উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে সাবেক অধিনায়করা বলছেন, ‘এটা সেরা সাফল্য’
১৩ টেস্টের ১২টিতেই হার, একটি ম্যাচ ড্র। এই সিরিজের আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের রেকর্ড এটা। এর মধ্যে অর্ধেক ছিল ইনিংস ব্যবধানে হার, বাকি হারগুলোর ব্যবধানও বেশ বড়। সেই দলটির বিপক্ষে তাদের মাটিতেই এবার ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে হারানোর স্বাদ নেওয়ার সিরিজটি ২-০ ব্যবধানে জিতেছে তারা।
বিদেশের মাটিতে এটা কেবল বাংলাদেশের তৃতীয় সিরিজ জয়। এর মধ্যে আগের দুই দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের শক্তিমত্তা নিয়ে আছে প্রশ্ন। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই সিরিজ জয়ে নেই তেমন কোনো হিসাব। এ কারণেই ঐতিহাসিক সিরিজ জয়কে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের সেরা সাফল্য বলছেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়করা।
অনুভূতি জানানোসহ বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন চার সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, হাবিবুল বাশার ও খালেদ মাসুদ পাইলট।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল
বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই বড় অর্জন এটা। লাল বলের ক্রিকেটে তো বাংলাদেশ ভালো করছিল না। এরপর বড় একটা বিরতির পর টেস্ট খেলতে নামলো পাকিস্তানের মতো দলের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই। পাকিস্তানের মাটিতেই তাদেরকে হারানো এটা অবশ্যই বড় সাফল্য। এতো বড় দলের বিপক্ষে এমন সাফল্য আগে কখনও আসেনি। আমার মনেহয় এটা আমাদের অন্যতম সেরা জয়। টেস্টের ২৪ বছরে অন্যতম সেরা সাফল্য।
পাকিস্তান দল কেমন ছিল, কারা নেই, সেটা আলোচনায় আসা উচিত নয়। ঘরের মাঠের সুবিধা নিয়ে খেরেছে, তারা তাদের সেরা দলটাকে খেলিয়েছে। এমন তো না যে 'বি' টিম খেলেছে। তাদের নির্বাচক আছে, পরিকল্পনা আছে, কোনো দেশ নিজেদের মাটিতে হারতে চায় না। বাংলাদেশ ওদের থেকে র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়েও। তো এমন অজুহাত যেন সামনে কেউ না আনে। বাংলাদেশ সেরা পারফরম্যান্স করে জিতেছে, খুবই ভালো ক্রিকেট খেলেছে। মাউন্ট মঙ্গানুইতে আমরা একটা জিতে পরেরটা হেরে যাই। কিন্তু এখানে আমরা একই ধারায় ছিলাম, টানা জিতেছি।
আমাদের দল কিন্তু টেস্টে নতুন নয়, অভিজ্ঞ দল। একেবারে কম ম্যাচ খেলা হয়নি। তো এই সিরিজ জয় ফ্লুক না। ভালো খেলে জিতেছি। টপ অর্ডার নিয়ে চিন্তা ছিল আমার, তবে বেশ ভালো করেছে। অবিশ্বাস্য ভালো বোলিং করেছে আমাদের পেস বোলাররা; হাসান মাহমুদ, তরুণ নাহিদ রানা, তাসকিন আহমেদরা। অবিশ্বাস্য বোলিং করেছে তারা। একজন মূল খেলোয়াড় থাকে, এই পুরো সিরিজের সেই খেলোয়াড় ছিল মেহেদী হাসান মিরাজ। সে খুবই আন্ডাররেটেড। লিটন দাস, মুশফিকুর রহিম অবশ্যই দারুণ ক্রিকেট খেলেছে। আমার দেখা লিটনের সেরা ইনিংস এটা। তবে সন্দেহাতীতভাবে এই সিরিজের মূল খেলোয়াড় মিরাজ। সে ব্যাটে বলে যেভাবে পারফর্ম করেছে, অসাধারণ। এ ছাড়া দল হিসেবে খেলেছে, একে অন্যের জন্য খেলেছে। দারুণ ক্রিকেট।
খালেদ মাহমুদ সুজন
