চলতি বছরের ৭ মাসে বগুড়া থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ৮১ শতাংশ
গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে বগুড়া থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ৮১ শতাংশ। বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
২০২৩ সালেই এই জেলার রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লাগে। ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর বগুড়ার রপ্তানি আয় কমে ৪০ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজনৈতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানি কমেছে।
বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানির ধরনের পরিমাণও কমেছে।
২০২২ সালে বগুড়া থেকে ১২ ধরনের পণ্য রপ্তানি হলেও ২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭ ধরনের পণ্য। আর এবার সেই সংখ্যা নেমে এসেছে মাত্র তিনটিতে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বগুড়া থেকে ৩.৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। ২০২৩ সালে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩০.০৯ ডলার।
গত বছর প্রতি মাসে বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ২৫.০৮ মিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের প্রতি মাসে এই জেলা থেকে ৫ লাখ ৫১ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি রয়েছে।
আগামীতে পরিস্থিতি ভালো হবে আশা প্রকাশ করে বগুড়া চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক মো. সাইরুল ইসলাম বলেন, বগুড়ার পণ্যের গুণগত মান সেভাবে কমেনি।
'কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই। এই পরিবেশে ব্যবসা ভালো হওয়ার সুযোগ নেই। আবার অনেকে ঢাকা থেকেও প্রডাক্ট অব অরিজিন সার্টিফিকেট নিচ্ছে। এটিও রপ্তানি কমাআর আরেকটি কারণ,' বলেন তিনি।
সাইরুল ইসলাম আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রপ্তানি বাড়বে।
রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত বগুড়ার ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের বৈশ্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা আর চলতি বছরে দেশের রাজনৈতিক সংকট রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক বড় নিয়ামক।
বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও ডলার সংকটকে রপ্তানি কমার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, রপ্তানি ও আমদানির মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক আছে। রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকের সংখ্যা কমে গেছে। এই সমস্যা বিশ্বব্যাপী। তবে বাংলাদেশে এর প্রভাব খুব বড় আকারে পড়েছে।
বিগত গুলোতেবছর বগুড়া থেকে ওয়েল ফিল্টার, এয়ার ফিল্টার, সবজি, সয়াবিনজাত পণ্য, সৌদি রাজকীয় পোশাক, গার্মেন্টস পণ্য, জালি টুপি, হস্তশিল্প পণ্য, ডিজিটাল স্কেল, টিউবওয়েল, নকশিকাঁথা, পাবদা ও শিং মাছ রপ্তানি তালিকায় ছিল।
কিন্তু ক্রমেই এ জেলা থেকে রপ্তানি পণ্যের তালিকা ছোট হয়ে আসছে। এবার সেই তালিকায় রয়েছে শুধু রাইস ব্র্যান ওয়েল, পাটজাত দ্রব্য ও সেচপাম্প।
এ বছরের জুলাই পর্যন্ত বগুড়ার মোট রপ্তানির পরিমাণের তালিকায় শীর্ষে আছে হাসান জুট মিল। তারা রপ্তানি করেছে ১.২১ মিলিয়ন ডলারের পাটজাত পণ্য। ২০২৩ সালে মোট রপ্তানির পরিমাণের তালিকায় শীর্ষে ছিল হাসান জুট মিল। গত বছর তারা ১৬.৬৯ মিলিয়ন ডলারের বেশি পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে। ২০২২ সালেও বগুড়া থেকে এই প্রতিষ্ঠানই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রপ্তানি করেছিল।
কিন্তু এবার রপ্তানির এই পরিস্থিতি কেন, জানতে চাইলে হাসান জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম শাফিকুল হাসান জুয়েল বলেন, 'আমাদের পণ্য কাঁচাপাট। এই পণ্যের দাম গত বছর একদম কম ছিল। পাটজাত পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমে গেছে।
'কিছুদিন ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, দেশের ব্যাপক পরিমাণ কাঁচাপাট রপ্তানি করা হচ্ছে। এ কারণে আমাদের পণ্যের কাঁচামালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে আমাদের উৎপাদনে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব তো আছেই।'
চলতি বছরে জেলা থেকে রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাইস ব্র্যান ওয়েল। এর রপ্তানিকারক বগুড়া মাল্টি অয়েল মিলস। প্রতিষ্ঠানটি এ বছর ১.০৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
২০২০ সালে মজুমদার প্রডাক্টস লিমিটেড রাইস ব্র্যান রপ্তানিতে বগুড়ার শীর্ষ রপ্তানিকারক হলেও গত বছর থেকে তালিকায় তাদের নাম নেই।
এ বিষয়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চিত্ত মজুমদার বলেন, আগে ভারতে রাইস ব্র্যান ব্যাপক আকারে রপ্তানি হচ্ছিল। কিন্তু এখন রপ্তানি কমে গেছে। তারা এখন তেল টিসিবিকে দিচ্ছেন। এ কারণে রপ্তানি করা হচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, ভারতে এবার রাইস ব্র্যান তেলের দাম কম গেছে। আগে শ্রীলঙ্কায় বাজার থাকলেও দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে এবার রপ্তানি করেননি।
নর্থ বেঙ্গল গোল্ডেন জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুভাষ প্রসাদ কানু বলেন, ২০২৪ সালে কয়েক দফায় রাজনৈতিক সংকটের কারণে কিছু বিদেশি অর্ডার মিস হয়েছে। ফলে পণ্য রপ্তানিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
২০২১ সালে তামিম এগ্রো ইন্ড্রাস্ট্রিজ লিমিটেড বগুড়া থেকে শীর্ষ রপ্তানিকারকদের তালিকায় ছিল। এবার তারা তৃতীয় স্থানে থেকে সাত মাসে ৩ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
আগের বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা, জার্মানি, চীন, যুক্তরাজ্যসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো বগুড়ার পণ্য।
কিন্তু গত বছর থেকে শুধু ভারতে জেলাটির পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে। ২০২২ সালে বগুড়ায় তৈরি ১১ হাজার ২৫০ ডলারের এয়ার ও ওয়েল ফিল্টার যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করা হয়। কিন্তু এবার বগুড়া চেম্বারের তালিকায় এই পণ্যের নাম নেই।
বগুড়া থেকে রপ্তানি তালিকায় একসময় চাহিদাপূর্ণ পণ্য ছিল সেচপাম্প। রপ্তানিকারকরা বলছেন, ২০০০ সালের দিকে সেচপাম্প রপ্তানির মাধ্যমে বিদেশের বাজারে বগুড়ার পণ্যের যাত্রা শুরু হয়। তবে দিন দিন সেচপাম্পের সেই চাহিদা কমেছে।
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বগুড়া থেকে রপ্তানি হয়েছে ৫৮.৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ২০২২ সালে রপ্তানি আয় কমে ৫৭.২ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বগুড়া থেকে ২০২০ সালে ৫২.৬২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ২০১৯ সালে বগুড়া থেকে পণ্য রপ্তানি থেকে ৭২.৩৩ মিলিয়ন ডলার আয় হয়।
২০১৮ সালে বগুড়া থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।