ফেসবুকের বিকল্প কেড়ে নেওয়ার পর টেলিগ্রাম দিয়ে বড় সাফল্য পান স্বপ্নবাজ পাভেল দুরভ
বিশ্বের অন্যতম প্রধান যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর একটি গড়ে তোলা এবং তা একাধিকবার করা, বিশেষ করে রাশিয়ার মতো অত্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধমুলক দেশে— সত্যিই চমৎকার একটি বিষয়। ২০০৬ সালে রুশ উদ্যোক্তা পাভেল দুরভ প্রতিষ্ঠা করেন রাশিয়ার ফেসবুক বিকল্প ভিকোনতাকতে (ভিকে)। আট বছর পর ভ্লাদিমির পুতিনের নিরাপত্তা বাহিনী তাকে হয়রানি করার পর তিনি তার শেয়ার ৩০০ মিলিয়ন ইউরোতে বিক্রি করতে বাধ্য হন। অবসর গ্রহণের পরিবর্তে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি তৈরি করেন টেলিগ্রাম মেসেজিং সেবা।
সম্প্রতি টেলিগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পাভেল দুরভকে স্থানীয় সময় শনিবার (২৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় প্যারিসের উত্তরে লো বোর্জে বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার করেছে ফরাসি পুলিশ। টেলিগ্রামের সাথে সম্পর্কিত অপরাধের জন্য একটি ওয়ারেন্ট জারি হওয়ায় ৩৯ বছর বয়সী দুরভকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে দুবাইয়ে নির্বাসিত পাভেল কোম্পানির জন্য বড় পরিকল্পনা করে রেখেছেন এবং তাকে দেওয়া বিশাল অঙ্কের অফার সত্ত্বেও তিনি কোম্পানিটি বিক্রি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
এক সপ্তাহ আগে পাভেল দুরভ ২০১৭ সালের পর প্রথমবারের মতো একটি মিডিয়া আউটলেটের সাথে সাক্ষাৎকার দেন। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ফাইনান্সিয়াল টাইমসকে তিনি জানান, ভবিষ্যতে টেলিগ্রামকে পাবলিক করা নিয়ে ভাবছেন এবং ৩০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বিনিয়োগের প্রস্তাবও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। "আমরা স্বাধীন থাকতে চাই," এ কথা বলেন তিনি। সেই বছরেই তিনি টেলিগ্রামকে পাবলিক করার পরিকল্পনা করছেন।
যদি টেলিগ্রামের জন্য প্রস্তাবটি সত্যি হয় তবে এর মূল্য ভিকে-এর প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ইউরো বাজারমূল্যকে বিশালভাবে বৃদ্ধি করবে। ভিকে বর্তমানে পরিচালিত হচ্ছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের "ছায়া কার্ডিনাল" হার্জেই কিরিয়েঙ্কোর পুত্র ভ্লাদিমি কিরিয়েঙ্কোর মাধ্যমে। ভ্লাদিমির বয়সে পাভেলের থেকে ১ বছরের বড়। তিনি এই বছরের রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের নাম ফাঁস করেছিলেন।
পাভেল ২০০০-এর দশকে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ফিলোলজি (সাংস্কৃতিক ভাষাতত্ত্ব) বিষয়ে স্নাতক করেন। তিনি একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন এবং ফেসবুকের প্রতিষ্ঠার সময়েই ছাত্রদের জন্য কিছু ওয়েবসাইট ডিজাইন করেছিলেন, যা তাকে ২০০৬ সালে ভিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। ভিকে প্রতিষ্ঠার সময় তার সঙ্গে ছিলেন তার ভাই নিকোলাই এবং বন্ধু ও সহপাঠী ইলায়া পেরেকপস্কি, যিনি বর্তমানে টেলিগ্রামের দ্বিতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা।
যখন ভিকে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছিল তখন বিশাল ব্যবহারকারীর সংখ্যা অর্জন করার সময় কিছু বিতর্কে জড়িয়েছিলেন পাভেল দুরভ। ২০১২ সালে তিনি তার সদর দপ্তরের সামনে একশ' ইউরোর নোট ছুড়ে ফেলে একটি বিক্ষোভের সৃষ্টি করেছিলেন এবং ২০১৩ সালে একটি গাড়ি চাপা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জড়িয়েছিলেন, যার জন্য তাকে শাস্তি পেতে হয়নি।
তবে তার প্রথম সাম্রাজ্য হারানোর কারণ তার অদ্ভুত আচরণ ছিল না। ২০১১ সালে রাশিয়ান ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) তার কাছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ব্যক্তিগত তথ্য চেয়েছিল। পাভেল তা দিতে অস্বীকৃতি জানান। দুই বছর পর ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কেহিবি তার কাছে মাইদান প্রতিবাদে অংশ নেওয়া ইউক্রেনীয় ব্যবহারকারীদের তথ্য চেয়েছিল। এই প্রতিবাদী আন্দোলন দুই মাস পর তৎকালীন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে দেশত্যাগের দিকে নিয়ে যায়।
পুতিনের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর ঘনিষ্ঠভাবে তদন্তের পর ২০১৪ সালের এপ্রিলে রাশিয়া ছাড়েন এবং ভিকের শেয়ার মেইলডটআরইউ নামে একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে বিক্রি করেন, যেট ক্রেমলিনের সাথে ঘনিষ্ট ছিল। তখন তিনি বলেছিলেন, "এই দেশে (রাশিয়া) ইন্টারনেট ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়।"