সত্যি বলতে এটা আমাদের জন্য দারুণ একটি গর্বের মুহূর্ত। পাকিস্তানের মাটিতে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ অনেক বড় ব্যাপার। যেখানে কেউ বাংলাদেশের জয়ের আশাই করেনি, সেখানে সিরিজ জয়, অসাধারণ সাফল্য, দারুণ মুহূর্ত। যদিও বাংলাদেশ জিতলে অনেক বলে ফ্রিতে জিতে গেছে। কিন্তু এটা কঠোর পরিশ্রম ও নিবেদনের ফল। কষ্ট করেছে, ভালো পরিকল্পনা নিয়ে গেছে, জেতার আগ্রহ ছিল। নতুন একটা দল, অনেক তরুণ খেলোয়াড় আছে দলে; তারা দেখিয়েছে তারা কতোটা ভালো করতে পারে। আমি খুবই গর্বিত।
২০০৩ সালে আমরা পাকিস্তানের থেকে কোনোভাবেই ভালো দল ছিলাম না। অনেক এগিয়ে থাকা দল ছিল তারা। তবে পেশোয়ার এবং মুলতান টেস্ট আমরা জিততেই পারতাম। হয়তো আমরা জিততে পারিনি অভিজ্ঞতা ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। তখন ডিআরএস থাকলে হয়তো আমরা দুটি টেস্ট ম্যাচই জিততাম। দুর্ভাগ্যবশত ছিল না। তবে হ্যাঁ, এই মুহূর্তে আমি গর্বিত। পাকিস্তানকে হারানোর পর আমরা টেস্ট মর্যাদা পেয়েছিলাম। সেই পাকিস্তানকে সিরিজে হারালাম প্রথমবারের মতো, এটা বিরাট ব্যাপার, বড় সাফল্য।
পাকিস্তান টেস্ট খেলোয়াড় নিয়েই টেস্ট খেলেছে। এই ম্যাচে শাহিন আফ্রিদি বা নাসিম শাহ কেন খেলেনি, সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। তারা সেরা দল নিয়েই খেলতে নেমেছে। তারা শক্তির বিচারে কেমন দল ছিল, সেটা বলে লাভ নেই। এসব বলে আমাদের পারফরম্যান্সকে খাটো করা হয় সব সময়। কেউ বলে না পাকিস্তানের চেয়ে ভালো খেলে জিতেছে বাংলাদেশ। আমরা দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছি। পাকিস্তান খারাপ ক্রিকেট খেলেছে, সন্দেহ নেই। তবে আমাদেরটাই বলতে হবে। ২৬ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর লিটন ও মিরাজ যেভাবে জুটি গড়ে, হাসানের ওই ইনিংসটা; সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমরা সব সময়ই দাপট দেখিয়েছি। কিছু কিছু সময় ওদেরই বরং আত্মবিশ্বাসী মনে হয়নি। আমাদের যাওয়া ৬ উইকেটের ৪টি নাও যেতে পারতো, আমরাও তো ভুল করেছি। এসব বলে আমাদের পারফরম্যান্স ছোট করা যাবে না। পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক ভালো ক্রিকেট খেলেছে, এটাই মূল কথা। ওরা ওদের দেশে খেলেছে, আমরা সফরকারী হিসেবে সিরিজ জিতেছি।
হাবিবুল বাশার
টেস্ট ক্রিকেটে এটা অবশ্যই বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জিতেছি। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ঠিক সেই ওয়েস্ট ইন্জি দল ছিল না। জিম্বাবুয়েও আগের জিম্বাবুয়ে ছিল না। এই পাকিস্তান তো সব সময়ই ভালো দল যেকোনো ফরম্যাটে। আর ঘরের মাঠে পাকিস্তান ভালো দল, ঘরের মাঠে ওদের পারফরম্যান্স তেমনই। আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি। সত্যি বলতে আমরা খুবই ভালো ক্রিকেট খেলেছি এই সিরিজে। আর টেস্ট ম্যাচ জেতা সব সময়ই বিশেষ। বিদেশের মাটিতে টানা টেস্ট ম্যাচ জেতা, এটা অসাধারণ। এই সিরিজে আমরা যেভাবে খেলেছি, সেটা অবিশ্বাস্য। পেস বোলিং বিভাগ, স্পিন বোলিং বিভাগ; সবাই দারুণ করেছে। সব মিলিয়ে ব্যাটে-বলে আমরা যেভাবে পারফর্ম করেছি, এটা দারুণ, স্পেশাল।
