেচ্ছাচারিতায় তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে জেড ক্যাটাগরিতে অবনমনে ডিএসইর ক্ষমতাও কেড়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সদ্য বিদায়ী কমিশনের বিরুদ্ধে।
স্টক এক্সচেঞ্জের হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদনে না থাকায়, রিটেইনড আর্নিংস নেগেটিভ, লভ্যাংশ দিতে ব্যর্থ এমন অন্তত অর্ধ-শতাধিক কোম্পানি জেড ক্যাটাগরিতে যাওয়ার যোগ্য হলেও তা করতে পারছে না স্টক এক্সচেঞ্জ।
এক নির্দেশনায়, ক্যাটাগরি অবনমন ঠেকিয়ে দিয়েছে চেয়্যারম্যান শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলাম কমিশন।
ক্ষমতা কেবল ৫০০০ টাকা জরিমানা
স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্টক এক্সচেঞ্জের ক্ষমতা এখন কেবল ৫,০০০ টাকা জরিমানা করার মধ্যে সীমাবন্ধ।
কোনো কোম্পানি প্রান্তিক বা অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন যথাসময়ে জমা দিতে ব্যর্থ হলে প্রতিদিন ৫,০০০ টাকা করে এই জরিমানা করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ। লিস্টিং ফি দিতে ব্যর্থ হলেও একই জরিমানার বিধান রয়েছে।
তবে জরিমানা টাকা কেউ পরিশোধ না করলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্টক এক্সচেঞ্জ। এতে বকেয়ার বিপরীতে কোটি কোটি টাকা প্রভিশন রাখতে হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জকে।
ডিএসইর লিস্টিং বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, "তালিকাভুক্ত কোম্পানি লিস্টিং রুলস মানছে কিনা, সেসব দেখভাল করে স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে রুলসে যে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান, তা করা যাচ্ছে না।"
কারণ হিসাবে তিনি বলেন, "আগে উৎপাদন বন্ধ থাকায় কারণে দুটি কোম্পানিকে ডি-লিস্ট করা হলেও, কমিশন পরবর্তীতে তাদেরকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা দেয়, যার কারণে আর কোনো কোম্পানিকে ডি-লিস্টিং করা হয়নি।"
তিনি বলেন, "আর্থিক প্রতিবেদন যথাসময়ে না দিলে জরিমানা করা হয়। তবে জরিমানা না দিলেও কিছু করা যায় না। ফলে এভাবেই চলে যাচ্ছে। স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না।"
উৎপাদনের নেই দুই ডজন কোম্পানি
ডিএসইর লিস্টিং বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দুই-ডজনের মতো কোম্পানির উৎপাদনের অবস্থা খুবই শোচনীয়।
কোনোটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, আবার কোনোটির আংশিক উৎপাদন চলছে। প্রান্তিক বা অর্থবছরের আর্থিক হিসাব বা লিস্টিং ফিও সময়মত দিচ্ছে না।
তারপরও এসব কোম্পানি নিয়ে বিভিন্ন সময় গুজব কিংবা মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্টক এক্সচেঞ্জ।
কোনো কোম্পানির অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির বিষয়ে কমিশন তদন্তের নির্দেশ দিলে তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেয় স্টক এক্সচেঞ্জ।
প্রতিবেদন পাওয়ার পর কমিশন প্রয়োজন মনে করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করে অথবা তদন্ত প্রতিবেদন পড়েই থাকে।
কোম্পানি পরিদর্শন
লিস্টিং রুলস অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সার্বিক বিষয় দেখভাল করে এক্সচেঞ্জ। তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রকৃত চিত্র জানতে স্পট ইন্সপেকশন বা পরিদর্শনও স্টক এক্সচেঞ্জ করে থাকে।
তবে স্পট ইন্সপেকশন কমিশনের অনুমতি ছাড়া করা যায় না।
ইন্সপেকশনের বিষয়ে লিস্টিং রুলসে বলা হয়েছে, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা বা তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজ ইস্যুকারীর বিষয়গুলো পর্যালোচনার প্রয়োজন হলে, কমিশনের পূর্বানুমতি নিয়ে যেকোনো সময় ইন্সপেকশন (পরিদর্শন) করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ।
তবে কোম্পানি পরিদর্শনের অনুমোদন পাওয়া সময় সাপেক্ষ, যার কারণে কোম্পানির প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব হয় না উল্লেখ করে ২০২১ সালে বিএসইসির কাছে চিঠি দেয় স্টক এক্সচেঞ্জ।
ওই চিঠিতে কমিশনের অনুমোদনের বদলে কমিশনকে জানিয়ে কোম্পানি পরিদর্শন করার অনুমতি চেয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ। তবে তিন বছর পার হলেও সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি কমিশন।