আওয়ামী লীগের পতনে পরিবহন খাতের নেতৃত্বে বদল; দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে সারাদেশের বাস পরিষেবা ও টার্মিনালগুলোতে নতুন দখলদারদের আবির্ভাব হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পারিবহন খাতের শ্রমিকদের অভিযোগ, শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জায়গায় এখন পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রিত নিতে তৎপর হয়ে উঠেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
এই পরিবর্তনের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এনা পরিবহন ও এর মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ। গত ১৫ বছর যাবত ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে একমাত্র সরাসরি বাস সার্ভিস হিসেবে চলাচল করে এনা পরিবহনের বাসগুলো।
পরিবহন শ্রমিকরা জানান, এনার মালিক বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব ও আওয়ামী লীগ নেতা এনায়েত উল্লাহর দাপটে অন্য কোনো পরিবহন ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে টিকতে পারত না।
তবে গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এনা বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ভোগান্তিতে পড়ে যান এই রুটের যাত্রীরা।
যদিও এনায়েত উল্লাহ কোম্পানির মালিক হলেও তার বাস ছাড়াও এনা পরিবহনের ব্যানারে আরও বেশ কয়েকজন মালিকের বাস চলতো। যাত্রীদের চাহিদা থাকায় সেসব মালিকদের বাসগুলো এখন বিএনপি নেতার মালিকানার ইউনাইটেড পরিবহনের ব্যানারে চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অন্যান্য রুটের সাধারণ মালিকরাও যারা এক সময় আওয়ামী লীগের মালিকানা কোম্পানির ব্যানারে চলতো, এখন বিএনপি নেতা-কর্মীদের মালিকানা কোম্পানির ব্যানারে চলাচলের আগ্রহ দেখাচ্ছে।
এছাড়া, ১৫ বছর যাবত আওয়ামী লীগের চাপে বন্ধ থাকা বিএনপির মালিকানাধীন পরিবহনগুলোও ফের চলাচলের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
টার্মিনালের দখল ও চাঁদাবাজি
এদিকে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হওয়া এবং টার্মিনালগুলোর নিয়ন্ত্রণকারী আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাস টার্মিনালগুলো বিএনপির নেতা-কর্মীদের দ্বারা দখল হয়ে গেছে। চাঁদা আদায়েরও অভিযোগ উঠেছে অনেক জায়গায়।
জানা যায়, ঢাকার গাবতলী টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন হানিফ পরিবহনের মালিক ও আমিনবাজারের বিএনপির নেতা কফিল উদ্দিন।
তিনি বলেন, "আমি টার্মিনাল বা মালিক সমিতি দখল করিনি। আমি শুধু গাবতলীতে সব চাঁদাবাজি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছি এবং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে অন্য কোনো চাঁদাবাজ যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য কাজ করেছি।"
সূত্র জানায়, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী টার্মিনালের দখল নিয়েছেন বিএনপির আখতারুজ্জামান বাবুল, জাহিদ আল লতিফ খোকা, তানবির রানা সহ বেশ কয়েকজন। আর গুলিস্তান স্ট্যান্ড এখন নিয়ন্ত্রণ করছেন বিএনপির আলমগীর কবির।
যদিও মহাখালি টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ এখনও কেউ নেয়নি তবে যেকোনো সময় সেটিও দখল হয়ে যাবে।
আলমগীর কবির বলেন, "সরকার পতনের পর গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া স্ট্যান্ডে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আমরা স্ট্যান্ড পরিচালনা করতে এবং যাত্রীদের সুবিধার্থে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ও সঠিক পরিষেবা নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিয়েছি।"
বিএনপির লতিফ খোকা বলেন, "আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন আগের কমিটি টার্মিনাল অরক্ষিত রেখে পালিয়ে গেছে। দুর্নীতিবাজ মধ্যস্বত্বভোগীদের ক্ষমতা দখল এবং চাঁদাবাজি যেন আবার ফিরে না আসে, সেজন্য আমরা দায়িত্ব নিয়েছি।"
ঢাকার বাইরের বাস টার্মিনাল
দখল হলেও ঢাকার টার্মিনালগুলোতে শনিবার পর্যন্ত চাঁদাবাজির খবর পাওয়া যায়নি। তবে কয়েকটি জেলায় চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে।
খুলনা শহরের অভ্যন্তরে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের দখল নিয়েছেন বিএনপিপন্থীরা। বাস মালিকদের সাথে কথা বলে জেনে গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর খুলনার সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডটি তারা দখল করে নেন। তারা নতুন একটি সংগঠনের আওতায় কার্যক্রম শুরু করেছেন।
চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল করিম বলেন, "১৫ বছর আগে প্রকৃত মালিকদের বের করে দিয়ে রাজনৈতিকভাবে স্ট্যান্ড পরিচালনা করা হয়েছে। তারা বাসপ্রতি ৫০০ টাকা আশেপাশে চাঁদা আদায় করতেন। তবে আমরা বাসপ্রতি ১০০ বা ১৫০ টাকা করে নিচ্ছি। কারণ স্ট্যান্ড পরিচালনায় অনেক খরচ আছে।"
বরিশালের গৌরনদী বাস টার্মিনালে কয়েকজন শ্রমিক জানিয়েছেন, বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপনের অনুসারী পরিচয় দিয়ে ৬ আগস্ট সকাল থেকেই উপজেলার বাস টার্মিনাল, বাজার দখলে নিয়ে চাঁদা তুলছেন বিএনপির কর্মীরা।
অভিযোগের বিষয়ে স্বপনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি; হোয়াটসঅ্যাপে তাকে বার্তা পাঠানো হলেও তার জবাব দেননি তিনি।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা বাস স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড দখলে নিয়েছেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নাসির জমাদ্দার।
বরিশাল মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ রুপাতলী বাস টার্মিনাল ও নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল দখলে নিয়েছেন বিএনপির শীর্ষ নেতাকর্মীরা। এরমধ্যে রূপাতলী বাস টার্মিনালের তিন বছর মেয়াদী কমিটি বাদ দিয়ে নিজেই কমিটি গঠন করেছেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার।
বাস মালিকরা জানিয়েছেন, সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন কমিটি গঠনের কথা শুনেছি। কিন্তু একদিনও বাস টার্মিনালে বাস থেকে চাঁদা তোলা বন্ধ হচ্ছে না। নাতি কালাম নামে একজনের নেতৃত্বে প্রতিটি গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হচ্ছে।
শ্রমিকরা জানিয়েছেন, রূপাতলী বাস মালিক সমিতির ১০১টি বাস থেকে দিনে ২০ থেকে ২২ হাজার চাঁদা উত্তোলিত হয়।
সরকার পতনের পর রাজশাহীতেও পরিবহন খাতের দখল নিয়েছেন বিএনপিপন্থী মালিক-শ্রমিকরা।
সেখানে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাস মালিক বলেন, এতদিন আওয়ামী লীগের নেতারা পরিবহন খাতকে লুটপাট করে খেয়েছে। এখন বিএনপিপন্থী মালিকরা লুটপাটের জন্য দখল নিয়েছে।
"একটি ট্রিপ থেকেই ১০০ থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রিপ বাস চলাচল করে। এছাড়া, আরও বহু খাত আছে, যেখান থেকে চাঁদা দিতে হয়," যোগ করেন তিনি।
চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবহন খাত গড়ার প্রতিশ্রুতি
এদিকে পরিবহন মালিক সমিতির নতুন কমিটির আহ্বায়ক এস এম আহমেদ খোকন টিবিএসকে বলেন, "যদিও টার্মিনালগুলোতে বিএনপির কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, কিন্তু আমরা ইতোমধেই রাজধানীর সব টার্মিনালে চাঁদাবাজি বন্ধ করেছি। রাজধানীর বাইরেও নিষেধ করা হয়েছে। এরপর কেউ চাঁদাবাজি করলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে।"
তিনি জানান, "গত কমিটির আমলে প্রতিদিন বাসপ্রতি সর্বনিম্ন ৮০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হত। সর্বোচ্চ নেওয়া হতো ঢাকা–মানিকগঞ্জ রুটে প্রতিদিন বাসপ্রতি ৩,৬০০ টাকা করে। এটি ছিল বাস মালিক ও শ্রমিকদের উপর নির্যাতন ও অন্যায়-অত্যাচার। তবে আমরা চাঁদাবাজি করতে আসিনি। বন্ধ করতে এসেছি।"
তার মতে, আগে যে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হতো, সেটা বন্ধ করে দেওয়া হবে, এতে প্রতি বাসে আগের থেকে ৬০-৭০ শতাংশ ব্যয় কমবে।
তার বলেন, "কোম্পানি বাসগুলোর যে অপারেশনাল কস্ট, সেটি তারা তুলবে। তবে তার হিসাব রাখতে হবে। পরিচালনার যুক্তিযুক্ত ব্যয় অনুযায়ী কোম্পানি টাকা নিতে পারবে। যার কোম্পানিতে বাস যত বেশি চলবে, বাসপ্রতি পরিচালন ব্যয় তত কম নিতে হবে।"
কমিটির আহবায়ক মো. সাইফুল আলম শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবহন খাতে নানান সংস্কারের কথা জানান।
সড়কে বাসের অবৈধ পার্কিং বন্ধ, ঢাকা সিটি সার্ভিসের অবস্থা ও ভেতরের পরিবেশের উন্নতিসহ সকল বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান তিনি। সমস্যা সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন কমিটি করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এছাড়া, গত ১৪ আগস্ট গঠন করা কমিটি তাদের প্রথম সভায়, চাঁদাবাজি বন্ধ করে পরিহনকে জগতে ব্যবসাবান্ধব ও একটি জনকল্যাণমুখী সড়ক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরমধ্যে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক গড়ার লক্ষ্যে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এছাড়াও, মালিকদের পক্ষ থেকে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা ও সকল টার্মিনালে শ্রমিকদের কাউন্সিলিং/মোটিভেশন সভার আয়োজন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
(আমাদের প্রতিনিধি আওয়াল শেখ (খুলনা), সৈয়দ মেহেদী হাসান (বরিশাল) ও বুলবুল হাবিব (রাজশাহী) প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন।)