আমরা আগেও টেস্ট জিতেছি। মাউন্ট মঙ্গানুইতে নিউজিল্যান্ডকে হারানোটা উপরের দিকেই থাকবে। দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডকে হারিয়েছি। নিউজিল্যান্ডের কথা আলাদা করে বলবো। কারণ, উপমহাদেশের দল হিসেবে সেখানে গিয়ে জেতাটা খুব কঠিন। সেই কঠিন কাজটা আমরা করেছি। আমরা টেস্ট ক্রিকেটে জেতা শুরু করেছি। আর এই দুটি যে জিতলাম, সেরা ক্রিকেট খেলেই জিতেছি। ব্যাটিং বা বোলিং ট্র্যাক, আমরা চ্যালেঞ্জ নিতে পেরেছি। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। যেটা সব সময় আমরা পারি না। সব মিলিয়ে এটা 'কমপ্লিট পারফরম্যান্স'।
দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে তো আমরা ভালো বোলিং করেছিই, তবে দ্বিতীয় ইনিংসের বোলিং বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অতো ভালো না করতে পারলে পাকিস্তান ২৫০ রানের লিড নিয়ে নিতো। তখন কিন্তু অন্যরকম খেলা হতো। দ্বিতীয় ইনিংসে আমরা অসাধারণ বোলিং করেছি। হাসান মাহমুদ, নাহিদ রানা অসাধারণ ছিল। তাসকিনও ভালো করেছে। দলগত পারফরম্যান্স হয়েছে। আমরা সব বিভাগে পাকিস্তানকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছি। দলের প্রতি আমার স্যালুট, হ্যাটস অফ। আমরা যখন ভালো খেলি, তখন প্রতিপক্ষ দলের খারাপটা দেখানো হয়। এটা আমার অনেক বড় দুঃখ। এবার আর তেমন কিছু নেই। বাংলাদেশ ভালো খেলে জিতেছে।
খালেদ মাসুদ পাইলট
এই সিরিজ জয় অনেক বড় ব্যাপার, সবার জন্য অনেক আনন্দের। আমরা যে অবস্থায় ছিলাম, সেখান থেকে বাংলাদেশ দলকে নিয়ে কিন্তু কেউ এভাবে ভাবেনি। কেউ ভাবেনি যে, এমন অসাধারণ পারফরম্যান্স আসবে, সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ। এটার জন্য টিম ম্যানেজমেন্টসহ পুরো দলকে অভিনন্দন জানাই। এই কৃতিত্ব পুরো দলের। টিভিতে আমরা পারফরম্যান্স দেখি, হয়তো মিরাজ ৫ উইকেট নিলো, হাসান ৫ উইকেট নিলো, মুশফিক ১৯১ করলো বা লিটন ১৩৮ করলো।
এসব আমরা টিভিতে দেখেছি, তবে দল হিসেবে পারফরম্যান্স করার জন্য আমার মনে হয় আঠা বা গ্লু দরকার হয়। সবার পারফরম্যান্সের জন্য টিম বন্ডিং দরকার, সেটা বাংলাদেশ দলের ছিল। পাকিস্তানের সেটা ছিল না, তাই তারা পারেনি। এ কারণে বাংলাদেশ দলের সবাইকে কৃত্বিত্ব দেব। লিপু ভাই থেকে শুরু করে যারা ওখানে আছেন, এই কৃতিত্ব সবার। কারণ কেউ না কারা পেছন থেকে বাংলাদেশ দলকে সুন্দরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
দিন শেষে খেলোয়াড়ই খেলবে, কিন্তু এর বাইরেও অনেক ব্যাপার থাকে। তো সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটা বিরাট অর্জন। আমার কণ্ঠ শুনেই বুঝে ফেলার কথা। খুবই গর্বিত মুহূর্ত, ভালো লাগা বা উল্লেখ করার মতো সাফল্য। টানা দুটি টেস্ট ম্যাচ জেতা, সেটাও পাকিস্তানের মতো দলের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই। এটা অসাধারণ। টি-টোয়েন্টিতে দুটি ম্যাচ জিতে যাওয়া যায়। কিন্তু টেস্ট ম্যাচে খাঁটি খেলা খেলে জেতা, দুর্দান্ত ব্যাপার। সম্মিলিত পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ সেটা করে দেখিয়েছে। পাকিস্তানের পেস বোলিং হয়তো তেমন ছিল না, কিন্তু আমরাও বাজে আউট হয়েছি। চরম বাজে অবস্থা থকে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। প্রতিপক্ষের খারাপ পারফরম্যান্স নয়, আমরা সেরা ক্রিকেট খেলে জিতেছি।