২০২২ সাল টেলিগ্রামের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন থেকে ৯০০ মিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছিল। এর প্রধান কারণ হল: এটি ম্যাসেজিং সার্ভিসের পাশাপাশি হোয়াটসঅ্যাপ-এর মতো অন্যান্য ব্যক্তিগত যোগাযোগ সেবা এবং একটি চ্যানেল সিস্টেম প্রদান করে যা তথ্য দ্রুত সরবরাহ করে। ভালো ইন্টারফেস এবং কনটেন্টে কোন হস্তক্ষেপ না করার নীতির কারণে টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, যা ইলন মাস্কের অধিগৃহীত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এর (প্রথমে টুইটার) তুলনায় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
নিজ দেশের বাজারে টেলিগ্রামের যাত্রা কখনই সহজ ছিল না। ২০১৭ সালে, রাশিয়ান ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ সংস্থা পাভেলের কাছে ইউজারের চ্যাট অ্যাক্সেস করার পাসওয়ার্ড চেয়েছিল। তিনি ক্রেমলিনের দাবিকে তৃতীয়বারের মতো প্রত্যাখ্যান করেন এবং মস্কো একটি আইন পাস করে যা টেক কোম্পানিগুলির জন্য সমস্ত তথ্য রাশিয়ান সার্ভারে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আরোপ করে। টেলিগ্রাম এ প্রস্তাব অগ্রহণ করে এবং ২০১৮ সালে রাশিয়া এটি ব্লক করার নির্দেশ দেয়।
এই পদক্ষেপ কার্যকর হয়নি। তবে ২০২০ সালের গ্রীষ্মে পাভেল এবং রুশ প্রসিকিউটর অফিস একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষণায় জানায়, তারা একটি চুক্তি করেছে যার মাধ্যমে টেলিগ্রাম রাশিয়ায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে যদি তারা নিরাপত্তা বাহিনীকে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে তথ্য দেয়। এই ছাড় দেওয়ার সীমা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে: ক্রেমলিন সবকিছুকে "উগ্রবাদী সংগঠন" হিসেবে গণ্য করে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের পরাজয়ের সমালোচনাকারী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে পুলিশি ব্যবস্থা নিয়েছে।
টেলিগ্রাম বর্তমানে উচ্চতর লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারি শেষে পাভেল ঘোষণা দেন, এটি ১০০টি নতুন দেশে তার প্ল্যাটফর্ম খুলবে এবং সেখানকার বিজ্ঞাপনগুলো থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে আয় করার সুযোগ দেবে। এছাড়া, ফাইনান্সিয়াল টাইমসে তার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, কোম্পানিটি ইতোমধ্যেই "শত শত মিলিয়ন ডলার" আয় করছে এবং এই বছর বা পরের বছর লাভের আশা করছে। আর এই সবকিছু টেলিগ্রাম মাত্র পঞ্চাশ জন পূর্ণকালীন কর্মচারী নিয়ে অর্জন করেছে।
টেলিগ্রাম রাশিয়া, ইউক্রেন এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলোতে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে এবং মস্কো ও কিয়েভের কর্মকর্তারা এটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছেন। কিছু বিশ্লেষক অ্যাপটিকে যুদ্ধের "ভার্চুয়াল যুদ্ধক্ষেত্র" বলে উল্লেখ করেছেন।
ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী, পাভেল দুরভের সম্পদের পরিমাণ ১৫.৫ বিলিয়ন ডলার। তিনি ২০২১ সালের আগস্টে ফরাসি নাগরিক হন। ২০১৭ সালে তিনি নিজেকে এবং টেলিগ্রামকে দুবাইয়ে স্থানান্তরিত করেন। ফরাসি মিডিয়ার মতে, তিনি আরব আমিরাতের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। এছাড়া মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি ক্যারিবীয় দ্বীপ রাষ্ট্র সেন্ট কিটস ও নেভিসেরও নাগরিক।
টেলিগ্রামের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সাথে সাথে ইউরোপের কয়েকটি দেশে, বিশেষ করে ফ্রান্সে নিরাপত্তা ও ডেটা লঙ্ঘনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রকরা টেলিগ্রামের সাথে যোগাযোগ করেছেন, কারণ এটি একটি মূল ব্যবহারের সাথা সম্পর্কযুক্ত কিছু শর্তাবলীর কাছাকাছি পৌঁছেছে যা কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসতে পারে।
"আমি কারও আদেশ মানতে চাই না, আমি স্বাধীন থাকতে চাই"— পাভেল এপ্রিল মাসে মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসনের সাথে সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন। তিনি রাশিয়া ত্যাগের পর তার কোম্পানির জন্য বিভিন্ন শহর যেমন বার্লিন, লন্ডন, সিঙ্গাপুর ও সান ফ্রান্সিসকোতে নতুন ঠিকানা খুঁজেছিলেন।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়